অ্যানা অ্যাটকিন্স— ফটোগ্রাফি ও বই চিত্রণের ইতিহাসে এক স্বল্পালোচিত অধ্যায়।
গত দু’দশকে যে কয়েকটি প্রযুক্তিগত বিবর্তন সাধারণ মানুষের জীবনকে সব থেকে বেশি ছুঁয়ে গেছে, ছবি তোলা বা ফটোগ্রাফি নিঃসন্দেহে তার অন্যতম। এই শতকের গোড়াতেও বেশিরভাগ মানুষই একটি ফিল্ম রীলের ৩৬টি ছবির র্যাশান করতে হিমশিম খেতেন। সেখান থেকে ডিজিটাল মাধ্যমের আগমন ফটোগ্রাফির এক দিগন্তের উন্মোচন করে। মোবাইল ফোনের ক্রমাগত উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বলাই যায় এই মুহূর্তে ছবির তোলার সব কৌশলই আজকে প্রায় মানুষের হাতের মুঠোয়। গত কুড়ি বছরের ফটোগ্রাফির এই বিবর্তন নিশ্চয়ই বিস্ময়কর, কিন্তু আদিযুগে একজনের চেহারার প্রতিলিপি করতে সক্ষম এই প্রযুক্তি, জনমানসে যে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছিল তার সঙ্গে বোধহয় কোনওভাবেই তুলনীয় নয়। আদিযুগে ছবি তোলা যখন অনেকটাই পরীক্ষা-নিরীক্ষার স্তরে ছিল সেই সময়ের ফটোগ্রাফির বিভিন্ন প্রক্রিয়ার দিকে ফিরে তাকালে আজকের এই অনায়াস ছবি তোলার দিনে হয়তো এক অন্যধরনের অবাক লাগার সৃষ্টি করতে পারে। এই প্রতিবেদনে আমরা ফটোগ্রাফির প্রাগৈতিহাসিক যুগে ফিরে যাব। এই স্বল্প পরিসরের মধ্যেই আমরা চেষ্টা করব গোড়ার দিকের ছবি তোলার কিছু প্রক্রিয়ার কথা তুলে ধরার। আমাদের এই তুলে ধরার কেন্দ্রবিন্দু হবেন এক অসাধারণ ইংরেজ নারী, অ্যানা অ্যাটকিন্স। অ্যাটকিন্স সেই উনিশ শতকের নারীবর্জিত জ্ঞানচর্চার যুগে শুধু সক্ষমই হননি নিজের স্বাক্ষর রাখার, তিনি সেই সঙ্গে রেখে গিয়েছিলেন এক নতুন পথ বা মাধ্যমের দিশা।
ফটোগ্রাফির আবিষ্কার কবে? এই উত্তর এক কথায় দেওয়া মুস্কিল। কোনও মুহূর্তকে স্থায়ীভাবে ধরে রাখার প্রচেষ্টা বহু বছর ধরেই চলছিল। রেনেসাঁ পরবর্তী সময়ে ইউরোপে আলোর ব্যবহার নিয়ে বৈজ্ঞানিকরা আরও বেশি করে ওয়াকিবহাল হয়ে ওঠেন। লেন্সেরও উন্নতি ঘটতে থাকে, এর একটা যথাযথ উদাহরণ হল ক্যামেরা অবস্কিয়োরা (Camera Obscura)। ক্যামেরা অবস্কিয়োরার প্রযুক্তি অনেকটাই আমাদের ছেলেবেলায় স্কুলে পড়া পিনহোল ক্যামেরার মতো। ক্যামেরা অথবা বাক্সের মধ্যে দিয়ে একটি ছিদ্র দিয়ে আলো পাস করার ফলে উলটোদিকের কাঁচে উলটোনো ছবি ধরা পড়ত। সেই সময়ে বহু চিত্রশিল্পীই ক্যামেরা অবস্কিয়োরার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন বিশেষত কোনও দৃশ্যাবলি আঁকার ক্ষেত্রে। কিন্তু কোনও মাধ্যমে সেই ফুটে ওঠা ছবি স্থায়ীভাবে তুলে ধরা বা সোজাভাবে নেগেটিভে সেই ছবির প্রিন্ট তুলে ধরতে বিজ্ঞানীরা অবশেষে সক্ষম হন উনিশ শতকের গোড়ার দিকে। ফটোগ্রাফির আদিযুগের এই অগ্রগতি প্রথম দেখা যায় ফ্রান্সে। জোসেফ নিসেফর নিয়েপ্স ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দে এই ফুটে ওঠা ছবি প্রথম স্থায়ীভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হন কেমিক্যাল মাখানো কাগজে। নিয়েপ্স তাঁর এই প্রক্রিয়ার নাম দিয়েছিলেন হেলিওগ্রাফি। ফ্রান্সে প্রায় একই সময়ে লুই দ্যাগোরও একই প্রচেষ্টায় নিয়োজিত ছিলেন। নিয়েপ্সের তোলা হেলিওগ্রাফি খুব স্পষ্ট ছিল না। দ্যাগোর সক্ষম হন আরও স্পষ্ট চিত্র তুলতে। দ্যাগোরের প্রক্রিয়া আজকে দ্যাগোরোটাইপ (daguerreotype) নামে পরিচিত। বর্তমান ফটোগ্রাফির সূচনা বলা যায় দ্যাগোরের হাত ধরেই। কিন্তু দ্যাগোরোটাইপেরও কিছু উল্লেখযোগ্য খামতি ছিল। এর পরে ফটোগ্রাফির উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটে ইংলিশ চ্যানেলের ওপারে, অর্থাৎ ইংল্যান্ডে। এই অগ্রগতির অন্যতম শরিক ছিলেন অ্যানা অ্যাটকিন্স।
