Categories
অদ্ভুতপুর |

আকাশবাণী এবং

900 |
Share
| ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০
শ্যামলী আচার্য

গল্পকার ও বেতার উপস্থাপক

চিত্র সৌজন্য: Electronic Design; গ্রাফিক্স: কমলাকান্ত

বেড়ালটা থাকবেই। এবং একবার ফিরে তাকাবেই। রাত বারোটা বেজে কয়েক মিনিট পেরিয়েছে। ‘লাইভ’ টক-শো শেষ করে স্টুডিও থেকে ডিউটি রুম। সেখানে ডিউটি অফিসারকে সব কাগজপত্র বুঝিয়ে সোজা গ্যারাজের দিকে। ওখানেই অফিসের গাড়ি থাকবে। ডিউটি রুম থেকে গ্যারাজ অবধি বিরাট লম্বা প্যাসেজ। অন্ধকার নয়, মায়াবী আলো। চারদিক শুনশান। ত্রিসীমানায় কেউ নেই। ঠিক সেই সময় টয়লেটের পাশে ডানদিকের নিচু জানালা দিয়ে বেড়ালটা এক লাফে নামবে। ওই প্যাসেজেই এসে দাঁড়াবে। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাবে। তারপর দুলকি চালে এগোবে ঠিক সামনে সামনে। একদম গ্যারাজ অবধি। প্যাসেজের শেষে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। সিঁড়ির ঠিক নিচেই ক্যান্টিন। তালাবন্ধ। বেড়ালটা ওই অবধি এসে দাঁড়ায়। তাকায় আমার দিকে। একদৃষ্টে। তারপর ওই সিঁড়িটার তলায় গিয়ে বসে। ভাবখানা এমন, গ্যারাজ অবধি এসেই তো গেছ, আর কেন? এবার কেটে পড়ো। ওর ওই দৃষ্টিতে কোনও মায়া নেই। আশ্বাস বা ভরসাও দেখিনি। বরং যেন একটা আক্রোশ। অস্বস্তি হয়। কেন জানি না, এটা প্রতিবার ঠিক আমার রাতের ডিউটি থাকলেই হয়। মানে, আমি আর অন্য কারও ক্ষেত্রে এত গভীর সমাপতনের গল্প শুনিনি। মিশমিশে কালো একটা বেড়াল আমাকেই বা কেন অত রাতে গ্যারাজ অবধি পথ দেখায়?

১৯৯৭ সাল। শীতের রাত। অনুষ্ঠানের নাম ‘আজ রাতে’। আকাশবাণীর এফ এম চ্যানেল তখন সদ্য কলকাতায় হাঁটি-হাঁটি পা-পা। ‘লাইভ’ টক-শোয়ের প্রেমে তখন শহর আচ্ছন্ন। চিরকালীন রেডিওপ্রেমিক আমিও তখন আঠার মতো আটকে রয়েছি ‘আজ রাতে’র সঙ্গে। দু’ঘন্টার টক-শোয়ে অতিথি হয়ে এসেছেন সঙ্গীতশিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। অনেক কথা, অনেক গান, অনেক স্মৃতিচারণ। ঘড়ির কাঁটায় প্রায় পৌনে বারোটা তখন। উপস্থাপিকা তাঁকে জিগ্যেস করেন, গার্স্টিন প্লেসে রেডিওর পুরনো বাড়িতে শুনেছি ভূত দেখেছেন অনেকেই; আপনি দেখেননি? শোনান না সেইরকম কিছু রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। সঞ্চালিকার গলায় তরল পরিহাসের সুর। দ্বিজেনবাবু গম্ভীর। মন্দ্র কন্ঠে বললেন, এভাবে বোলো না, তাঁরা ছিলেন। আমি নিজে জানি, তাঁরা ছিলেন ওখানে। তাঁদের উপস্থিতির কথা আমি কেন, অনেকেই জানতেন। রেডিওর অন্য প্রান্তে শ্রোতা আমি শিউরে উঠি। অলৌকিকে এত বিশ্বাস? ঠিক একই ধরনের গল্প একবার বলেছিলেন শীর্ষেন্দুবাবু। সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়।

