অনিন্দ্য ওর বাবার সাথে দাঁড়িয়েছিল স্টেশনে। বাবাকে হাওড়া যাওয়ার ট্রেনে তুলে দেওয়ার জন্য। স্টেশনটা দক্ষিণবঙ্গ আর উত্তরবঙ্গের সীমানায়। পূর্বে হাতছানি দেয় বাংলাদেশ। পশ্চিম থেকে ডাকে সাবেক বিহার। রাত প্রায় দশটা। মহালয়া হয়ে গেছে, হাতে-গোনা তিনদিন পর পুজো। বাবা এসেছিলেন তার আদরের নাতি আর বউমার জন্য পুজোর জামাকাপড় নিয়ে।
ওরা অনেক করে বলেছিল বাবাকে আর কয়েকটা দিন থেকে যাওয়ার জন্য। বাবা রাজি হননি। ফেরার টিকিট করেই এসেছিলেন।
ট্রেন ঢুকল প্রায় আধঘন্টা লেটে। অনিন্দ্য বাবাকে তুলে দিল নির্দিষ্ট কামরায়। জংশন স্টেশন হলেও ট্রেন এখানে খুব বেশি সময় দাঁড়ায় না। ট্রেন ছাড়ার আগে বাবা বললেন, যেভাবেই হোক, লক্ষ্মীপুজোর আগে বউমা আর ভন্ডুলকে নিয়ে বাড়ি আসবি। নাহলে, তোর মা কিন্তু খুব রেগে যাবে।
অনিন্দ্য বলল, ঠিক আছে। তুমি সাবধানে যেও। শুয়ে পড় তাড়াতাড়ি। আর ব্যাগটা ঠিক করে নিয়ে নেমো। হাওড়ায় নেমে ট্যাক্সি নিয়ে নেবে। বাসে-ফাসে যেও না।
ট্রেন ছেড়ে দিতে অনিন্দ্য স্টেশনের বাইরে এসে টাঙায় উঠল। ও কলকাতা থেকে ফরাক্কায় বদলি হয়ে এসেছে বছরখানেক। আজ থেকে বছর চল্লিশ আগে ফরাক্কায় ধারেকাছে যাওয়ার জন্য টাঙাই ছিল প্রধান ভরসা। হাতেগোণা সাবেকি ফোন ছিল অফিস-কাছারিতে। সারা পশ্চিমবঙ্গ তখনও মুঠোফোন বা কম্পিউটর দেখেনি।
লক্ষ্মীপুজোর আগের দিন অনিন্দ্য ছেলে-বউকে নিয়ে এল কলকাতার বাড়িতে। বেল বাজাতেই মা’র গলা পাওয়া গেল, কে?
অনিন্দ্য বলল, মা, আমরা।
ভাইঝি বুঁচকি দরজা খুলল।
মা বলেই চলেছে, ওই এলেন। কবে যে আর আক্কেল হবে?
অনিন্দ্য মাকে প্রণাম করতে করতে বলল, কেন? বে-আক্কেলের কী দেখলে?
মা ওদের তিনজনকে দেখে বলল, তা তিনি কই? তোদের বাবা?
অনিন্দ্য ভুরু কুঁচকে বলল, মানে? কী বলছ তুমি?
এর মাঝেই বেরিয়ে এসেছে দাদা, বৌদি। সবাই তাকিয়ে ওর দিকে।
অনিন্দ্য বলল, বাবাকে চতুর্থীর দিন আমি নিজে ট্রেনে তুলে দিলাম। ডাউন কামরূপ এক্সপ্রেসে।
দাদা বলল, কী বলছিস তুই? বাবা তো বাড়ি ফেরেনি।
অনিন্দ্য আর ওর বউ একসাথে বলে উঠল, মানে?
