না না বাপু আমি কিন্তু একা থাকতে মোটেই ভালবাসি না! কোনও উপায় নেই তাই অগত্যা এই বিদেশ বিভুঁইয়ে একা থাকতে বাধ্য হচ্ছি আর এই প্যান্ডেমিক তো আমার জীবনের সব সুখ, শান্তি, ঘুরতে যাওয়া সব কেড়ে নিল! আচ্ছা বল তো এরকম তোমাদের হয় কি না? যখন বাড়িতে একলা থাকো, অথচ দেখতে পাও যে তোমাদের কোনও কাজ নেই, কারোর সঙ্গে কথা বলার নেই, ঠিক সেই সময়েই যেন খিদে পায়? মনে হয় ‘যাই দেখি তো ফ্রিজে কিছু মিষ্টি আছে কি না? মিষ্টি না থাকলেও— চানাচুর, ডালমুট, বিস্কুট— এগুলো তো রান্নাঘরেই পাওয়া যাবে! আবার এর সাথে চিপস থাকলে তো সোনায় সোহাগা’। তখন যেন মনে হয় ‘আহা . . . এই অমূল্য জীবনটা যেন শুধু খাওয়ারই জন্য’! আমার মনে হয় জীবনের ব্যস্ততা কমতে থাকলে, বা একাকীত্ব বাড়তে থাকলে সবার আগে এই খাবার কথাই মাথায় আসে।
একটি ক্ষুধার্ত মস্তিষ্ক যেমন খাদ্য কামনা করে, ঠিক তেমনই একাকী মস্তিষ্ক চায় মনের মতো মানুষজন বা বন্ধু যাদের সাথে কথা বলা যায়, হাসি ঠাট্টা বা ঝগড়া করা যায়। মস্তিষ্ক সম্পর্কে একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং ক্ষুধার্ত মস্তিষ্ক একইভাবে মস্তিষ্কের দুটি অঞ্চলকে প্রভাবিত করে। সেই অঞ্চল দুটির নাম সাবস্টেনসিয়া নায়াগ্রা (substantia nigra) এবং ভেন্ট্রাল ট্যাগমেন্টাল (ventral tegmental area) (SN/VTA)। একজন সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন মানুষের এবং একটি ক্ষুধার্ত মানুষের মস্তিষ্ক কীভাবে প্রভাবিত হয় তা নির্ধারণ করতে, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি, কেমব্রিজের বিজ্ঞানী তোমোভা ও তাঁর দল ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সী ৪০ জন স্বাস্থ্যকর, সামাজিকভাবে-যুক্ত একটি তরুণ-প্রাপ্তবয়স্কদের দল গঠন করলেন।
প্রতিটি অংশগ্রহণকারীকে ১০ ঘন্টায় দুটি ভিন্ন ধরণের পরিস্থিতির সম্মুখীন করা হয়। প্রথমটিতে, তাদের সমস্তরকম সামাজিক যোগাযোগ বন্ধ করার নির্দেশ দিয়ে দেওয়া হয়। তার মানে হল, তারা কোনও ফোন, সোশ্যাল মিডিয়া বা মুখোমুখি কারোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে না। দ্বিতীয়টিতে, তাদের ক্যালোরি যুক্ত খাবার বা পানীয় থেকে বঞ্চিত করা হয়। সোজা কথায় বলতে গেলে ১০ ঘন্টার উপোস করতে বলা হয় তবে সেটা নির্জলা নয়। কারণ শুধু জল তারা পান করতেই পারে, তবে ক্যালোরি-যুক্ত-জল (সফ্ট ড্রিঙ্কস) না হলেই চলবে।
এবারে, প্রত্যেকটি সেশনের পরে, অংশগ্রহণকারীদের সামাজিক কার্যকলাপের দরুণ প্রভাবিত মস্তিষ্কের অঞ্চলগুলির একটি চিত্র FMRI (এফএমআরআই) মেশিন ব্যবহার করে স্ক্যান করা হয়। অবিশ্বাস্যভাবে দেখা গেল যে, প্রথম পরীক্ষাটির শেষে অংশগ্রহণকারীরা ভীষণভাবে একাকীত্বে ভুগছে, এটা জেনেও যে তারা এই পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র ১০ ঘন্টার জন্য ছিল। তারা সবাই প্রচণ্ডভাবে একটা সামাজিক যোগাযোগ স্থাপন করতে চাইছে। এটাও বোঝা গেল, তারা সোশ্যাল মিডিয়াতে মানুষের ছবি দেখছে, তাদের কাছের মানুষদের সাথে কাটানো সময়ের ভিডিওগুলি বারংবার দেখছে। ঠিক এরকমভাবেই দ্বিতীয় পরীক্ষাটির শেষে দেখা গেল যে, অংশগ্রহণকারীদের ভেতর ক্ষুধা এবং তৃষ্ণা স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে গেছে এবং এটাও দেখা গেল যে তারা খাবারের ছবি বেশি করে দেখছে। সব থেকে আশ্চর্য বিষয়টি হল এই দুটি ভিন্ন রকমের পরীক্ষা কিন্তু তাদের মধ্য-মস্তিষ্কের একই অঞ্চলগুলিকে (সাবস্টেনসিয়া নায়াগ্রা এবং ভেন্ট্রাল টিগমেন্টাল) প্রভাবিত করল।
