একদিন শান্তিনিকেতনে— মাথায় প্রকাণ্ড পাগড়ি, হাতে তেলেপাকানো পেতলের ঘুণ্টিদার মোটা বাঁশের লাঠি, হাঁটু পর্যন্ত ধূলায় আচ্ছন্ন, গায়ে মেরজাই, পরণে খাটো ধুতি আঁটো করে টেনে পরা প্রকাণ্ড পাকানো, গোঁফওয়ালা একজন বিহারী দেহাতি লোক এসে নন্দলাল বোসের খোঁজ করছিল৷ সবাই ভাবল হয়তো কারও সুপারিশ নিয়ে দরওয়ানের কাজ চাইতে এসেছে বিহারের দেহাত থেকে৷ নন্দলালের তখন দেশে-বিদেশে নাম৷ দেশের নায়করা শ্রদ্ধায় সম্ভ্রমে ও-নাম উচ্চারণ করেন৷ নন্দলাল কিন্তু এসে তাকে দেখেই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন৷ শৈশবের খেলার সাথী খড়্গপুর গ্রাম থেকে এসেছে একবার দেখে যেতে এখানকার বিখ্যাত আচার্য নন্দলালকে৷ নন্দলাল সেদিন তাঁর সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ রাখলেন৷ সমস্ত দিন ঐ লোকটির সঙ্গে একসঙ্গে বেড়ালেন৷ একসঙ্গে খেলেন৷ ছেলেবেলার কত পুরনো ছোটো ছোটো কথা! তাই নিয়ে দু’জনের কী আনন্দ, কত হাসি!
রবীন্দ্রনাথ ‘পরশুরাম’-এর গল্পগুলি পড়ে এত মুগ্ধ হয়েছেন যে অযাচিত ভাবে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন মাসিক পত্রে৷ শেষে অনুরোধ করলেন রাজশেখরকে শান্তিনিকেতনে তাঁর কাছে কয়েকদিন কাটিয়ে যেতে৷ রাজশেখর এলেন শান্তিনিকেতনে৷ স্বাভাবিক ঔৎসুক্য নিয়ে গেলেন কলাভবন দেখতে৷ তাছাড়া অধ্যক্ষ শিল্পাচার্য নন্দলাল বসুর সঙ্গেও আলাপটা যদি হয়ে যায় এই সঙ্গে৷
কলাভবনে গিয়ে নন্দলালকে দেখেই চমকে উঠলেন রাজশেখর৷ এ যে দ্বারভাঙ্গার সেই বাল্যের বন্ধু নন্দলাল! নন্দলালও হকচকিয়ে গেলেন রাজশেখরকে দেখে— ‘আরে— এত যে রাজশেখর আর পরশুরাম শুনি তাহলে তুমিই সেই রাজশেখর!’ রাজশেখরও তাঁর গাম্ভীর্য ভুলে গিয়ে ছেলেমানুষটির মতো হেসে উঠলেন— ‘আর তুমিই সেই নন্দলাল?’ তখন চলল এই দুই বিখ্যাত লোকের ছেলেবেলার নানা হাসির গল্প নিতান্ত ছেলেমানুষের মতো উৎসাহে৷
দেখা গেল নন্দলালের আত্মীয় হতে বিদ্যা-বুদ্ধি নাম-যশ কিছুরই দরকার হয়নি৷ কেবল চেয়েছেন— আন্তরিকতা, ভালবাসা৷ উচ্চ-নিচের কোনও প্রশ্ন ছিল না সেখানে৷ ভালোবাসার কাছে উচ্চ-নিচ সবই সমান তাঁর কাছে৷
ছাত্র অবস্থাতেই চিত্রশিল্পী হিসেবে বিখ্যাত হয়েছেন নন্দলাল৷ কত ছবিতে প্রথম পুরস্কার হিসেবে মোটা টাকা পেয়েছেন— সোনার মেডেল পেয়েছেন৷ ছবি দেখে আকৃষ্ট হলেন বিবেকানন্দ-শিষ্যা আইরিশ মহিলা সন্ন্যাসিনী ভগিনী নিবেদিতা৷ নিজে এসে দেখলেন৷ যা ভেবে এসেছিলেন তাই পেয়ে গেলেন নন্দলালের মধ্যে— নয় তো সতীর অমন পবিত্র রূপ বের