মুহূর্তে বদলে গেল বাড়ির আবহাওয়া।
একটা হাসিখুশি পরিবার কেঁপে গেল এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের বাড়ি না ফেরায়।
বেল বেজে উঠল দরজায়।
সবার মধ্যেই স্তব্ধতা। কেউ এগিয়ে যায় না দরজা খুলতে।
একটু পরে আবার বেজে উঠল বেল। দাদা বলল, বুঁচকি, দেখ তো কে এল।
বুঁচকি দরজা খুলতেই লক্ষ্মীপুজোর সমস্ত মাল নিয়ে উঠে এল গণেশ। ও রিক্সা চালায়, এ বাড়ির ফাইফরমাশও খাটে।
গণেশ বলল, মাসীমা, এই নিন, সব নিয়ে এসেছি, যা যা লিখে দিয়েছিলেন।
কেউ কোনও কথা বলছে না। অনিন্দ্যর বৌদি শুধু বলল, এখানে রাখুন। কত দিতে হবে আপনাকে, গণেশদা?
গণেশের কেমন যেন মনে হল। বাড়িটা হঠাৎ এত থমকে গেল কেন?
যদিও বড়বাড়ির ব্যাপার, তবু, একটু ভয়ে ভয়ে বলল, কিছু হয়েছে?
মুখ খুলল অনিন্দ্যর দাদা। বলল, গণেশদা, জানো, বাবাকে পাওয়া যাচ্ছে না।
অ্যাঁ, বলছ কী? গণেশ চমকে গিয়ে বলল।
ডুবন্ত মানুষ যেমন খড়কুটো আঁকড়ে ধরে, গণেশকে সামনে পেয়ে ওদেরও তেমন অবস্থা।
অনিন্দ্য আর ওর দাদা সব খুলে বলল গণেশকে।
গণেশ বলল, তোমরা পুলিশে যাও। আর, কাগজে যেমন ছবি ছাপিয়ে ফিরে আসতে বলে, সেরকম কিছু কর। কিন্তু, বাবু কাউকে কিছু না বলে এমন করে চলে গেলেন কোথায়? এত সুখের সংসার ফেলে?
অনিন্দ্যর মা ডুকরে কেঁদে উঠল।
গণেশ বলল, আমি যাই। রিক্সাটা জমা করেই আসছি।
গণেশ যেতে যেতে এ বাড়ির পরিচিত যত লোককে দেখল, সবাইকে বলল, মাস্টারবাবু বাড়ি ফেরেন নি।
আস্তে আস্তে চেনাশোনা কয়েকজন এল। নানা জনের নানা কথা। একজন তো অনিন্দ্যকে বলেই ফেললেন, তা তুমি একটা খোঁজ নেবে না, বাবা বাড়ি ফিরল কি না?
এ বাড়িতে যে টেলিফোন নেই, সেটা তার মাথায় এল না।
শেষে থানায় যাওয়াই ঠিক হল।
স্থানীয় থানার অফিসার সব শুনে বললেন, ঘটনা তো এখানে ঘটেনি। এই কেস আমরা নেব না। যেখানে হয়েছে, সেখানে যান।
সেই রাতেই অনিন্দ্য আর ওর দাদা ফরাক্কা যাওয়ার জন্য ট্রেন ধরল। সাথে ছিল গণেশ।
সব শুনে ফরাক্কা থানার ডিউটি অফিসার অনিন্দ্যকে বললেন, আপনি তো বলছেন যে আপনি নিজে আপনার বাবাকে ডাউন কামরূপ এক্সপ্রেসে তুলে দিয়েছিলেন?
অনিন্দ্য বলল, হ্যাঁ।
ডিউটি অফিসার বললেন, তাহলে এখানে এসেছেন কেন? জি-আর-পিতে যান।
অগত্যা জি-আর-পি। সেখানে অফিসার বললেন, টিকিট নম্বরটা লাগবে।
গণেশ বলল, কেন? বড়বাবু কি শুধু টিকিট যে টিকিট ছাড়া হবে না?