ঘটনা দুটি উল্লেখ করার কারণ ভেঙে বলি এবার। ১৯৯৮ সালের মে মাসে ওই ঐতিহাসিক বাড়িটিতে ঢোকার এবং কাজ করার সুযোগ হয়। এফ এম চ্যানেলের ক্যাজুয়াল বাংলা উপস্থাপিকা। একদিন গিয়ে ফর্ম জমা দেওয়া, একদিন লেখার পরীক্ষা, একদিন অডিশন . . . সব মিলিয়ে কাজ শুরুর আগেই বার তিনেক। রাজভবনের উল্টোদিকে, ইডেন গার্ডেনসের পাশে বিরাট বাড়ি। জমকালো। আকাশবাণী ভবন। গার্স্টিন প্লেসের পুরনো বাড়িটির বহু গল্প তখনও আনাচে কানাচে। প্রতিটি কোণায় ইতিহাস। আর সেই সঙ্গে জড়ো হয়ে থাকা বহু রহস্য। অতীতে সাহেব ভূতের কথাই শুনেছে সকলে। তিনি পিয়ানো বাজাতেন। তাঁর পায়চারির আওয়াজ স্পষ্ট শোনা যেত রাত বাড়লে। যদিও গার্স্টিন প্লেস থেকে সেই ভদ্রলোক আর এই বাড়ি অবধি পৌঁছননি। বরং ফাঁকা মিউজিক স্টুডিওতে হঠাৎ পিয়ানো বেজে উঠলে ধেড়ে ইঁদুরের ছুটোছুটি আবিষ্কার করে বিজ্ঞান-রসিকেরা পুলকিত হয়েছেন।

সবই ইথারে ভেসে বেড়ায়। ইতিহাস থাকলে তার আনুষঙ্গিক কাহিনি তো থাকবেই। কাজেই আমরা নবীন কাঁচার দল ক্যান্টিনের টেবিল-চেয়ার জুড়ে বসে বড়দের কাছে হামেশাই সেইসব সেনসেশন্যাল গল্প গিলেছি গোগ্রাসে। ঊর্মিদি (ঊর্মিমালা বসু) যুববাণী থেকে কাজ শুরু করেছেন, জগন্নাথদাও তাই। স্বরাজ বসু, সৌমিত্র বসু, সৌম্যদেব বসু, অলক রায় ঘটক, অনুপ ঘোষ, সুমিতা বসু, ঊর্মিদির মতো অসংখ্য তারকা তখন আকাশবাণীর এফ এম চ্যানেল হওয়ার সুবাদে টক-শো প্রেজেন্টার হিসেবে আমাদের সিনিয়র এবং শ্রদ্ধা-আদর মেশানো দাদাদিদি। তাঁদের স্টকে নানান গল্পের মধ্যেই ওই সাহেবের গল্পটি বেশ জায়গা করে নিত। তবে গল্পই। তার সত্যতা নিয়ে কারও কোনও মাথাব্যথা ছিল না।

