Categories
পুরনো পরগণা |

কিচকি পাখির গল্প

350 |
Share
| ১৮ জানুয়ারী, ২০২৩
শচীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

ঔপন্যাসিক ও গল্পকার, বঙ্কিম পুরস্কারপ্রাপ্ত

আঁকা: পার্থরঞ্জন দাশ

আমার তিন বছরের নাতনী আমাকে ‘দাদাই’ বলে ডাকে। হঠাৎ সে এসে একদিন বললে, দাদাই, আমাকে
কিচকি পাখির গল্প বলো৷

কিচকি পাখি!

আমি তো হতবাক। জীবনে এমন পাখির নামও শুনিনি। আমি কেন, আমার বাপ-ঠাকুর্দারাও শুনেছিলেন কিনা সন্দেহ! আমাদের শহুরে ঘরের পাশে তিনরকম পাখি দেখা যায়, কাক, চড়ুই আর শালিখ। কিন্তু এদের নাম উল্লেখ করায় সে সন্তুষ্ট হলো না৷ তবে কি আশেপাশের কোনো বাড়িতে খাঁচায় বন্দী টিয়া, কি ময়না, কি কোকিল দেখেছে? না কি, দেখেছে আকাশপথে উড়ে যাওয়া কোনো বকের পাঁতি? না, তা-ও নয়। এসব নামে সে কর্ণপাত করলো না। তার ঐ এক আবদার, কিচ্কি পাখির গল্প বলো। এই কিচ্কি পাখি কেমন দেখতে, কোথায় সে দেখেছে, এসবের সদুত্তর দিতে সে নারাজ, তার গোঁ একটাই, কিচকি পাখির গল্প বলো।

এইখানে একটা কথা বলা দরকার। আমার নাতনী সব গল্প শোনে না, গল্প তার মনের মতো হওয়া চাই। আমি যে নিজের ইচ্ছেমতো গল্প বানিয়ে যাবো, তা হবে না। এরকম কতো গল্প তাকে বলতে গিয়ে যে হোঁচট খেয়েছি, তার লেখাজোখা নেই। সত্যি কথা বলতে কী, জীবনে গল্প কম লিখিনি, কিন্তু এরকম জবরদস্ত সমালোচকের পাল্লায় কখনো পড়িনি। দেখক হিসাবে আমার সংকট হলো এই যে, ‘কিচ্কি পাখি’ বলতে সে মনে কী ধারণা করে রেখেছে, তা আমার জানা নেই। যদি তার ধারণার সঙ্গে আমার ধারণা না মেলে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই সে আমাকে থামিয়ে দেবে, বলবে, এঃ! ভালো না! পচা! বলা বাহুল্য, এরকম কতো গল্প যে মাঝপথে ‘পচা’ মার্কা পেয়ে কাগজের ঝুড়িতে বাতিল হয়ে পড়ে গেছে, তা আর কী বলবো!

এবার তাই অনেক সাবধানে, অনেক ভেবেচিন্তে আমাকে বানাতে হলো, গঙ্গা আছে না? বিরাট গঙ্গা?

‘বিরাট’ শব্দটার ওপর বেশ একটু জোর দিয়ে কথাটা বললাম৷ মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি, কাজ হয়েছে। চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে বললে, আবাই?

এটিও আমার নাতনীর নিজস্ব শব্দ। ‘আবাই’ মানে ‘আবার’। যেটা তার পছন্দ হবে, সেটা সে অনেক সময় আবার শুনতে চাইবে। সেজন্য তার ‘আবাই’ লেখক হিসাবে আমার কাছে উৎসাহব্যঞ্জক। কথাটা আবার আওড়ালাম। চোখদুটো বড়ো বড়ো করেই সে শুনলো। মনে হলো, ‘গঙ্গা’কে সে পছন্দ করেছে। গত বছর সে তার বাপমার সঙ্গে ট্রেনে চড়ে অনেক দূরে বেড়াতে গিয়েছিল, পথে গঙ্গা অর্থাৎ আমরা যাকে ‘বড়ো গঙ্গা’ বলি, তা তাকে পার হতে হয়েছিল, হয়ত তখনই জিজ্ঞাসা করে জেনে নিয়ে ছিল ‘গঙ্গা’ নামটা। তার আবার ‘এটা কী, ওটা কী’ করে প্রশ্নের বাই আছে।

