এক ছিল কাক, আর বউ কাকী তার। বনকরমচার ঝোপে তাদের বাসা। খাসা সেটি বেশ। কাঠ-কুটোতেই নয় শেষ; কত কী রাজ্যের জিনিস দিয়ে বাসা বানিয়েছে। চার-চারটে সাদা ডিম তাতে মানিয়েছে বেশ; রোদ লেগে করছে ঝিলমিল! হালফিল এই প্রথম চারটে ডিম পেড়েছে কাকী।
ডিম পেড়ে অবধি ঘুম নেই, কাকীর চোখে। ডিমের থোকে বসে দিন-রাত্তির তা দিয়েই চলেছে।পাখিপাড়ার আর সব কাক-কাকীরা বলছে: কা-খা-কা-কা— নতুন কাকের-মা। সাবধানে ঘুম যা! না হলে ঘুম ছুটলে, খোলা ভেঙে ডিম ফুটলে— দেখবি কোকিল-ছা। কা-খা-কা-কা!
সেদিন, অন্যদিনের মতোই কাক উড়ে গেছে— সেই কাকভোরে। দোরে বসে ঘাঁটি আগলাচ্ছে কাকী। খিদেয় পেট চুঁই-চুঁই করছে তার। বারবার রাগ হচ্ছে কাকের ওপর। এতখানি বেলা হল—আ’মলো, কাকের পাত্তাই নেই। অন্যদিন এতক্ষণ তো তাকে কিছু খাবার দিয়ে যায়। পায়নি না কি, আজ কিছু? পিছু ফিরে হঠাৎ কাকী দেখল কী এক মুখে নিয়ে কাক উড়ে আসছে। হাসছে, আর বলছে:
কা— কোয়া কা
নতুন ডিমের মা;
কী এনেছি দেখে যা
কাকীর হল খুব রাগ। কাককে বললে:
কা— কোয়া কা
আমার মাথা খা।
এতখানি বেলা হল
কাকীকে কি মনে প’লো?
কিন্তু অভিমান চলে গেল নিমেষে। এক গাল হেসে বললে: কা-কা-কা-কা। ওটা আবার কী গা!
কাকও গর্বভরে হাসল খুব: কা-কোয়া-কা। হাঃ হাঃ হাঃ! তারপর দুধ খাবার ঝিনুকটা ঝনাৎ করে ফেলে বললে: নতুন কাকের মা। ডিমের ভিতর ছা। দুধ খাওয়াবি যাঃ! দিলাম এনে ঝিনুক। বাছারা দুধ চিনুক।
কথাটা কীভাবে পাখিপাড়ায় কানাকানি থেকে হয়ে গেল জানাজানি। কাককে সবাই পাড়ার ঝাড়ুদার-পাখি বলে জানলেও— আর মানামানি থাকল না। ছাপোষা রয়েছে সবারই ঘরে। একের পর এক আসতে লাগল কাকীর কাছে।
ছানা-পোনাদের দুধ খাওয়াবার হিড়িক পড়ে গেল গাছে গাছে। কাকীরও আপত্তি নেই ঝিনুক দিতে; তাতে তাকে চিনুক আর নাই চিনুক— বাছারা খাবে বলে কথা! কিন্তু সব্বাইকে সে সাফ শুনিয়ে দিলে:
পাখপাখালির মা, যাবি ঝিনুক নিয়ে যা
(আমার) ডিমের ভেতর ছা।
ক’দিনেই ডিম ফুটবে;
তখন আবার জুটবে
সেইটি হবে না। এখন নিয়ে যাস যা . . .
ফিঙে, দোয়েল, ছাতারে— আরও কতজনা কাতারে কাতারে এল। এবেলা-ওবেলা পালা করে ঝিনুক নিয়ে গেল। কিন্তু ভদ্রপাখির এক কথা। এবেলা নিয়ে গেল তো ওবেলা দিয়ে গেল ঘুরে। ঝগড়াটে বলে পাখিপাড়ার একটু দূরে থাকত শালিক। যেন কত্ত টাকার মালিক সে! এমনই ভাব দেখিয়ে বললে:
হ্যাঁ লা বউ কাকী— ঝিনুক আছে নাকি!
একবার ভাই দে না; না হয় কিছু নে না।
ডিমে তা দিচ্ছিল কাকী; শালিক পাখিকে বললে:
না না ভাই না। কিচ্ছুটি চাই না
(আমার) ডিমের ভিতর ছা।
(এখন) নিয়ে যাস যা
ক’দিনেই ডিম ফুটবে,
তখন এসে জুটবে (শুধু) সেইটি হবে না।
শালিকও ঠ্যাং নেড়ে বললে:
না রে ভাই না। আমার ছেলে আবার যা—
মানুষ-বাড়ির ঝিনুকেতেও দুধ রুচবে না
তবু সবাই যখন নিলে, আমিও নিই–
বিশ্বাসেতে দিলে।
—বেশ, নিতেই যদি চাস, কাল ফেরত দিয়ে যাস।
কাকী ওর কানে কামড়ে বলে দিলে।
একদিন গেল, দু-দিন গেল— গেল তিনদিন। ঋণ করে শালিক সেই যে ঝিনুক নিয়ে গেছে, আর পাত্তা নেই তার। কতবার কাক শালিক-বাড়ি ঝিনুকের তাগাদায় গিয়ে গিয়ে রাস্তা করে ফেলল। অনেক টাকার মালিকের মতো শালিক-বাড়িতে রোজই তালা ঝুলছে। কাক, কাকীকে বকাঝকা করতে লাগল: (আমার) এমন শখের ঝিনুক! পয়সা থাকলে শালিক-বেটি না হয় একটা কিনুক। কেঁদে ফেলল কাকী; ফাঁকি দিয়ে গেল তাকে শালিক! জীবনে এই প্রথম ডিম পেড়েছে কাকী। দুঃখটা শালিক-বউ জানে না কি? সেও তো ছেলের-মা! যাঃ, যদি আর না দেয় ঝিনুকটা? আজ বাদে কাল তার ডিম ফুটে বেরুবে বাচ্ছা। আচ্ছা তো বউ-শালিক! বাছারা দুধ খাবে বলে কত শখ করে ঝিনুকটা এনে দিয়েছিল কাক। ঠিক তাক করে ছিল!