আমি চিরকালের ভীতু প্রাণী। রাত বারোটা থেকে ভোর সাতটার মধ্যে যে ওভারনাইট ডিউটি শিডিউল, তাতে আমি জীবনে কোনওদিন কাজ করিনি। করতে চাইনি। তার মানে যে রাত জাগা স্পেশাল অনুষ্ঠানে থাকিনি, তা নয়। কিন্তু সে প্রোগ্রাম তো অনেকে মিলে হই-হই। বিজয়ার আড্ডা, মহালয়ার আগের রাত, এগুলোতে রাত জাগতে হয়েছে, হট্টগোল হয়েছে বিস্তর। ভয়ের প্রশ্নই নেই। সেই সব তো সুখস্মৃতি। কিন্তু রোজকার ওভারনাইটের ডিউটিতে তো একা। রাত বারোটার পরে সবেধন নীলমণি ডিউটি অফিসার আর ইঞ্জিনিয়র ঘুমোতে চলে যাবেন। আকাশবাণীর স্টুডিওতে যাঁরা ঢুকেছেন, তাঁরা জানেন, এই বিশাল চত্বরে একটিমাত্র ছোট ঘরকে স্টুডিও বলে না। প্রায় তেরো-চোদ্দটি বিভিন্ন মাপের স্টুডিও রয়েছে এখানে। খবর পড়ার জন্য, যুববাণী, কলকাতা ‘ক’ (এখন তার নাম ‘গীতাঞ্জলি’), কলকাতা ‘খ’ (‘সঞ্চয়িতা’), মৈত্রী, বিবিধভারতী, গানের রেকর্ডিং, নাটকের রেকর্ডিং, লিসনিং রুম, কন্ট্রোল রুম . . . ড্রামা স্টুডিওতে তো ফুটবল খেলার মতো প্রশস্ত জায়গা। গানের ঘরে সারে সারে তানপুরা, হারমোনিয়ম। এফ এম সেকশনেরই রেনবো আর গোল্ড মিলিয়ে তিনটি স্টুডিও। তার সঙ্গে আর্কাইভ, মিউজিক লাইব্রেরি। সব ওই স্টুডিও চত্বরেই। অতএব, একবার ঢুকে পড়া মানে গোলকধাঁধা। বাইরের ডিউটি রুম থেকে এফ এম স্টুডিও যেতে অটো ভাড়া করা উচিত কিনা, তা নিয়ে একসময় বিস্তর রসিকতা চলত। এত কথা বলার কারণ একটাই— যে এফ এম চ্যানেলে ওভারনাইট ডিউটি করবে, তাকে এই গোটা চত্বরে থাকতে হবে একা। রাতভর।

প্রথমদিকে মেয়েদের ওভারনাইট ডিউটি দেওয়া হত না। নিরাপত্তা তো বটেই, তাদের দিক থেকেও দুঃসাহস দেখা যায়নি। ক্রমশ নিয়মের বাঁধন শিথিল হল। সকলেই ওভারনাইট ডিউটি করছে। কেউ কোনওদিন কোনও অলৌকিক অভিজ্ঞতা ভাগ করেনি। বরং অন্য নানান অসুবিধে হয় বলে শুনেছি। সেসব থাক। আজ তো ছমছমের দিন।

আমার ভাগ্যে একদিন পড়ল ওভারনাইট। নিতেই হল। বাধ্যবাধকতা। বাইশ বছরে প্রথম ওভারনাইট। এমনিতেই রেড রোড আর রাজভবনের নির্জনতা পেরিয়ে রাত ন’টার মধ্যেই অফিসে ঢুকে পড়লে সুবিধে হয়। যদিও ডিউটি শুরু রাত বারোটায়। কিন্তু দশটার আগেই ডিউটি অফিসার মিলিয়ে নেবেন মাঝরাত্তিরের পাহারাদার হাজির হয়ে গেছেন কিনা। সেইভাবেই আমিও গিয়ে ঢুকে পড়লাম আমার চেনা চত্বরে। এক ফ্লাস্ক গরম চা, খাবার, মিষ্টির বাক্স আর আমার সঙ্গী ল্যাপটপ। মাঝরাতে নাটক বাজাতে হবে একঘন্টার, তারপর এক ঘন্টা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, তারপর চলবে রাতজাগা গান। কথার সুযোগ প্রায় নেই। শুধু ঘড়ি মিলিয়ে খুঁজেপেতে বাজিয়ে দেওয়া।