অ্যানা অ্যাটকিন্সের জন্ম ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের কেন্ট কাউন্টির টনব্রীজ শহরে। এখানে হয়তো উল্লেখ করা অপ্রসাঙ্গিক হবে না, অ্যাটকিন্সের সঙ্গে কলকাতার ইতিহাসের একটি ক্ষীণ যোগসূত্র আছে। অ্যাটকিন্সের মা হেস্টার অ্যানা হলওয়েল ছিলেন জন জেফানিয়া হলওয়েলের নাতনী। হ্যাঁ, সেই হলওয়েল যিনি সিরাজের কলকাতা আক্রমণের সময় ফোর্ট উইলিয়ামের প্রধান ছিলেন এবং ‘অন্ধকূপ হত্যার’ প্রধানতম প্রচারকও বটে।
হেস্টার অ্যানা হলওয়েল, কন্যার জন্মের সময়ে মারা যান। অ্যানার বেড়ে ওঠা সম্পূর্ণভাবে তাঁর বাবা জন জর্জ চিল্ড্রেনের কাছে। জন ছিলেন একজন বৈজ্ঞানিক। সেই সময়ের রীতি অনুযায়ী জনের আগ্রহ ছিল বহুমুখী। তিনি ছিলেন একাধারে রসায়নবিদ, ধাতুবিদ ও প্রাণীতত্ত্ববিদ। এরকম বাবার কাছে অ্যানার বেড়ে ওঠা স্বভাবতই আর পাঁচজন মেয়ের থেকে অনেকটাই আলাদা ছিল। গবেষণায় অ্যানার হাতেখড়ি ঘটে ছোটবেলাতেই। জন ছোট থেকেই অ্যানাকে ওঁর কাজের সহকারী করে নেন। বিশেষ করে অ্যানার দায়িত্ব পড়ে জনের শামুক সংক্রান্ত বইয়ের গ্রন্থ চিত্রণ করার। অ্যানা কঠিন অধ্যবসায়ের সঙ্গে বাবার সংগ্রহ করা শামুক খোলের চিত্র দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তোলেন। প্রকৃতি ও ভিজুয়াল মাধ্যম নিয়ে কাজ করার প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা অ্যানা অর্জন করেন অতি অল্প বয়সেই। পরবর্তীকালে এই দুই বিষয়তেই একত্রে অ্যানা নিজের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখবেন। অনুমান করা সম্ভব, সেই সময়ের পুরুষ-অধ্যুষিত বিজ্ঞানচর্চার জগতে অ্যানা পদার্পণ করার স্পর্ধা বা আত্মবিশ্বাস কীভাবে অর্জন করেছিলেন।
অ্যানা বিবাহের পরেও প্রকৃতিচর্চা ও ভিজুয়াল মাধ্যমে প্রকৃতিকে ডকুমেন্ট করার কাজে অব্যাহতি দেননি। এই ডকুমেন্টশনের কাজ একটা নতুন মাত্রা পায় বিবাহসূত্রে অ্যানার জন ফক্স ট্যালবটের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পরে। ট্যালবট বেশ কিছুদিন কাজ করছিলেন দ্যাগোরোটাইপের খামতিগুলো নিয়ে। দ্যাগোরোটাইপের মুস্কিল ছিল ছবির একাধিক প্রিন্ট করা সম্ভব হত না। একটা ফটোগ্রাফিক প্লেট থেকে একটাই ছবির প্রিন্ট নেওয়া সম্ভব হত। এখানেই ট্যালবট নতুন এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একাধিক প্রিন্ট নেওয়া সম্ভবপর করেন। কিন্তু ট্যালবটের এই প্রক্রিয়া— ক্যালোটাইপ— দ্যাগোরোটাইপকে মুছে ফেলতে অক্ষম হয়। ক্যালোটাইপে, দ্যাগোরোটাইপের মতো স্পষ্ট ছবি তোলা সম্ভব ছিল না। এই ট্যালবটের কাছেই অ্যানার ছবি তোলায় হাতেখড়ি। যদিও দ্বন্দ্ব আছে কে প্রথম মহিলা ফটোগ্রাফার অ্যানা অ্যাটকিন্স নাকি ট্যালবটের স্ত্রী কনস্ট্যান্স ফক্স ট্যালবটে। তবে একথা জোরের সঙ্গেই বলা যায় অ্যানা অ্যাটকিন্স প্রথম মহিলা ফটোগ্রাফারদের অন্যতম। তবে