Categories
ভাষাপুকুর |

কথার মধ্যে কথা । ৩।

555 |
Share
| ১৭ ডিসেম্বর, ২০২০
স্মরজিৎ চৌধুরী

ভাষাচর্চা ও লেখালিখিতেই তাঁর আনন্দ, প্রাক্তন সরকারি কর্মচারী

গ্রাফিক্স: কমলাকান্ত পাকড়াশী

সেদিন বিলুদের বাড়িতে যাচ্ছেতাই কাণ্ড। বিলু বেচারি মার খেতে খেতে বেঁচে গেছিল। ভাগ্যিস জ্যাম্মা ওকে আগলে রেখেছিল। নইলে বাবা ওকে মেরে পাট পাট করে দিত। আর, মা তো এখনও মাঝেমাঝেই ওর দিকে কেমন করে তাকায়। বিলুর খুব কষ্ট হয় তখন। মা’র পেছনে ঘুরঘুর করে। তারপর মা’ই ওকে কাছে টেনে নেয়, বলে, মানে না বুঝে কথা বলতে নেই, বাবা। বিলুর খুব কান্না আসে তখন। কথাটা তো সেদিন সবাই শুনেছিল, হেসেও ছিল। বিলুরও খুব ভাল লেগেছিল কথাটা, মনে ধরে গিয়েছিল। কিন্তু, কেউ তো ওকে কথাটার মানে বুঝিয়ে দেয়নি। ক্লাস টুতে পড়ে কি এত কিছু জানা যায়! তার ওপর এখনও তো স্কুল খোলেইনি। স্কুল খোলা থাকলে না হয় অন্তু, অপা, পাপড়িদের কাছে কথাটার মানে জানতে চাইতে পারত। ওরাই তো ওর বেস্ট ফ্রেন্ড।

তা, সেদিন হয়েছিল কী, বিলু জেজুকে এঁচোড়ে পাকা বলেছিল। তার আগের দিন টিভিতে কী একটা সিরিয়াল হচ্ছিল, তাতে ওরই মতো একটা বাচ্চা মেয়েকে একজন বুড়োবুড়ো মানুষ এঁচোড়ে পাকা বলছিল। টিভি দেখতে দেখতে জ্যাম্মা, মা, জেজুও হাসছিল। সেই লোকটা আবার ওই মেয়েটাকে কোলে নিয়ে আদরও করছিল। বিলু ভেবেছিল, কথাটা বেশ মজার, বললে সবাই হাসবে। তাই, সেদিন বেলায় বাজার থেকে জেজু যখন অনেক মৌরলা মাছ না পরিষ্কার করিয়ে কিনে এনেছিল, মা চুপচাপ মাছগুলো জলের তলায় ঘষছিল, জ্যাম্মা জেজুকে গজগজ করে কী সব বলছিল, তখনই বিলু জেজুকে বলেছিল, তুমি একটা এঁচোড়ে পাকা। ভেবেছিল, সবাই খুব মজা পাবে, হাসবে। কিন্তু, এমন যে হবে, তা ও ভাবতেই পারেনি। জেজুর মুখটা কেমন যেন হয়ে গেল। মা মাছ ধুতে ধুতেই উঠে এসে ওর গালে একটা চড় মারল, বাবা দৌড়ে এল, জ্যাম্মাও এল। বাবা তো ওকে আড়ং ধোলাই দেবেই। জ্যাম্মা বলল, দাঁড়া, কেউ হাত তুলবি না ওর গায়। তারপর বিলুকে কাছে টেনে বলল, বিলু, কথাটা বললি কেন? কোথায় শুনেছিস কথাটা?

বাবা তখনও ওর দিকে তেড়ে তেড়ে আসছিল। জ্যাম্মা বড় বড় চোখ করে বাবাকে বলল, ন্যাড়া, আমি কী বলেছি, শুনতে পাসনি? তারপর বিলুকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমাকে বল তো বাবা, কোথায় শুনেছিস কথাটা? ভয় নেই, কেউ তোকে মারবে না।

জ্যাম্মার আদরে বিলু ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল, বলল, কাল টিভিতে যখন ওই বুড়ো লোকটা ওই মেয়েটাকে এঁচোড়ে পাকা বলছিল, তখন তো তোমরা খুব হাসছিলে। আর, আমার বেলায় যত দোষ। মা আমাকে মারল।

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল বিলু। জেজু হো হো করে হাসতে লাগল। জ্যাম্মা জেজুকে বলল, তুমি চুপ কর। তোমার জন্যই এতসব হল। সকাল আটটায় বাজার করতে বেরিয়ে বেলা সাড়ে দশটায় বাড়ি ফিরেছ। আবার হাসছ? এখন বিলুকে কথাটার মানে বোঝাবে তুমি। এটাই তোমার শাস্তি।

বুঁচকিদি বলে উঠল, না, মা, এ তো গুরু পাপে লঘু দণ্ড হয়ে গেল। সবটাই শোধ বোধ হবে বাবা আর তাতাই যদি আজ রাতে শাশুড়ি-বৌমার দোকানের স্পেশ্যাল মটন বিরিয়ানি খাওয়ায় আমাদের সবাইকে।