সব ঠিকঠাকই চলছিল। রাত বারোটায় এফ এম গোল্ডে ‘জলসাঘর’ শেষ। এফ এম রেনবোতে শেষ হল ‘আজ রাতে’। বন্ধুরা সবাই বাড়ি চলে গেল টা-টা করে। ঘড়িতে ঠিক বারোটা। নাটক চালিয়ে বসলাম গুছিয়ে। কম্পিউটার আর ঘড়ি ছাড়া চারদিকে নীরবতা। ল্যাপটপ খুলে নিজের কাজ নিয়ে বসি। অদ্ভুত অস্বস্তি। কেবলই মনে হয়, আছে কেউ আশেপাশে। বাইরে। স্টুডিও চত্বরে কেউ যেন হাঁটছে চটি টেনে টেনে। তার পায়ের খসখস আওয়াজ। বিজ্ঞান আর অযৌক্তিক ভাবনায় ধাক্কাধাক্কি শুরু। নিশ্চয়ই ইঁদুর। মন সরিয়ে নিই। এমন সময় হঠাৎ নাটকটা বন্ধ হয়ে গেল। কম্পিউটার হ্যাং করে গেছে। এও আমাদের চিরকালীন পরিচিত সমস্যা। ব্যাকআপ থাকেই। একটা বন্ধ হলে তক্ষুনি আর একটা। শুধু মাথা ঠান্ডা করে চালিয়ে দেওয়া। মেশিন বলে কথা। এই প্রথম ঘটনাটা সামলাতে পারলাম না। ডানদিকের কম্পিউটারে ব্যাকআপ কিউ করা ছিল। নেই। সিডি প্লেয়ারে নাটকের সিডি চলতে থাকে। তাকিয়ে দেখি বন্ধ! অথচ আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমাদের পেশাদারি অভ্যেস, নাটকের ক্ষেত্রে সিডি আর কম্পিউটার চলবে একসঙ্গে। একটা মেশিন বাই চান্স বন্ধ হয়ে গেলেও লাইভ ট্রান্সমিশন বন্ধ হবে না। এবার? স্টুডিওর ঘড়িতে বারোটা চল্লিশ। আইন অনুযায়ী আরও কুড়ি মিনিট নাটক চলবে। রেডিওতে আমরা শিখেছি, এক সেকেন্ডের পজ এক ঘন্টার মতো মারাত্মক। ততক্ষণে কত সেকেন্ড গড়িয়ে গেছে কে জানে? এসির ঠান্ডাতেও ঘামছি এবার। সিডি প্লেয়ার অন করে যখন কিউ করছি নাটকের সিডি, ঠিক সেই সময় হ্যাং হয়ে যাওয়া কম্পিউটার চলতে শুরু করল। হঠাৎ। কিন্তু নাটকটা আবার শুরু থেকেই শুরু হয়েছে! কী ভয়ংকর! দিনের অন্য যে কোনও সময় এই ঘটনা ঘটলে ক্যাজুয়াল প্রেজেন্টারের সাসপেনশন অবধারিত। ডিউটি অফিসারের নোট আর প্রোগ্রাম একজিকিউটিভের নির্দেশ; তিনমাস আপনাকে বসিয়ে দেওয়া হল। ভাগ্যিস মাঝরাত। তাই কোনওক্রমে ধাতস্থ হই। সিডিতেও নাটক চলছে তখন। এদিকে কম্পিউটারে। একটু আশ্বস্ত। যাক, তবু কিছু তো একটা চলছে। এই এত রাতে ক’জন শ্রোতাই বা শুনছেন? হেলান দিয়ে বসি।

কিন্তু অস্বস্তির আরও বাকি ছিল।

নাটক কোনওক্রমে অর্ধেক শেষ করে ঠিক একটায় চালিয়েছি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। এবার আরও সতর্ক। অন্যমনস্ক হওয়ার কোনও অবকাশ নেই। ঠিক সেই সময় মনে হল স্টুডিওর দরজাটা কেউ খুলতে চেষ্টা করছে! অথচ স্টুডিওর নিরেট কাঠের দরজার ওপরে যেখানে এক টুকরো স্বচ্ছ গোল কাঁচ, সেখানে কেউ নেই তো! যে ঢুকতে চাইবে, তার মুখ বা মাথা বা শরীরের একটা আভাস থাকবেই। থাকতে বাধ্য। নিতান্তই কেউ লুকোচুরি খেলতে চাইলে আলাদা কথা। কিন্তু এই গভীর রাতে এফ এম স্টুডিওতে কেউ আমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে আসবেই বা কেন? তাহলে কে? স্টুডিওর দরজা লক ঘুরিয়ে খোলা যায় বাইরে থেকে। যে দরজা খুলতে চাইছে, সে খুলতে পারছে না! চেষ্টা করছে। চেয়ারে সেঁটে বসতে থাকি। এবার ভয়। ‘ভয়’ শব্দটার অভিঘাত কয়েক মুহূর্তের জন্য অনুভব করলাম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দরজা ঠেলে যিনি ঢুকলেন, তাঁর উচ্চতা ওই দরজার গোল কাঁচের ফুটোর ঠিক নিচে শেষ হয়। অতএব, তাঁর মূর্তি আমার চোখে কেন, কারও চোখেই ধরা পড়বে না। আমাদের ডিউটি অফিসার বিশ্বাসদা। অত্যন্ত বেঁটে এবং খুব বয়স্ক মানুষ। স্নেহপরায়ণ। ঘুমোতে যাওয়ার আগে তাঁর মনে হয়েছে, আহা মেয়েটা একা রয়েছে স্টুডিওতে। দেখেই আসি। তাই তিনি এলেন কুশল সংবাদ নিতে। ভয়ের কথাটা আর তাঁকে বললাম না; নাটক চলতে চলতে বন্ধ হওয়ার ঘটনাটাও না। কে সাধ করে ঝামেলা ঘাড়ে নেবে? চেপে যাওয়াই ভাল।