ডানা ছড়িয়ে ডিমগুলোকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল কাকী। কাক সান্ত্বনা দিচ্ছিল তাকে। এমন সময় বাইরে কে রাতবিরেতে ডাকে? ‘কাক আর কাকী— বাড়ি আছ নাকি?’ কে-কে-কে, কাক ডেকে উঠল। ‘আমি আদুর-বাদুড়। পাখি-পাড়ার রাতের বাসিন্দে। তা, বাড়িতে কে কান্দে!’
তাকে বুঝিয়ে সব বললে কাক। ডাক ছেড়ে বাদুড়ও: বটে-বটে-বটে। দিন-দুপুরে এসব বুঝি ঘটে! ভেবেছে কী শালিক, (ও কি) পাখপাখালির মালিক? চলো তো ভাই কাক। (আজ) একহাত লড়া যাক।
সে কী কাণ্ড তারপর! ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল বাদুড়ের এক-ডাকে পাখিপাড়ার পাহারাদার আর সব বাদুড়েরা। তাদের আদুড় গা। পায়ে সরু সরু তেল মাখানো খ্যাংরাকাঠির ইয়া লাঠি। গোঁফে চাড়া— দেখলে মরা পাখিও ককিয়ে কেঁদে উঠবে!
আমরা তো সব রাত্রিচর— শালিকের ঘর জানিনা, তুমি ওর বাড়িটা দেখিয়ে দাও শুধু। পাখতুতো ভাইদের ধাপ্পা দেওয়া— এ রাজ্যে চলবে না। আমরা ঝিনুক ছিনিয়ে আনবই। হৈ দিয়ে বাদুড়েরা বললে কাককে। রাত্রে আবার চোখে ভাল দেখতে পায় না কাক। তার উপর কালো রং করা রাত আজ। নিম গাছে শালিকের ঘরটা দেখিয়ে দিল হাতড়ে হাতড়ে। জাঁদরেল এক ডাক ছেড়ে সব বাদুড় ঝাঁপিয়ে পড়ল শালিক-বাড়ি।
হল ঝিনুক উদ্ধার। তার শখের ঝিনুক ফিরে পেল কাকী। বাকি এবার ডিম ফুটে বাচ্চা বেরনোর।
ভোর ফুটে উঠতেই সেদিন বাসা আলো করে ডিম ফুটল। উঠল নড়ে কচি বাচ্চারা। তারা কোঁয়া-কোঁয়া করে কেঁদে উঠতেই— দৌড়ে এল পাখিপাড়ার পড়শী কাকেরা! বাড়িময় তারা বাজাতে লাগল শাঁখ। ঝাঁক বেঁধে আঁতুড় ঘরে উঁকি মেরে বলল:
কোয়াক কোয়াক কোয়াক।
বেটা-কাক না বেটি-কাক!
ভোরের লাল আলোর মতো লজ্জা লাগল কাকীর গালে। ঘোমটার আড়ালে মুখ লুকাল সে। কাককে ধরল সবাই:
কা-কোয়াক-কাপ। হলে ছেলের বাপ।
লাগাও বড়ো ফিস্টি। আনাও হরেক মিষ্টি।
কাকও ফিস্ট দিল— মস্ত বড়ো।
দিনে দিনে বাচ্চাদের হল বাড়বাড়ন্ত। অন্ত নেই চিন্তার। বারবার ভয় হয়— কাক-কাকীর। ক্ষীরটা-দুধটা রোজ রোজ পায় কোথায়? যায় তবু কাক কোনও দিন গরুর কাছে; পাছে পাছে ঘুরে কত তোষামোদ ক’রে তার বাঁট থেকে দুধ আনে ঝিনুক ভর্তি। পড়তি বেলায় ক্লান্ত কাককে বসিয়ে, সেদিন কাকী নিজেই গেল মানুষপাড়া। তাড়া খেয়ে ঠ্যাং-এ লাগল ঘা। সাঁ করে তবু দুধের-বাটি নিয়ে ফিরে এল।
মানুষ-মায়ের মতোই দুধ করল গরম। নরম পালকের কোলে বাছাদের মাথা ডুবিয়ে মুখে দিলে ঝিনুক। চিনুক চিনুক করে কচি ঠোঁটে দুধ খাবার শব্দ তুলল তারা। আত্মহারা হয়ে উঠল খুশিতে কাকী!
ক্রমে বাচ্চাদের পুঁতি পুঁতি চোখ ফুটল। ডানা উঠল। ছুটল গলার স্বর: কু-হু কু-হু! কাকীর মুখটা কিন্তু কালো হল না। পরম যত্নে কোকিল-বাছাদেরই লাগল মানুষ করতে। তারপর? একদিন তার বুকটা শূন্য করে দিয়ে উড়ে গেল — হুস্— কোকিল বাচ্চারাও।
সর্বহারা হয়ে হায় হায় করতে লাগল কাকী।