অফিসার গণেশের দিকে লাল চোখে তাকালেন।
স্টেশন মাস্টার ভদ্রলোক সব শুনে ওদের একটু বসতে বলে অনিন্দ্যর বাবার নাম, টিকিট নম্বর, গাড়ির নাম, কোচ নম্বর, বার্থ নম্বর সব একটা কাগজে লিখে দিলেন। অনিন্দ্যকে বললেন, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব, কী হল, আমাকে জানাবেন।
জি-আর-পি অফিসার বললেন, বেশ কয়েকদিন হয়ে গেছে। কী ভাবে জি-ডি নেব?
অনিন্দ্য ছুটল স্টেশন মাস্টারের কাছে।
স্টেশন মাস্টার বলাতে তিনি জি-ডি নিলেন।
দিনের পর দিন যায়।
অনিন্দ্যর বাবার কোনও খোঁজ পাওয়া যায় না। ধীরে ধীরে কলকাতার বাড়ি আর ফরাক্কার কোয়ার্টার নিয়মমতো চলতে থাকে। শুধু কোথায় একটা ফাঁক থেকে যায়। শুধু অনিন্দ্যর মা থেকে থেকেই বলে ওঠে, কে? কে? তার মনে হয়, দরজায় বেল বাজছে। আর, অনিন্দ্যরও জি-আর-পি থানায় যাওয়ার দিন আস্তে আস্তে কমে।
এরকমই একদিন, ফরাক্কার চরে যখন কাশফুল ফুটে উঠেছে থরে থরে, ক্যালেন্ডার জানিয়ে দিচ্ছে আবার পুজো আসছে, অনিন্দ্যর কোয়ার্টারের বেল বেজে উঠল।
অনিন্দ্য বেরিয়ে দেখে মকবুল, স্টেশনের বাইরে ওর চায়ের দোকান আছে।
মকবুল বলল, স্যার, একটু আমার দোকানে আসবেন?
অনিন্দ্য বলল, কী হয়েছে, মকবুলদা?
মকবুল কিছু বলার আগেই পাশের কোয়ার্টার থেকে অনিন্দ্যর সিনিয়র জয়ন্তদা বাইক নিয়ে বেরিয়ে এল। বলল, চল না। মকবুল আমাকেও যেতে বলেছে।
এই ছোট জনপদে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের বাবার হারিয়ে যাওয়ার খবর অনেকেই জানে।
মকবুলের দোকানে বসেছিল একজন গ্রাম্য মানুষ। তাকে দেখিয়ে মকবুল বলল, এ হচ্ছে আরিফ ভাই। গণকরে থাকে। বহুদিন পর এদিকে এসেছে। আরিফ ভাই, এবার আপনি বলেন।
লোকটা বলল, বাবু, এদিক থেকে যেতে গেলে গণকর এস্টেশনের আগে রেল লাইনের পেরায় দু’কিলোমিটার দূরে একটা বিল আছে। দিনের বেলা টেরেন থেকে আবছা দেখা যায়। বিলটার দোষ আছে গো। দিনমানেও কেউ ওদিক পানে একা যায় না। রাতে তো কথাই নেই।
মকবুলদা এরই মধ্যে সবার হাতে চায়ের গ্লাস ধরিয়ে দিয়েছে।
লোকটা চায়ে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে বলল, তা গতবছর আপনাদের দুগ্গাপুজার শেষ দিনে ওই বিল থেকে বুড়বুড়ি উঠতে লাগল। পাঁচ-ছ’জন গেছিল ওদিকে, তারা দেখল। একটা ব্যাগও ভেসে উঠছিল। তারা তো ভয় পেয়ে ফিরে এসে সবারে বলল। পঞ্চায়েতও শুনল। প্রধান সবাইকে নিয়ে গেল দেখতে। বিলের জলে তখনও বুড়বুড়ি কাটছিল। লোকেরা বলল, ডাইনটা আবার কাউকে