পরের ঘন্টাদুয়েক অস্বস্তি নিয়েই কাটল। বড় কিছু আর ঘটল না। রাত তিনটেয় চেঞ্জ ওভার। একটি ছেলে এসে এবার দায়িত্ব নেবে, আমার ছুটি। হিসেব মতো এই সময় আমরা গিয়ে একটি নির্দিষ্ট ঘরে শুতে পারি। রেস্ট রুম। কিন্তু, ওই যে! আমার দ্বারা এত জটিল কাজ করা অসম্ভব! কারণ, রেস্ট রুমের সামনেই একতলার জানালা। সেখান থেকেই কালো বেড়ালটা . . . অতএব স্টুডিওর বিরাট চত্বরের বাইরে এসে বসি। বাইরের বিশাল সদর দরজা বন্ধ। গ্রিলের গেটেও তালা। আমি চাইলেও গেটের বাইরে যেতে পারব না। সিকিউরিটি রয়েছে একেবারে মেন গেটের কাছে। বহু দূর। তার কাছেই গ্রিলের চাবি। আমার অবস্থা কলে পড়া ইঁদুরের মতো। চাইলেও অফিস থেকে বেরিয়ে গিয়ে ওলা বা উবর ধরে বাড়ি যেতে পারব না। হয় ফিরতে হবে স্টুডিওতে। না হলে ডিউটি রুমের বাইরের চেয়ারে। গ্রিলের ওপারে সাদা মার্বেলে বাঁধানো ঝকঝকে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। কাজের দিনে ওই সিঁড়ি আর এই ঘর সরগরম। অথচ, এখন প্রেতপুরী যেন!

আকাশবাণীর গাড়ির এক ড্রাইভার রাত ন’টাতেই আমাকে দেখে ডেকে বলেছিলেন, ‘রাত তিনটের পরে ডিউটিরুমের বাইরে এসে বসবে। সাউথেই আমার ডিউটি সকালে। তোমাকে তাহলে কিছুটা এগিয়ে দেব গাড়িতে’। তাঁর ভরসাতেই রাত সাড়ে তিনটেয় স্টুডিও বাইরে বসে আছি। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছি ওই সাদা ঘোরানো দোতলার সিঁড়িটার দিকে। প্রতি মুহূর্তে কানের কাছে কেউ বলছে, কেউ আসবে ভাবছ? কেউ নামবে ওই সিঁড়ি বেয়ে? একটা কালো কোট-টাই-প্যান্ট-বুট-পরা মূর্তির দেখা পেলে ভয় পেতাম কিনা তা’ জানি না, কিন্তু অবচেতনে একটা প্রচণ্ড প্রত্যাশা কাজ করছিল। যদি সে আসে!

ঠিক সেই সময় কালো বেড়ালটা এসে দাঁড়ায়। গ্রিলের বাইরে। ওর সবুজ চোখ জ্বলছে। নিরীহ দুবলা চেহারা। কিন্তু চোখদুটো কথা বলে। কেন জানিনা, ওকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। সমীহ, ভয় না অস্বস্তি . . . জানি না। ব্যাখ্যা নেই। ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে কতক্ষণ কেটেছিল মনে পড়ে না। ড্রাইভার আকিলদার গলা পেলাম দূরে। প্যাসেজ দিয়ে হেঁটে আসছে। গুনগুন গান। বেড়ালটা ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকায়, এক লাফে জানালা টপকে বাইরের অন্ধকারে।

কী বলতে চেয়েছিল, জানা হয়নি।