অ্যানার কৃতিত্ব এতেই সীমাবদ্ধ নয়। ফক্স ট্যালবট প্রথম গাছের পাতা, ফুল প্রভৃতির ‘ফটোগ্রাফ’ তোলার প্রচেষ্টা করেন, যার তিনি নামে দেন ‘ফটোগ্রাম’। ট্যালবটের প্রক্রিয়া ছিল বেশ সহজ। কেমিক্যাল মাখানো একটি কাগজের ওপর গাছের পাতা বা ফুল রেখে সেটা কিছুক্ষণের জন্যে সূর্যের আলোয় ফেলে রাখা। এর ফলে সেই কাগজে বা নেগেটিভে সেই পাতা বা ফুলটির চিত্র ফুটে উঠত। প্রকৃতি ও গাছপাতার প্রতি উৎসাহী অ্যানাকে স্বাভাবিকভাবেই প্রক্রিয়াটি আকর্ষণ করেছিল। ক্যালোটাইপ ছবির অস্পষ্টতা নিশ্চয়ই অ্যানাকে খুব একটা সন্তুষ্ট করতে পারেনি।
সমসাময়িক কালেই ইংরেজ জ্যোতির্বিদ স্যর জন হার্শেল একটি অন্য ধাঁচের ছবি তৈরির প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন। ‘সোনার কেল্লা’ সিনেমায় আলোচিত স্যর উইলিয়াম জেমস হার্শেলের পিতা জন এই প্রক্রিয়াটির নাম দেন ‘সায়ানোটাইপ’। সায়ানোটাইপ প্রক্রিয়াটি অনেকটাই ট্যালবটের ফটোগ্রাম প্রক্রিয়ার মতোই, কেবল বিশেষ কেমিক্যাল ব্যবহারের ফলে ফটোগ্রাফিক কাগজটির রঙ হত গাঢ় নীল ও তার ওপরে যে চিত্রটি ফুটে উঠত তার রঙ হত সাদা। এই প্রক্রিয়াটি পরবর্তী সময়ে এবং বর্তমানেও ব্যবহৃত হয় আর্কিটেকচারাল বা অন্যান্য প্ল্যানিং-এর ড্রয়িং-এ। এই বিশেষভাবে লক্ষণীয় নীল রংটির জন্যে এই প্রক্রিয়াটি এখন একটি অন্য নামে অনেক বেশি পরিচিত— ব্লু প্রিন্ট। অ্যানাকে ‘সায়ানোটাইপ’ বিশেষ করে আকর্ষিত করে এবং তাঁকে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি জন হার্শেলের কাছ থেকে সেটি রপ্ত করে নিতে।
অ্যানা নিজের কৈশোরে বই অলংকরণের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন তাঁর বাবার একটি বইয়ের কাজ করতে গিয়ে। প্রায় দু-দশক পরে তিনি নিজেই স্থির করেন নিজেরই অলংকৃত একটি বই বার করবেন। কিন্তু গতবার তিনি নিজে হাতে এঁকেছিলেন; এবারে স্থির করেন তাঁর নতুন শেখা এই বিদ্যেটি কাজে লাগাবেন। সামুদ্রিক জলজ উদ্ভিদের ওপর অ্যানার বইটি, ‘ফটোগ্রাফস অফ ব্লু অ্যাল্গি: সায়ানোটাইপ ইমপ্রেশনস’ বইটি প্রকাশিত হয় ১৮৪২ খ্রিষ্টাব্দে। বই প্রকাশের ইতিহাসে বিশেষ করে বইয়ের অলংকরণে এই কাজটির সবিশেষ গুরুত্ব আছে। এই বইটিতেই প্রথম ফটোগ্রাফের ব্যবহার হয় বই অলংকৃত করার জন্যে। ১৮৪৩ থেকে ১৮৫৩-র মধ্যে অ্যানা আরও দুটি খণ্ড প্রকাশ করেন। পরবর্তী জীবনে অ্যানা অ্যাটকিন্স সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন এবং পাঁচটি উপন্যাস রচনা করেন। অ্যানা অ্যাটকিন্সের প্রয়াণ ঘটে ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে।
এই মুহূর্তে অ্যানার প্রকাশিত তিনসখণ্ড অ্যালবামটি বলা যায় প্রায় অমূল্য। অ্যানা বাণিজ্যিক ভাবে কখনওই বইটি প্রকাশ করেননি, ফলে গোটা বিশ্বে মাত্র ১৭টি কপির খোঁজ পাওয়া যায়। বিশ্বের তাবড় তাবড় লাইব্রেরি ও মিউজিয়ামগুলি এই বইগুলির মালিক বর্তমানে। সুখের বিষয় এই সংস্থাগুলি অ্যানা অ্যাটকিন্সের কাজের গুরুত্ব সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল এবং প্রদর্শনী ও অন্যান্য মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে তারা অবিরত অ্যানা অ্যাটকিন্সের কাজের গুরুত্ব সাধরণের মধ্যে প্রচার করে চলেছে।