হয় তাঁর হাত দিয়ে? বাড়িতে ডেকে নিলেন নন্দলালকে৷ আসন করে স্থির হয়ে বসতে শেখালেন৷ কেমন করে ধ্যান করতে হয় দেখিয়ে দিলেন৷ ঠিকমতো ধ্যান না করতে পারলে ছবি মনের মধ্যে সত্য হয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠবে কেমন করে? বিশুদ্ধ মন নন্দলালের৷ ধর্ম যেন মূর্তি পরিগ্রহ করেছে তাঁর মধ্যে৷ আমরা বুদ্ধের জীবন ও বাণী, চৈতন্যদেবের নিষ্ঠা ও প্রেমভক্তি, আরও কত দেবতাত্মা মহাপুরুষের জীবনকথা পড়ি৷ বুদ্ধ এমন করে মারের আক্রমণ প্রতিহত করেছেন, চৈতন্য এমন করে আততায়ীকে ক্ষমা করেছেন— এসব কথা সময় বুঝে প্রয়োগও করি, কিন্তু নিজের জীবনে সেসব ধরে রাখতে পারিনে৷ কিন্তু নন্দলাল এসব আদর্শে যেমন বিশ্বাস করতেন নিজ জীবনে বারংবার তাকে প্রয়োগ করেছেন৷ এখানেই তিনি অসাধারণ৷
আমাদের প্রাচীন সভ্যতার মূলে ছিল ঐকান্তিক নিষ্ঠা আর গুরুভক্তি৷ এটি আর কোথাও চোখে পড়ে না আজকাল৷ আমরা আমাদের গুরুস্থানীয় লোকের কাছ থেকেও নির্জলা প্রশংসা না পেলে ক্ষুণ্ণ হই, এমনকি চটেই যাই৷ আমাদের গুরুভক্তি এমনি ভঙ্গুর৷ প্রশংসা পেলে তো কথাই নেই৷ তখনই গুরুর কথায় খুব বিশ্বাস এসে যায়৷ ভাবি ‘গুরুর দৃষ্টি কী প্রখর, ঠিক সত্যি ধরে ফেলেছেন’ আর বুকখানাও দশহাত হয়ে ওঠে৷
কিন্তু একবার কী হল! শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ তাঁর প্রিয় শিষ্য সম্বন্ধে বলছিলেন— ‘নন্দলাল আমার থেকেও অনেক উঁচুতে উঠে গেছে হে; আজ সে আমার থেকেও বড়৷ আজ আমি কত সুখী৷ কথায় আছে জানো তো ‘সর্বত্র জয়মিচ্ছেৎ পুত্রাৎশিষ্যাৎ পরাজয়ম্’— সব জায়গায় নিজের বিজয় কামনা করবে, কিন্তু পুত্র আর শিষ্যের কাছে চেও পরাজয়৷’
কথাটা যথাসময়ে নন্দলালের কানে উঠল৷ নিজের শিষ্যের মুখে একথা শোনবার পরে যে বেদনা ফুটে উঠল তাঁর মুখে তা বর্ণনা করা অসম্ভব৷ মনে হল কে যেন অকস্মাৎ তাঁর বুকে একখানা ছুরি বসিয়ে দিল৷ অনেকক্ষণ ধরে নিজেকে সংযত করে চোখের জল রোধ করলেন৷ তার পরে ধরা গলায় বললেন— ‘বলতে চাও অবনবাবু বলেছেন আমার সম্বন্ধে একথা! একথা আমাকে বিশ্বাস করতে হবে! একথা যেদিন বিশ্বাস হবে তার অনেক আগে যেন আমার মৃত্যু হয়৷’
নন্দলাল আদর্শ গুরু, আদর্শ শিক্ষক৷ ছাত্রেরা কখনও টেরও পেত না যে তারা শিখছে৷ নানা গল্প নানা কথা নানা কৌতুক চলেছে চাপা গলায় আর সে সঙ্গে চলেছে কাজ৷ কার কী প্রয়োজন, কার কোথায় আটকাচ্ছে সে সব গুরুর নখদর্পণে৷ ঠিক সময়মতো তার সে মানসিক অভাব পূরণ হয়ে যাচ্ছে৷ সবাই ভাবছে গুরু আমাকেই সবচেয়ে ভালবাসেন৷
