Categories
মানুষপাহাড় |

এক অরণ্যদেবের কাহিনি

1014 |
Share
| ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০
শাম্মী আরা হুদা

সাংবাদিক

চিত্র সৌজন্য: ঊষা রাই; ফিন্যানশিয়াল এক্সপ্রেস; mridula.org গ্রাফিক্স: কমলাকান্ত পাকড়াশী

মহামারি করোনা-ভাইরাসের প্রকোপে গোটা মানবজাতি একটা সংকটের মধ্যে দিয়ে চলেছে। যতদিন না সঠিক প্রতিষেধক আসছে, ততদিন এই মারণ রোগ থেকে আমাদের মুক্তি নেই। তবুও জীবনের প্রতি আমাদের সবাইকেই ইতিবাচক থাকতে হবে। কী বলো ছোট বন্ধুরা? বাড়িতে থেকে কোভিড সংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। ঘরবন্দি হয়ে থাকতে বিরক্ত লাগলে মাঝে মাঝে গাছ লাগাতে পারো। সে ছাদ বাগানের টবেই হোক বা মাটিতে। গাছ আমাদের খুব বড় বন্ধু— যার অকৃপণ দানে আমরা প্রাণভরে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ পাই। আজ তোমাদের এমনই একজনের গল্প বলব যিনি ধু-ধু বালির চরে গাছ লাগিয়ে একটা মস্ত বড় অভয়ারণ্য তৈরি করে ফেলেছেন। যেখানে এখন শুধু গাছ নয়, পাখি, হাতি, গন্ডার সবই চরে বেড়ায়।

শুনতে খুব অবাক লাগছে? গল্প হলেও এ কিন্তু সত্যি ঘটনা। তখন কতই বা বয়স হবে যাদব পায়েং-এর। ওহ তোমাদের সঙ্গে তো আলাপ করাতেই ভুলে গেছি। ভারতের উত্তর পূর্বের সবুজে ঘেরা রাজ্য অসমের ব্রহ্মপুত্র-নদ-লাগোয়া মাজুলি দ্বীপে যাদবের বাড়ি। ১৩ ভাইবোনের সংসার। তবে পড়াশোনার জন্য তাকে বাড়ি ছেড়ে যেতে হয়েছিল মফঃস্বল শহর যোরহাটে। সেখানকার বালিগাঁও আর্য বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল যাদব। টানা দশবছর বাবা-মা, ভাইবোনকে ছেড়ে সেখানেই পড়াশোনা করল। ক্লাস টেনের পরীক্ষার পর এক গরমকালের দুপুরে যোরহাট থেকে মাজুলি দ্বীপের বাড়িতে ফিরছে সে। বাবা-মা মারা গেছেন। ভাইবোনদের দেখতে হবে। আর পড়াশোনা করার সুযোগ নেই। বৈশাখের গরমে ব্রহ্মপুত্রের বালির চরে যাদবের আর পা চলে না। গলা শুকিয়ে আসছে। একটা গাছও নেই যে তার তলায় বসে একটু জিরিয়ে নেবে।

আর চলতে না পেরে গরম বালিতেই বসে পড়ল যাদব। দেখল চরে কোনও গরু চরছে না। গরমের হাত থেকে বাঁচতে সবাই ব্রহ্মপুত্রের জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বালির মধ্যে মরে কাঠ হয়ে গেছে সাপ। চারদিক শুধু ধু-ধু করছে। যাদব যেখানে বসেছিল, ওই জায়গার নাম অরুণা সাপোরি। ওই চরে যাদবদের গরু মহিষের খামার রয়েছে। বাবা-মা সেখানেই কাজ করতেন। দিন ফুরোলে তাঁরা মাজুলি দ্বীপের বাড়িতে ফিরে যেতেন। যাদবের পূর্বপুরুষরা একটা সময় এখানেই থাকতেন। সে যাইহোক, ছেলেবেলায় বাবা-মার হাত ধরে খামারে আসত যাদব। তখন দেখেছে কত্ত গাছ, সারাদিন পাখি কিচিরমিচির করছে। জঙ্গলের এদিক সেদিক সাপ ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর আজ সেখানে একটাও গাছ নেই? যাদবের মন খারাপ হয়ে যায়। হবেই তো বলো, আমরা সকলেই জানি গাছ আমাদের অক্সিজেন দিয়ে ছায়া দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে। গাছের শিকড়ে ভূমিক্ষয় রোধ হয়। প্রকৃতির ভারসাম্য ধরে রাখে গাছ। এই তো মাস কয়েক আগে কী ভয়ানক ঘূর্ণিঝড় হল আমাদের রাজ্যে। কলকাতায় কত্ত গাছ পড়ে গেল। আমাদের অক্সিজেনের পরিমাণও কমে গেল। তোমাদের কারও কারও বাড়িতে নিশ্চয় গাছ ভেঙেছে।

চলো গল্পে ফেরা যাক, যাদব তো গাছ ভালবাসে। অরুণা সাপোরির বালির চর দেখে সে তখন খামারের বাকি লোকজনদের জিজ্ঞাসা করল। সবাই যাদবকে বলল, গাছ নিয়ে না ভেবে গরু-মহিষের যত্ন নিতে। সেদিন গ্রামের এক বৃদ্ধ যাদবকে দেখে খুশি হয়েছিলেন। তার হাতে ৫০টি বীজ ও ২৫টি বাঁশ গাছের চারা গুঁজে দিয়ে বলেছিলেন, বীজ পুঁতলেই গাছ হবে। বৃষ্টি আসবে, ঘাস গজাবে, জমি উর্বর হবে। গরু মহিষের চারণক্ষেত্র তৈরি হবে। জঙ্গলে পাখি আসবে, পাখির ডিমের লোভে আসবে সাপ। একে একে অন্যান্য বন্যপ্রাণও। ফের জীববৈচিত্রে ভরে উঠবে অরুণা সাপোরির দ্বীপ।

