পুটুসের এখন স্কুল বন্ধ। শুধু ওর কেন, ওর মা’রও বন্ধ। কিন্তু, তাতে কি একটু শান্তিতে ঘুমোনোর জো আছে? আগে সূয্যি উঠতে না উঠতেই মা বলত, পুট পুট পুটাই, উঠে পড়, স্কুলে যাই। আর এখন একটু বেলা হলেই দাদাই নাকের ডগায় সুড়সুড়ি দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে বলবে, বেলা হল, চোখ মেল, মহারানি ওঠো রে। বাবাই আর ঠাম্মু তখন হাসবে। কী বিচ্ছিরি, কী বিচ্ছিরি!
তা, সেদিন হয়েছে কী, বিকালে মা আলুকাবলি বানিয়ে খাওয়াবে এই কড়ারে পুটুস নাক টিপে এক গ্লাস দুধ আর দুটো বিস্কুট খেয়ে দাদাইয়ের কাছে ইংরাজি পড়ে সবে অঙ্কের বই আর খাতা বের করেছে, অমনি মা’র গলা জোরে শোনা গেল। তার আগে অবশ্য মা আর ঠাম্মু ফোনে যেন কার সাথে কথা বলছিল। মা যখন জোরে কথা বলছে তখন মনে হয় বড়সড় কোন ঝামেলা হয়েছে। কারণ, এমনিতে মা খুব ঠান্ডা আর হাসিখুশি। ঠাম্মু বলে, তিতলি, তুই রেগে গেলেই আমার ভয় হয়। মনে হয়, এই বুঝি মা কালীর মতো হাতে খাঁড়া নিয়ে রাক্ষস মারতে শুরু করবি।
দাদাই বলল, মহারানি, তুমি অঙ্ক দু’টো কর, আমি দেখি কী হল। বলেই দাদাই বেরিয়ে গেল। পুটুসের কি আর তখন একা ঘরে অঙ্ক করতে ভাল লাগে? ঘর থেকে বেরতে বেরতে পুটুস শুনল দাদাই বলছে, কী হয়েছে রে তিতলি? এর মধ্যে অফিসের জন্য বেরনোর সময় বাবাইও এসে দাঁড়িয়েছে। পুটুসকে দেখে ওরা সবাই ইংরাজিতে কথা বলা শুরু করল। কী সব কঠিন কঠিন কথা! পুটুস তো মাত্র স্ট্যান্ডার্ড ওয়ানে পড়ে। এত কঠিন কঠিন ইংরাজি ওর মাথায় ঢোকে! সবাই পচা। মা, ঠাম্মু, দাদাই, বাবাই সব।
পুটুস শুনল, মা বলছে, আরে, ওকে বললাম, সিম্পটমগুলো ভাল না, ইমিডিয়েট হাসপাতালে নিয়ে যাও! শুনেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল, যা তা বলতে শুরু করল। পুটুস এই প্রথম শুনল কথাটা। তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠা। তেলের মধ্যে বেগুন দিলেই জ্বলে উঠবে? আরিব্বাস, কী মজা! লাইটার জ্বালাতে হবে না, এমনিই জ্বলে উঠবে! দেখতে হবে তো!
সবাই নিজেদের মধ্যে কথা বলছে আর পুটুস চলে এল রান্নাঘরে। খুঁজে খুঁজে তেলের বোতল, একটা কড়াই আর ফ্রিজ থেকে বেগুন বার করল। কড়াইয়ে অনেকটা তেল ঢেলে তার মধ্যে বেগুনটা চুবিয়ে দিল। জ্বলল না। তিতলি বার বার বেগুনটাকে ঠেসে ঠেসে তেলের মধ্যে ডুবাতে লাগল, কিন্তু, তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল না। শুধু, ওর হাতটাই তেলতেলে হয়ে গেল। হঠাৎ রান্নাঘরে মা ঢুকে বলল, তুই কী করছিস এখানে? পুটুস তখন ভয়ে জড়সড়।
এরপর পুটুসের কী হল, সে গল্প না হয় আর একদিন করা যাবে।
আসলে, কিছু কথা আছে যেগুলোর আসল মানে অন্যরকম। এগুলো যেকোনও ভাষার সাহিত্যে অন্যরকম অর্থ আর ব্যঞ্জনা নিয়ে আসে। ব্যাকরণ এগুলোকে বাগধারা বলে, প্রবাদ বলে, প্রবচন বলে। ইংরাজিতে Idiom বলে, Proverb বলে। অবশ্য, বাংলায় যেমন বাগধারা আর প্রবচন হুবহু এক নয়, ইংরাজির Idiom আর Proverb-এর ক্ষেত্রে সেই একই কথা। কিন্তু, মানুষ যখন তার প্রতিদিনের জীবনযাপনের ভাষায় এগুলো ব্যবহার করেন, তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবেই করেন। সেটাই তো স্বাভাবিক। কারণ, এগুলো তো তার অনাদি অনন্তকালের জীবনচর্চার মূল্যবান সম্পদ।
জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের অভিধানে দেখছি, বাগধারা মানে কথা বলার বিশেষ প্রণালী বা ভাষাভঙ্গি। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শব্দকোষে পাচ্ছি, প্রবাদ মানে প্রসিদ্ধ লোকবাদ; কিংবদন্তি; জনশ্রুতি। আবার, ওদিকে ইংরাজি Idiom এসেছে ল্যাতিন Idios থেকে, যার মানে Peculiar, অর্থাৎ, অদ্ভুত। শব্দের আক্ষরিক অর্থ এখানে গৌণ, লুকিয়ে থাকা অর্থটাই মুখ্য। এগুলো পড়তে পড়তে আরও মনে হয়েছে, অনুভূতির বাক প্রকাশ কোনও দেশের, কোনও গোষ্ঠীর, কোনও ভাষার একচেটিয়া অধিকার নয়। Idiom বা Proverb পড়তে গিয়ে আমাদের যেমন মনে হয়, আরে, আমরা তো এটাকে এই বলি, ঠিক সেরকম আমাদের বাগধারা বা প্রবাদ শুনলে ওদেরও মনে হয়, আমাদের ভাষায় তো এটা এই।
১
ইংরাজিতে বলে, ‘Add insult to injury’, যার মানে, খারাপ অবস্থাকে আরও খারাপ করে তোলা। এর উৎপত্তি ঈশপের গল্পে।
একবার এক টাকমাথা লোকের টাকে বসেছিল এক মাছি। তিনি মাছিটা মারতে গেলেন। মাছি তো গেল উড়ে আর মারটা পড়ল তার মাথায়। লোকটা যখন যন্ত্রণায় কুঁকড়াচ্ছে, মাছি তখন হাসছে আর বলছে, আমাকে মারতে গিয়েছিলে তো। কিন্তু, চাঁটি পড়ল তোমার মাথায়। এবার কী করবে? একে তো বেচারির টাকে ব্যথা, তার ওপর আবার এই অপমান!