তাহলে এই পরীক্ষামূলক পদ্ধতিটি এটা প্রমাণ করল যে, ক্ষুধা বা তৃষ্ণার সাথে সাথে অন্য মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করা বা socialize করা হল মানুষের অন্যতম মৌলিক প্রয়োজন। আরেকটি গবেষণায় এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে একাকীত্ব আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কমায়, এমনকি স্থূলত্ব, ডায়াবেটিস, ডিমেনশিয়া এবং বিভিন্নরকম মানসিক অসুস্থতার অন্যতম একটি কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নিঃসঙ্গতা কীভাবে স্থূলতার সাথে যুক্ত, তার সঠিক কারণ এবং প্রভাব এখনও পুরোপুরিভাবে অজানা।
তার মানে তোমরা এটা বুঝতে পারলে যে আমাদের কাছের মানুষেরা (মা, বাবা, দাদু, দিদা) যাঁরা একা থাকতে বাধ্য হচ্ছেন, তাঁদের কাছে সবচেয়ে বড় এবং কঠিনতম অসুখ হলো একাকীত্ব। তোমরা হয়তো খেয়াল করে থাকবে, তোমাদের দাদু বা দিদিমাদের কথা বলার ইচ্ছা যেন কাছের মানুষ দেখলেই বেড়ে যায়। শুধু তাই নয়, তাঁরা যখন বাড়ির মানুষকে কাছে পান না, তখন স্বল্পপরিচিত বা পাড়া-প্রতিবেশীদের সাথেও গল্প জুড়ে দেন। এটার একমাত্র কারণ হল তাঁদের দীর্ঘদিনের একাকীত্ব অন্য মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করা বা socialize করার ইচ্ছেকে প্রবলভাবে বাড়িয়ে দেয়।
এখন তোমাদের এটা নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করছে যে আমাদের মস্তিকের এই দুটি অঞ্চল কীভাবে আমাদের ভেতর ক্ষুধা (craving for food) বা অন্য মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করার (social interactions) ইচ্ছেকে নিয়ন্ত্রণ করে। আসলে ‘Reward circuit’ মানে, কিছু পাওয়ার ইচ্ছে বা পরিতৃপ্ত হওয়ার ইচ্ছের পদ্ধতিটি আমাদের মধ্য-মস্তিষ্কের অর্থাৎ ‘Mid Brain’-এর সাবস্টেনসিয়া নায়াগ্রা এবং ভেন্ট্রাল ট্যাগমেন্টাল (এসএন/ভিটিএ) অঞ্চলের ডোপামিনার্জিক (Dopaminergic) নিউরোন বা স্নায়ুকোষের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
একজন নেশাখোর বা ড্রাগ অ্যাডিক্ট ব্যাক্তির ক্ষেত্রেও কিন্তু ঠিক একইভাবে এই অঞ্চলগুলোই উজ্জীবিত বা প্রভাবিত হয়। তাহলে, মোদ্দা কথা হল, এই যে একা থাকা এবং একা থাকার সাথে সাথে বিভিন্নরকমের অসুখের (স্থূলতা থেকে শুরু করে মানসিক ব্যাধি) সম্মুখীন হওয়া মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তবুও দেখো, আমরা কিন্তু যত বড় হচ্ছি ততই যেন একা হয়ে যাচ্ছি। আর এই করোনা ভাইরাস তো আরোই যেন সবাইকে ঘরবন্দী করে একাকীত্বের দেশে জোর করে পাঠিয়ে দিল। আশা রাখি খুব তাড়াতাড়ি এই ভীষণরকম একাকীত্ব থেকে সবাই মুক্তি পাবে, তবে সময়ের নিয়মে যে একাকীত্ব বা নিঃসঙ্গতা আসবে সেটাকে কিন্তু আমাদের নিজেকেই কাটাতে জানতে হবে।
ঋণ : ১। Richard A, Rohrmann S, Vandeleur CL, Schmid M, Barth J, Eichholzer M. Loneliness is adversely associated with physical and mental health and lifestyle factors: Results from a Swiss national survey. PLoS One. 2017;12(7):e0181442. Published 2017 Jul 17. doi:10.1371/journal.pone.0181442 ২। Tomova, L., Wang, K.L., Thompson, T. et al. Acute social isolation evokes midbrain craving responses similar to hunger. Nat Neurosci 23, 1597–1605 (2020)