এই যে এঁচোড়ে পাকা আর এই রকম হাজারো শব্দ, এগুলো সব বাগধারা। সব বর্ণচোরা আম। দেখতে যেমন, আসলে তা নয়। প্রতিটা ভিতরে ভিতরে অন্য মানে বয়ে বেড়াচ্ছে।


ইদানীং প্রায় অব্যবহৃত একটা Idiom হল ‘Argus-eyed’, যার প্রয়োগ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি অর্থে।
এর উৎপত্তি আছে গ্রীক উপকথায়। Argus ছিল পঞ্চাশজোড়া চোখওলা এক দৈত্য। কাজেই, তার চোখকে ফাঁকি দেওয়া ছিল অসম্ভব ব্যাপার। যদিও Argus বেচারাকে শেষে বেঘোরে মারা পড়তে হয়েছিল। সে গল্প এখানে থাক।
Idiom হিসাবে ১৬০৩ সালে এর প্রথম প্রয়োগ দেখা যায়।
উদাহরণ— ‘The invigilator was so Argus-eyed that nobody could copy in the examination.’
বাংলায় বলে, ‘কড়া নজর’। যেমন, ‘পিয়া ম্যাডামের এমন কড়া নজর যে কেউ টুকলি করতে পারল না।’


মতলব হাসিল করা যে ‘Axe to grind’, তা কে না জানে?
‘Axe to grind’ এর পিছনের গল্পটা ভারি মজার। ১৮১০ সালে লেখা Charles Miner-এর একটা গল্পে এর প্রথম প্রয়োগ হয়েছিল বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন। গল্পটা এরকম। একটা ছেলে বসেছিল তাদের দোকানে শাণপাথরের পাশে। একটা লোক যাচ্ছিল সেখান দিয়ে, কাঁধে একটা ভোঁতা কুড়ুল। ছেলেটাকে সরল সিধে দেখে লোকটা ভাবল, একে দিয়েই কাজটা করিয়ে নেওয়া যাক। লোকটা ছেলেটাকে বলল, এটা কী জিনিস গো, খোকা? ছেলেটা বলল, শাণপাথর, এ দিয়ে ছুরি, কাঁচি, বটি সব ধার করা যায়। লোকটা অবাক হওয়ার ভান করে বলল, তাই! এতটুকু পাথর দিয়ে কীভাবে ধার দেবে অত বড় বড় জিনিস? ছেলেটা বলল, আপনার কুড়ুলটা দিন, দেখিয়ে দিচ্ছি। লোকটার কাছ থেকে কুড়ুলটা নিয়ে সেটায় ধার দিয়ে ছেলেটা বলল, দেখলেন তো? ছেলেটাকে বোকা বানিয়ে মতলব হাসিল করে লোকটা হাসতে হাসতে চলে গেল।
অনেকে আবার Benjamin Franklin-এর থেকে এর উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করেন।
James Joyce-এর ‘Ulysses’ গ্রন্থে এর প্রয়োগ দেখা যায়।
উদাহরণ— ‘Why has Ramesh started talking to you again? I think, he has an axe to grind.’
বাংলায়, ‘রমেশ ব্যাটা বহুদিন পর আবার তোমার সাথে পিরিত করতে শুরু করল কেন? নিশ্চয়ই ওর কোনও মতলব হাসিল করার ধান্দা আছে’।


‘Bad egg’ শুনে কী মনে হচ্ছে?
খারাপ ডিম? পচা ডিম?
আসলে, ‘Bad egg’ হল যাকে বিশ্বাস করা যায় না এমন একজন অসৎ মানুষ।
মানুষ বোঝাতে ‘Egg’ শব্দের ব্যবহার দেখা যায় ১৬০০ সালের পর থেকেই। ১৮৫৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ‘The Milwaukee American’ পত্রিকায় এর প্রথম মুদ্রিত প্রকাশ। আর, সাহিত্যে এর প্রথম প্রয়োগ Samuel A Hammett-এর ‘Captain Priest’ উপন্যাসে।
উদাহরণ— ‘Stay away from a bad egg like Amal. He is dangerous.’
বাংলায়, ‘পচা মাল’। যেমন, ‘ঐ পচা মালটাকে এড়িয়ে চল। ও, কিন্তু, তোমার সর্বনাশ করে দেবে’।

১০
ইংরিজিতে আধুনিককালে যে Idiom-গুলো ঠাঁই পেয়েছে, তার একটা হল, ‘Band-aid solution’। সমস্যার সাময়িক সমাধান অর্থে এর প্রয়োগ করা হয়।
উদাহরণ— ‘He gave a band-aid solution to my financial problems.’
বাংলায়, ‘জোড়াতাপ্পি দেওয়া’। যেমন, ‘এইরকম চিন্তা বেকার সমস্যায় জোড়াতাপ্পিই দেবে, আসল সমাধান করবে না।’

এরকম অনেক, অনেক কথার মধ্যে কথা আছে। আবার পরে কোনও একদিন এসব নিয়ে কথা বলা যাবে।