রোমান লেখক Phaedrus (ফিড্রাস, ১৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৫০ খ্রিষ্টাব্দ) প্রথম এটা লিপিবদ্ধ করেন। তবে, এই কথাটা Idiom হিসাবে কবে থেকে ব্যবহৃত হতে শুরু হল, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। ১৭৪৭ সালে ব্রিটিশ লেখক Edward Moore-এর নাটক ‘The Fondling’-এ এর প্রথম সাহিত্যিক প্রয়োগ দেখা যায়। উদাহরণ—‘When Ram failed to do the job, his friends made joke of him. That added insult to his injury’।
বাংলায়, এরকম অবস্থাকে আমরা বলি, ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে’। যেমন, ‘একে তো রাম বেচারি কাজটা করতে পারল না, তার ওপর ওর বন্ধুরা আবার ওকে নিয়ে মজা করতে শুরু করল। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে আর কাকে বলে!’
২
বাংলায় যাকে বলি ‘দায়সারা ভাবে কাজ সারা’, ইংরাজিতে সেটাই ‘A lick and a promise’। কোনও কাজ যখন তাড়াতাড়ি যত্নহীন ভাবে, আধা-খ্যাঁচড়া ভাবে করা হয়, সেই কাজই দায়সারা।‘Promise’-এর ভিতর এই প্রতিশ্রুতি আছে যে কাজটা সে ঠিকঠাক করবে। কিন্তু, ‘Lick’ শব্দের মানে খুব তাড়াতাড়ি ধোওয়া। কাজেই, খুব তাড়াতাড়ি ধুতে গেলে কাজটা দায়সারা বা আধা-খ্যাঁচড়া তো হবেই।
মজা হল, এই Idiom-টা আগে ছিল ‘A lick and a prayer’। বাংলায় আবার সেটা ‘হরির নাম খাবলা খাবলা’। যাই হোক, পুরোনো Idiom-টাকে পিছনে ঠেলে দিয়ে তার জায়গা করে নিয়েছে ‘A lick and a promise’। তা এই নতুনটারও বয়স নয় নয় করে দু’শো বছর হল।
এর প্রথম উল্লেখ দেখা যায় ‘Critical Review of the Anals of Literature’-এ। পরবর্তী উল্লেখযোগ্য প্রয়োগ দেখা যায় ১৮৪৫ সালে Elizabeth Acton-এর ‘The Modern Cook’-এ, ১৮৪৮ সালের মার্চ মাসে ইংরাজি সংবাদপত্র ‘The Era’-তে, ১৮৬০ সালে Walter White-এর লেখা ‘All Round the Wrekin’ গ্রন্থে। উদাহরণ—‘At about 5.30 p.m. his boss asked him to draft a letter. Unwillingly he gave the job a lick and a promise/prayer and left office.’
বাংলায় বলব, ‘বিকাল প্রায় সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ওর বস ওকে একটা চিঠি লিখতে বলল। অনিচ্ছায় ও দায়সারা ভাবে কাজটা সেরে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ল।’
‘যে কাজটা করছ সেটা মন দিয়ে কর। হরির নাম খাবলা খাবলা করলে তোমারও ভাল লাগবে না, কাজটাও হবে না।’
৩
‘All ears’— এটা ব্যবহার করা হয় পুরো মনোযোগ দিয়ে, অন্য কোনওদিকে মন না দিয়ে একমনে শোনা অর্থে। শোনাটা এতই মনোযোগ দিয়ে যে তখন দুনিয়া রসাতলে গেলেও মনটা পড়ে থাকে শোনার দিকেই। Idiom হিসাবে এর পথচলা শুরু অষ্টাদশ শতকে। উদাহরণ—‘Rina was all ears to her teacher’s evaluation on her answer to the question.’
বাংলায় একে বলে ‘কান খাড়া করে শোনা’। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘স্বপ্নে দেখা ঘরদুয়ার’ কবিতায় এর খুব সুন্দর প্রয়োগ দেখা যায়, ‘বেড়ালটা আড়মোড়া ভাঙছে, কুকুরটা কান খাড়া/করে শুনছে কথা বলছে কারা।’
আরে, এতক্ষণ কেটে গেল! আমি তো খেয়ালই করিনি। পরে আবার কথা হবে। হ্যাঁ, এই বাগধারা নিয়েই।