‘গঙ্গা’ তার পছন্দ হওয়ায় আমি উৎসাহ পেয়ে শুরু করলাম, সেই গঙ্গার ধারে, মাটির মধ্যে একটা গর্ত ছিল, ইয়া বড়ো গর্ত!
এটা লেখক হিসাবে আমার মার-প্যাঁচ। ‘বিরাট’, ‘ইয়া বড়ো’ প্রভৃতি শব্দ সুবিধামতো ব্যবহার করে কচি পাঠিকার মনোযোগ আকর্ষণ করা আর কী! দেখলাম, আমার কায়দা ব্যর্থ হচ্ছে না, সে গালে হাত দিয়ে আমার দিকে সেইরকম চোখ বড়ো করে তাকালো। এবার সে ‘আবাই’ বললো না বটে, কিন্তু গল্পের প্রতি যে সে আকৃষ্ট হচ্ছে, এটা তার ভাবভঙ্গিই বুঝিয়ে দিচ্ছে।

বললাম, সেই গর্তের ভেতরে দুটো কিচ্কি পাখি থাকতো।
এই ‘কিচ্কি পাখি’ যে কী, তা গল্প লেখক না জানলেও পাঠিকা জানে। তাই এতে সে আপত্তি করলো না, কিন্তু লেখককে নাজেহাল করবার মতো মারাত্মক এক প্রশ্ন করে বসলো, কেমন করে?
অর্থাৎ ‘গর্তের মধ্যে’ কেমন করে তারা থাকতো৷ যে অধিবাসীদের স্বরূপ জানি না, তারা যে কেমন করে থাকতো, তার উত্তর দিতে গিয়ে ঢোঁক গেলা ছাড়া উপায় কী? কিন্তু ভয়ও আছে৷ যদি সে বলে বসে ‘পচা’, তাহলে? গল্প লেখককে সঙ্গে সঙ্গে পাততাড়ি গুটোতে হবে৷ তাই তাড়াতাড়ি মরিয়ার মতো বলে উঠলাম, এই যেমন করে সবাই ঘরের মধ্যে থাকে আর কী!
সে গাল থেকে হাত নামালো, একটু যেন গম্ভীর দেখাচ্ছে তার মুখ। বললে, আবাই?
অর্থাৎ বাক্যটাকে আবার আওড়াতে হবে। বোধহয় ‘গর্ত’ আর ‘ঘর’ এই দুটোকে সে মনে মনে মিলিয়ে দেখতে চাইছে। ভয়ে ভয়ে আবার বললাম কথাটা। শুনে সে কোনো বিরূপ মন্তব্য করলো না। ভরসা পেয়ে বলতে আরম্ভ করলাম, একদিন সকালবেলা? তারা গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে উড়তে শুরু করলো। উড়তে উড়তে একটা গাছের ডালে গিয়ে বসলো।
কী গাছ?
খুব বুড়ো একটা গাছ।
তাপ্পর?
বললাম, সেই গাছের ডালে বসে তারা নিশ্চিন্তে গান গাইতে লাগলো৷
বলেই আবার শঙ্কিত হলাম। আমার নাতনীর কিচ্কি পাখিরা গানটান গায় তো? কিন্তু সেদিকে সে গেল না, বলে বসলো, ওদের মাম্-মাম্ নেই?
বলা বাহুল্য, ‘মাম্-মাম্’-এর অর্থ ‘মা’৷
বললাম, কী করে থাকবে? ওরা বড়ো হয়ে গেছে না?
‘বড়ো হয়ে গেলে মাম্-মামরা থাকে না’, —এ দার্শনিক মন্তব্যে সে আপত্তি করলো না। হয়তো কথাটা তার পক্ষে একটু দুর্বোধ্য, কিন্তু বড়ো পাঠক-পাঠিকারা যেমন এরকম একটু আধটু দুর্বোধ্য দার্শনিকতায় খুশি হয়ে মনে মনে লেখককে তারিফ করে, ভাবে, ‘দেখেছো’, লোকটা কী পণ্ডিত’, তেমনি আমার তিন বছরের পাঠিকাও আমাকে বেমালুম মেনে নিলো।
বলতে লাগলাম, ওরা গানটান গেয়ে আবার উড়ে গেল, খাবার টাবার খেতে হবে তো? নইলে পেট ভরবে কিসে? ওদেরও তো খিদে পায়?