১৯২১ সাল৷ কংগ্রেসের অধিবেশন হবে আমেদাবাদে৷ তার সঙ্গে স্বদেশী শিল্পী প্রদর্শনী— বিশেষত চরকা আর খাদি৷ গান্ধিজির একান্ত সচিব মহাদেব দেশাইয়ের চিঠি এল নন্দলালের কাছে—শান্তিনিকেতন কলাভবনের ছাত্রদের ছবি আর সে সঙ্গে চাই নন্দলালের আঁকা ছবি— প্রদর্শনীর জন্য৷ নন্দলাল চিন্তিত হলেন৷ জবাবে লিখে দিতে বললেন— ‘আমরা যে কলেজে ছবি আঁকি, যে রং, তুলি এমনকি পেন্সিল রবারখানা পর্যন্ত ব্যবহার করি— তার সবই বিলিতি৷ সুতরাং ও প্রদর্শনীতে এ ছবি পাঠানো চলে না৷’ গান্ধিজি ভেবে উত্তর দিলেন— ‘ছবি হল সৃষ্টির কাজ, সে কাজ যদি দেশি হয়, দেশি ভাবের উদ্দীপক হয় তবে তার উপকরণ— কাগজ, পেন্সিল, রং, তুলি দেশি কী বিলিতি তা নিয়ে ভাবনা করা নিরর্থক৷ তোমরা ছবি পাঠাও৷’
ছবি পাঠাবার তোড়জোড় চলছে৷ সে সঙ্গে ছবির উপকরণ নিয়ে নানা কথাও চলছে৷ নন্দলালের এক তার্কিক শিষ্য প্রশ্ন তুললেন—‘উপকরণটাই ছবির প্রধান অঙ্গ৷ রং-তুলি যদি না থাকে তবে ছবি হবে কিসে?’ নন্দলাল মৃদু হেসে বললেন— ‘ওহে উপকরণ বলতে যদি উইন্ডসর অ্যান্ড নিউটনের রং আর তুলি ভেবে থাকো তবে এটাও জেনে নাও যে সে উপকরণ না থাকলেও ছবি আটকায় না৷’ শিষ্য নাছোড়৷ সে বলে— ‘ধরুন যদি আমি রবিসন ক্রুশোর মতো এমন একটা জায়গাতে গিয়ে পড়ি যেখানে উপকরণ বলে কিছু নেই— তখনও কি ছবি হবে?’ নন্দলাল স্বভাবসিদ্ধ মৃদু হেসে বললেন— ‘রোসো, ভেবে দেখি৷’
পরদিন ছবি আঁকার ক্লাস শেষ হয়েছে দুপুরে খাবার আগে। নন্দলাল চলেছেন সেই তার্কিক শিষ্যটিকে সঙ্গে নিয়ে গল্প করতে করতে। বাড়ির কাছে যেতেই একটু দূর থেকে নজরে পড়ল— বারান্দার সামনে দাঁড় করানো একখানা নতুন ছবি।
ছবির বিষয়টাও নিতান্ত পরিচিত৷ শান্তিনিকেতন আশ্রমে তখন এক পাল নেড়িকুকুর ছিল৷ ঠাট্টা করে বলা হত— ‘আশ্রম মৃগ৷’ পূর্ণিমার জ্যোৎস্না রাত হলেই ভাবনার কথা হত৷ ঘুমের বারোটা বাজাবে কুকুরগুলো৷ দলবদ্ধ হয়ে বেশ খাড়া হয়ে বসে আকাশের দিকে মুখ তুলে তাদের সমবেত সঙ্গীত শুরু হয়ে যেত৷ তখন ঘুমায় কার সাধ্য! তখন বিছানা ছেড়ে মার মার করে তেড়ে না গেলে ওরা নিরস্ত হবে না৷ আর তেড়ে গেলেই ঘুমটি মাটি৷
এ ছবিখানির বিষয়বস্তুও তাই৷ একটা নেড়িকুকুর আকাশে চাঁদের দিকে মুখ তুলে সঙ্গীত শুরু করেছে৷ পাঁশুটে রং-এর আকাশে সাদা পূর্ণ-চাঁদ৷ পাঁশুটে সাদাতে কালোতে ছোপ ছোপ দেওয়া কুকুরটি খাড়া হয়ে বসে আকাশে চাঁদের দিকে মুখ তুলে হাঁ করে গান করছে, তলায় গেরুয়া মাটিতে কালো ছায়া৷
শিষ্যের মুখ দিয়ে আপনা থেকেই বেরিয়ে গেল— ‘বাঃ, চমৎকার তো! কখন হল এ ছবিখানা?’