ভাইবোনকে বড় করতে খামারের কাজে লেগে পড়ল কিশোর যাদব পায়েং। তবে গাছ লাগানোর কথা ভুলল না। ওই বৃদ্ধের দেওয়া বীজ ও বাঁশ গাছের চারা তো পুঁতল। পাশাপাশি নিজেই আশপাশের গ্রাম থেকে বাঁশ, বহেরা, সেগুন, গাম্ভরি, কাস্টার্ড আপেল, তারাফল, গুলমোহর, ডেভিলস ট্রি, তেঁতুল, তুঁত, কাঁঠাল, কুল, জাম, কলাগাছ নিয়ে এসে ওই চরে পুঁততে থাকল। একবার নয়, প্রতিবছর নিয়ম করে যাদব গাছ লাগাত, বীজ ছড়াত। গ্রামের অন্য বাসিন্দারা যাদবের এই কাজ দেখে প্রশংসা করা তো দূরের কথা রীতিমতো ঠাট্টা তামাশা করত। যাদব সেসব দিকে তেমন কান দিত না। একটা সময় পর সেই গাছের চারা বড় হল। সেবার ব্রহ্মপুত্রের চরে বন্যা হল, বেশিরভাগ গাছ নষ্ট হয়ে গেলেও যাদব কিন্তু হাল ছাড়েনি। গাছ পুঁতে গিয়েছে নিয়ম করে। দিনের পর দিন মাসের পর মাস যাদবের এই পরিশ্রম বৃথা যায়নি। সেদিনের ধু-ধু ব্রহ্মপুত্রের চর ৪০ বছরের প্রচেষ্টায় এখন ১৩৬০ একরের অভয়ারণ্য। ওই জায়গার নাম হয়েছে কাঠনিবাড়ি। আর কাঠনিবাড়ির অরণ্যদেব হলেন যাদব পায়েং। হ্যাঁ, যাদব এখন অনেক বড়, তাঁর বয়স বেড়েছে। গ্রামের বাসিন্দারা যাদব পায়েংকে দেখলে খুশি হয়, আদর করে তাঁকে মোলাই বলে। অহমিয়া ভাষায় মোলাই কথার অর্থ, অরণ্যদেব।

গ্রামের বয়স্ক বাসিন্দাদের কথায় বিয়েও করেছেন তিনি। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য যোরহাটেই থাকতে হয়। তবে প্রতিদিন ভোরবেলা নিয়ম করে চলে আসেন কাঠনিবাড়ির জঙ্গলে। খামারের কাজ করেন নিজের হাতে। গাছের দেখাশোনা করেন। ওই জঙ্গলে বাঘ রয়েছে। মাঝে মাঝে খামারে গরু-মহিষও তুলে নিয়ে গেলে প্রতিবেশীরা যাদবের ওপরে রেগে যায়। যাদব কিন্তু তাতে দমেন না, নিজের খামারের গরু-মহিষকেও বাঘে টেনে নিয়ে গিয়েছে। তাতে কী, এটাই তো বাস্তুতন্ত্রের ধর্ম। মাজুলি দ্বীপ ছেড়ে কাজিরাঙায় ফেরার পথে প্রতিবছর হাতির পাল কাঠনিবাড়ির জঙ্গলে কয়েকটা দিন কাটিয়ে যায়। জঙ্গলজুড়ে বিভিন্ন ধরনের সাপ রয়েছে। হাজারো পাখির কিচিরমিচিরে যাদবের মন ভাল হয়ে যায়। ভোরবেলা একা-একাই গাছের ডাল হাতে নিয়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ান যাদব পায়েং। না সাপের ভয় নয়, চোরাশিকারিরা ওঁত পেতে রয়েছে, তাঁকে খুনের হুমকিও দিয়েছে। তবুও নির্ভয়ে কাঠনিবাড়ির জঙ্গলকে পাহারা দিয়ে চলেছেন যাদব পায়েং।

এত ভয়ের মধ্যেও এল সম্মান। ২০১২ সালের আর্থ ডে-র দিন তাঁর কাজের স্বীকৃতি পেলেন যাদব পায়েং। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘ফরেস্ট ম্যান অফ ইন্ডিয়া’র শিরোপা দিল। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ডক্টর এপিজে আব্দুল কালাম এই অভাবনীয় উদ্যোগের জন্য যাদব পায়েংকে আর্থিকভাবে পুরস্কৃত করলেন। ওই বছরই ভারতের অরণ্যদেব রাষ্ট্রসঙ্ঘের আমন্ত্রণে রীতিমতো বিমানে চেপে প্যারিস পাড়ি দিলেন। সাহেবদের সঙ্গে আলাপ হবে, তাই সারাজীবন খালি পায়ে লুঙ্গির উপরে কোমরে গামছা বেঁধে কাটিয়ে দেওয়া মানুষটা সেবার জুতো কিনেছিলেন। গোটা বিশ্ব দেখল গ্রামীণ ভারতের এক প্রতিনিধি কীভাবে আলোর পথ দেখাচ্ছেন। ঝাঁ-চকচকে পশ্চিমী দুনিয়া দেখে এসে যাদব পায়েং মনে করেন মাজুলি থেকে শুরু করে গোটা ব্রহ্মপুত্রের চরের জীববৈচিত্র অভাবনীয়।