এ প্রশ্নে মাথা নাড়লো, অর্থাৎ, হ্যাঁ, খিদের কথাটা ঠিক। এমন গভীরভাবে মাথা নাড়লো যে, গ্রামের মোড়লদেরও হার মানায়! তারা যেমন করে বলে, ‘হ্যাঁ, একথা ঠিক৷ একথা জজে মাইন্বে!’ আমার নাতনী যেন নিজের মনে সেইরকম করেই বিড়বিড় করলো। আমারও যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো। ভয় ছিল, যদি জিজ্ঞেস করে বসে, ‘কী খায়?’— তাহলেই তো গেছি! কিচ্কি পাখি যে কী তাই জানিনা, তার ওপর তারা কী খায় তা জানবো কী করে?
বললাম, এইবার? পেট ভরেছে তো? তারা এইবার একটু খেলতে লাগলো৷
কেমন করে?
উড়ে উড়ে। ওরা পাখি তো? উড়ে উড়ে ছাড়া খেলবে কী করে?
গঙ্গার ওপর দিয়ে উড়ছে দুটি ডানা মেলে। কেমন সুন্দর নৌকা যাচ্ছে গঙ্গার ওপর দিয়ে, পাল তুলে—
—এইবার খেলাম এক ধমক। একেবারে খাঁটি ‘ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া’। সমালোচকের ধমক। বললে, নৌকো নয়, ইস্টিমার, জিক্ জিক্ করে তারা যায়!
ঠিক! ইস্টিমার! ঝিকঝিক করে তারা গঙ্গার ওপর দিয়ে যাচ্ছে!
—তাপ্পর?
বললাম, খানিকক্ষণ পরে, খেলাধুলো ক’রে, তারা তো তাদের ঘর, অর্থাৎ ‘গর্ত’-এর কাছে ফিরে এলো। ভিতরে ঢুকতে যাবে, এমন সময় দেখে কি তাদের ঘর অর্থাৎ ‘গর্ত’ বেদখল করে তার মধ্যে শুয়ে আছে ইয়া বড়ো একটা সাপ!
সঙ্গে সঙ্গে চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল আমার পাঠিকার। ভয় হলো। এই রে! এইবার বুঝি জিজ্ঞাসা করে বসবে, ওদের ঘরে বাইরে থেকে হুট করে লোক এসে, থুড়ি, সাপ এসে ঢুকলো কী করে? কিন্তু না, শহরবাসী বাঙালীর মতো সাংঘাতিক ব্যাপারটাকে অবলীলায় এড়িয়ে গিয়ে সে অন্য প্রশ্ন করলো। বললে, কী রকম সাপ? টি-ভি-র মতো?
আমার তিনবছরের পাঠিকা ইতিমধ্যে চিড়িয়াখানা ঘুরে এসেছে, সেখানে খাঁচার ভিতরে সে সাপ দেখেছিল কিনা কে জানে, কিন্তু তার মনে যে সাপ ছাপ ফেলেছিল, সে বোধহয় টিভিতে দেখানো কোনো সাপের ছবি। বললাম, হ্যাঁ। ঠিক বলেছে। একেবারে টি-ভির মতো।
সেইরকম ফোঁস করে?
অবিকল! একেবারে সেই রকম ফোঁস করে।
তাপ্পর?
বললাম, কিচ্কি পাখিদের কিচ্মিচ্ শুনে সাপটা ফোঁস করে উঠলো, যেন বললো, এই কে রে! বিরক্ত করছিস?
কিচ্কি পাখি দুজন ভয়ে উড়ে পালালো। বসলো গিয়ে গাছের ডালে। এখন তারা কী করবে? কোথায় থাকবে? তাদের গর্তে যে শুয়ে আছে ইয়া বড়ো এক সাপ! ওখানে গেলেই তো তাদের খেয়ে ফেলবে! তারা কাঁদতে লাগলো৷ এতো কষ্ট করে নিজেদের দেশেই, একটা ঘর বানালাম গঙ্গার ধারে, সেটা কি না নিয়ে নিলো ঐ পাজী সাপটা। এখন কী হবে! কোথায় আমরা যাবো? কোথায় থাকবো?
—তাপ্পর?
বললাম, এখন হয়েছে কী, সেই সময় একটা কাক বসে ছিল ঐ গাছের ওপরের ডালে। একেবারে অনেক ওপরে।
ছাদের ওপর?