মৃদু হেসে গুরু নন্দলাল বললেন— ‘কালই বিকেলে করেছি৷ যাও কাছে গিয়েও দেখ না!’
কাছে গিয়ে শিষ্যের চক্ষু স্থির! দেখে একখানা কালো টালির ওপরে বাবলার আঠা মাখিয়ে তার উপরে ঘুঁটের গুড়ো, চুন, পথের ধুলো আর কাঠ-কয়লার গুঁড়ো ছড়িয়ে ছড়িয়ে ঐ ছবিখানা হয়েছে৷ তুলিরও দরকার হয়নি!
শিষ্য তার প্রশ্নের জবাব পেল— যে জবাব চিরজন্মের জন্য তার মনে গাঁথা হয়ে রইল৷ কথার উত্তরে কথা ফেলে সে তর্কের সমাধান হওয়া শক্ত ছিল৷ কথার ডানায় ভর করে সে এই প্রশ্নের চারদিকে উড়ে উড়ে বেড়াতে থাকত— সংশয় তার আর শেষ হত না৷ কিন্তু এ নতুন শিল্প রচনা তার সে ডানা দুখানি ভেঙে তাকে তার পায়ের ওপরে দাঁড় করিয়ে দিল৷ পায়ের তলায় তার বিশ্বাসের দৃঢ় ভূমি৷ তখন আর তর্কের বর্মে গা বাঁচিয়ে চলা নয়৷ তখন সে বর্ম ছিন্ন হয়ে গেছে— তখন আত্মসমর্পণ করা ছাড়া উপায় থাকে না৷ তখন সে বিশ্বাস করতে শেখে— ছবি তর্কের জিনিস নয়৷
জীবনের শেষ কয়েকটি বছর রোগে তাঁকে স্থাণু করে রেখেছিল! নিতান্ত প্রশান্ত ভাবেই তিনি তাঁর এ অবস্থা মেনে নিয়েছিলেন৷ প্রায় সমস্ত দিনই একভাবে বসে কাটাতেন শিরদাঁড়া সোজা করে৷ যেমনটি সন্ন্যাসিনী নিবেদিতা একদিন শিখিয়ে দিয়েছিলেন৷ উঠতে হাঁটতে পারতেন না৷ তখনও প্রতিদিন ছবি এঁকেছেন তাঁর ছবি আঁকবার ঘরখানিতে বসে৷
একদিন শিষ্য গিয়ে প্রণাম করতেই— খানিকক্ষণ চুপ করে যেমন একটা প্রসঙ্গ তুললেন, তেমনি একটু হেসে মৃদুস্বরে বললেন— ‘আধুনিক ছবি দেখ?’
‘না দেখিনে৷’ শিষ্য উত্তর করল৷
‘একজিবিশন দেখতে যাও না কোথাও?’
‘না৷ একজিবিশনে যাওয়া অনেক কাল ছেড়ে দিয়েছি৷ কোথাও আর যাইনে এখন৷’
মুখখানি প্রসন্ন হল৷ ক্লান্ত কণ্ঠে মৃদুস্বরে বলতে লাগলেন— ‘যা দেখলে নিন্দা করতে হতে পারে তেমন জিনিস না দেখাই ভাল৷ কারণ যে জিনিসটা দেখে তুমি নিন্দে করবে তাকে তোমার মনে ধরে রাখলে তবে তো নিন্দা করতে পারবে? অন্তরে একবার স্থান পেলে সে নিন্দার বস্তু তোমার অজ্ঞাতসারে তোমাকেই প্রভাবিত করবে৷ পরে দেখবে ঐ নিন্দার বস্তুর তোমাতে এসে বর্তেছে৷ তাই নিন্দার বস্তু থেকে দূরে সরে থাকতে হয়৷’
বিরাশি বছরের গুরু তাঁর শেষ উপদেশ রেখে গেলেন তাঁর সত্তর বছরের শিষ্যের কাছে৷ এ উপদেশ তো কেবল শিষ্যকে নয়, দিয়ে গেলেন সমস্ত দেশকে৷ তোমরা তোমাদের জীবনে মহাশিল্পীর এই শেষ উপদেশ মেনে চলবে কি? তবে তোমরা হবে সোনার মানুষ— আর এই দেশ হবে সোনার দেশ৷
ঋণ: বার্ষিক শিশুসাথী, ১৯৬৬; বানান পরিবর্তিত