Categories
লোকশ্রুতির ঘাট |

আপ্পাজির বিচার

508 |
Share
| ১৯ অক্টোবর, ২০২০
নীতীন্দ্র রায়

১৮৯৬–১৯৬২। ভবানীপুর মিত্র ইনস্টিটিউশনের স্বনামধন্য শিক্ষক।

গ্রাফিক্স: কমলাকান্ত পাকড়াশী; রাজস্থানী পুতুলের ছবি, সৌজন্য: পিন্টারেস্ট

পাঠান সুলতান মোহাম্মদ তোঘলকের কুশাসনের ফলে বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণের রাজ্যগুলো পাঠানদের হাতছাড়া হয়ে যায়। সেই রাজ্যগুলো মিলে দুটো স্বাধীন রাজ্য গড়ে ওঠে। একটার নাম বাহমনী রাজ্য, আর অন্যটার নাম বিজয়নগর। এই বিজয়নগরের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন কৃষ্ণদেব রায়।

দিল্লির বাদশা একবার একই রকম আকারের, গড়নের ও রঙের তিনটে পুতুল বানিয়ে কৃষ্ণদেব রায়ের কাছে পাঠান। তিনি জানতে চান— ‘কোনটি প্রথম শ্রেণীর, কোনটি মধ্যম শ্রেণীর ও কোনটি অধম শ্রেণীর তা আপনি বিচার করে আমাকে জানাবেন’।

মহারাজ কৃষ্ণদেব রায় তাঁর পাত্র-মিত্র-অমাত্যদের নিয়ে সভা করে দিল্লির বাদশার প্রশ্নের কথা জানালেন। সভাসদরা সবাই পুতুল নিয়ে নেড়ে-চেড়ে পরখ করলেন। কিছুতেই একটুও তফাৎ ধরতে পারলেন না।

মন্ত্রী আপ্পাজি নীরবে বসে ছিলেন, একমাত্র তিনি পুতুল নিয়ে নাড়া-চাড়া করলেন না। তিনি পুতুল না ছুঁয়েই চিন্তা করতে লাগলেন। মহারাজ মন্ত্রীকে বললেন— ‘আপনি কেন পরীক্ষা করছেন না? আপনার বুদ্ধিতে এত বড় রাজ্য চলছে আর আপনি এ সমস্যার সমাধান করতে পারবেন না? দিল্লির কাছে আমরা হেরে যাব?’

আপ্পাজি বললেন— ‘মহারাজ, আমাকে একদিন সময় দিন, আমি এই তিনটে পুতুলকে এক রাত্রির জন্য বাড়ি নিয়ে যাব।’

মহারাজ বললেন— ‘এক রাত্রি কেন, আপনাকে সাত দিন সময় দিলাম।’

আপ্পাজি পুতুল তিনটে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখলেন। একটা পুতুলের দুটো কানেই ফুটো আছে আর অন্য দুটোর ফুটো আছে এক কানে। প্রথমটার কানের ফুটো দিয়ে তার চালিয়ে দেখলেন, তার অন্য কোনও দিক দিয়ে বার হল না। দ্বিতীয়টির কানে তার চালিয়ে দেখলেন, তার অন্য কানের ফুটো দিয়ে বার হয়ে গেল। তৃতীয়টার কানের ফুটো দিয়ে তার চালিয়ে দেখলেন তার পুতুলের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। আপ্পাজি এইভাবে তিনটি পুতুলের তফাৎ ধরে ফেললেন। এখন এই তফাতের সার্থকতা কী তিনি নিজে ভেবে তা বার করলেন।

পরদিন রাজসভায় এসে তার চালিয়ে তফাৎটা বুঝিয়ে দিলেন। তারপর বললেন— ‘মহারাজ, দিল্লির বাদশাকে লিখে পাঠান, যে পুতুলটার কানের ফুটো দিয়ে তার চালালে কোনও দিক দিয়ে বার হচ্ছে না, সেই পুতুলটিই উত্তম। এর দ্বারা উত্তম শ্রেণীর লোকেদের বোঝাচ্ছে। তারা কান দিয়ে যা কিছু শোনে, তা যেখানে সেখানে প্রকাশ করে না, নিজের মনেই রেখে দেয়। অতএব এ পুতুল হল উত্তম।

আর এই যে পুতুলটি দেখছেন, এটা যে শ্রেণীর লোকদের বোঝাচ্ছে তারা এক কান দিয়ে যা শোনে তা তাদের অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে যায়। তারা কিছুই মনে রাখে না। সব কথাতেই উদাসীন হয়ে থাকে। এদের দ্বারা কারও ক্ষতি হয় না। অতএব এই পুতুলটা হল মধ্যম।

আর এই যে পুতুলটা, এটাই হল অধম। এর কানের ফুটো দিয়ে তার চালিয়ে দেখা গেল তা মুখ দিয়ে বেরচ্ছে। যেসব লোক যা কিছু শোনে তা যে কোনও স্থানেই তা প্রকাশ করে ফেলতে পারে, তাদেরই বোঝাচ্ছে এই পুতুল। এই শ্রেণীর লোকের দ্বারা অনেকের অনিষ্ট হয়।’

আপ্পাজির এই ব্যাখ্যা দিল্লিতে পাঠানো হল। বাদশা আপ্পাজিকে প্রচুর ভেট সওগাদ পাঠালেন।

ঋণ: পুরাকথিকা। চলিত করেছেন ঝিলমিল বসু।