খেয়েছে। প্রধান বকা দিল। সে আপনাদের মতো লেখাপড়া জানে গো, হাইস্কুলের মাস্টার। প্রধান থানায় খবর দিল। থানা তো দায়িত্ব নিতেই চায় না। শেষে প্রধানের ধ্যাতানি খেযে কাজে লাগল। কোমরে দড়ি বেঁধে লোক নামাল। একটা মানুষ পাওয়া গেল গো। গায়ে কাদাপাঁক লেগে থাকলেও মানুষটা যে ধবধবে ফর্সা ছিল, তা’ বোঝা যাচ্ছিল। সাথে উঠল একটা ব্যাগ। তাতে আপনাদের ফরাক্কার দোকানের নাম লেখা৷
অনিন্দ্যর গ্লাসের চা চলকে পড়ল জামায়। ওর বাবাও তো ধবধবে ফর্সা, তাই ডাক নাম গোরা। ওর বাবার হাতেও তো ছিল ফরাক্কার নামী কাপড়ের দোকানের ব্যাগ, যাতে ছিল বৌদির জন্য পিওর মুর্শিদাবাদি সিল্ক, দাদা আর বাবার গরদের পাঞ্জাবীর কাপড়, বুঁচকির বাহারি জামা, মা’র পছন্দের শাড়ি আর খাঁটি গাওয়া ঘি, যা ঘোষবাড়ি থেকে ও নিজে নিয়ে এসেছিল।
জয়ন্তদা ওর পিঠে হাত রেখে বলল, আরে, ঘাবড়াচ্ছিস কেন? ফরাক্কার দোকানের নাম লেখা ব্যাগ মানেই তো সবকিছু নয়। চল, গিয়ে দেখি।
তারপর মকবুলদাকে বলল, মকবুল, তুমি ভাই একটু কাজ কর। একটা কাগজ দাও, যা লিখব তাতে, সেটা আমার বাড়িতে পৌঁছে দেবে। একটা গাড়ি ঠিক করে দাও, যাতে আমরা গণকর যাব আর ফিরে আসব। ততক্ষণ আমার বাইকটা তোমার এখানেই থাকবে।
গণকরের বিলে তখন আর কোনও বুড়বুড়ি কাটছিল না। বিলের সামনে দাঁড়িয়ে অনিন্দ্য, জয়ন্তদা, আরিফ ভাই, পঞ্চায়েত প্রধান আর কিছু হুজুগে মানুষ।
থানা থেকে পাওয়া গেল সেই ব্যাগ। চেনটানা ব্যাগে সব জিনিসই আছে, শুকনো কাদা নিয়ে। থানার ফাইলে বাবার জলে ফোলা শরীরের ছবি।
অনিন্দ্য কোনও রকমে বলল, আমার বাবা। ভেঙে পড়ল কান্নায়। জয়ন্তদা ওকে জড়িয়ে ধরল।
অফিসার বললেন, পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী ওনার মৃত্যুর কারণ, নিউরোজেনিক শক। উনি এমন কিছু দেখেছিলেন যাতে আতঙ্কে মারা যান। অফিসার একটু থেমে আবার বললেন, কিন্তু, উনি কী এমন দেখলেন যাতে নামলেন ওখানে? কে ডাকল ওনাকে? আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি সেদিন ডাউন কামরূপ ওখানে দাঁড়িয়ে যায়। কোনও এক অজানা কারণে গণকর স্টেশনের সিগন্যাল সিস্টেম ঐ জায়গার কাছে হঠাৎ করে কাজ করছিল না। একটু পরেই আবার আপনা থেকে সব ঠিক হয়ে যায়। আমার এত বছরের চাকরি জীবনে এরকম ঘটনা এই প্রথম। আমি নিজেই এখনও ভেবে যাচ্ছি, উনি কেন নামলেন ওখানে? কেন? অজানা পথ দিয়ে অতদূর গেলেনই বা কীভাবে? কিসের টানে? কে ডাকল ওনাকে? কে? কে?
একটি সত্যি ঘটনার ছায়ায়