বললাম, হ্যাঁ, তা বলতে পারো। ওটা যখন গাছের মাথা, তখন ওটাকে গাছের ছাদ বলতে কোনো বাধা নেই।
কাকটা গাছের ছাদে গেল কেন?
বললাম, কাকদের ধরনই ঐরকম। ‘পণ্ডিত কিনা! একটু উঁচুতেই থাকতে ভালোবাসে।
আবাই?
এই মরেছে! দুবার শুনতে চাইছে কেন? ঐ ‘পণ্ডিত’ শব্দটাই কি খট্কা বাঁধালো? যাই হোক, নির্দেশ মতো আওড়ালাম কথাটা। মন দিয়ে শুনলো, চিন্তান্বিত ভঙ্গিমায় বললো, আন্তির মতন?
আন্তি বোধহয় ‘আন্টি’, নার্সারি স্কুলের বাচ্চারা যাঁদের ‘আন্টি’বলে, তাদের কথাই বোধহয় বোঝাতে চাইছে। আমার নাতনী এখনের নার্সারিতে ঢোকে নি, তবে তাকে ঢোকাবার জোর চেষ্টা চলছে। এরই সূত্র ধরে ‘আন্টি’ কথাটা হয়ত তার কানে গিয়েছিল কোনো সময়। ‘নতুন নতুন শব্দ’ ওর মনে রাখবার প্রয়াস খুব। বললাম, হ্যাঁ, ঠিক বলেছো। আন্টির মতন। বাচ্চাদের কান্না শুনলে আন্টিরা যেমন ছুটে আসে, তেমনি করে কাকটা উঁচু থেকে নিচুতে নেমে এলো, বললে, কাঁদছো কেন?
ওরা কাঁদতে কাঁদতে বললে, আমাদের ঘর নিয়ে নিয়েছে।
কে?
সাপ।
কই, চলো তো দেখি?
ওরা তিনজনে উড়ে এলো সেই গর্তের কাছে। ওদের সাড়া পেয়ে সাপটা আবার ফণা তুলে, ফোঁস করলো, বললো, কে রে? ফের এসেছিস?
এবার কাক গম্ভীর গলায় বললে, ওদের ঘর নিয়ে নিয়েছো কেন?
সাপটা মুখ তুলে তাকালো, জিভ তার লকলক করতে লাগলো। চোখ জ্বলজ্বল করতে লাগলো। ভাবখানা এই, আমাকে দেখছো তো? আমার গায়ে জোর আছে, জিভে বিষ আছে ‘আমাকে ঘাঁটিয়ো না’। হয় জোর করবো, নয় বিষ ঝাড়বো। আমাকে এর থেকে হটায় কে? এ ঘর আমার পছন্দ হয়েছে না? ভাগো এখান থেকে! জল্দি!
টাকাওয়ালা আর ক্ষমতাওয়ালা লোকের হুঙ্কারের মতো সাপটা এমন ফোঁস করলো যে ওরা ভয় পেয়ে ওখান থেকে তাড়াতাড়ি সরে গিয়ে আবার গাছের ডালে বসলো। কাকের মুখখানা খুবই গম্ভীর দেখাচ্ছে, বললে, দুঃখিত। তোমাদের জন্য কিছুই করতে পারলাম না। এদের গায়ে হাত দেবে কে?
আমার নাতনীর এসব কথা হবহু বোঝবার বয়স নয়, কিন্তু ঘটনা একটা ঘটেছে, তার কিচ্কি পাখিরা ঘর হারিয়েছে, এই দুঃখে সে মুহ্যমান, তাই কোনো মন্তব্য করলো না, শুধু ,বললো— তাপ্পর?
বললাম, তারা তো আবার কাঁদতে লাগলো, কাক বললে, কেঁদে কী করবে! ভগবানকে ডাকো, আমাদের কিছু করবার নেই। তিনি যদি কিছু করতে পারেন!
আমার নাতনী এবার প্রশ্ন করলো, ভগবান কোথায় থাকে?
একেবারে মোক্ষম প্রশ্ন! বললাম, ঠিক এই কথাই কিচ্কি পাখিরা জিজ্ঞাসা করলো কাককে, ভগবান কোথায় থাকে?
কাক বললে, কেন?
ওরা বললে, আমরা যাবো ভগবানের কাছে। তাঁকে সব বলবো।
কাক পণ্ডিত লোক। ভেবেচিন্তে বললে, ভগবান তো সব জায়গাতেই থাকেন বলে শুনেছি। কিন্তু কখন যে কোন্ জায়গায় থাকেন, তা বলা বড়ো মুশকিল। জলে, জঙ্গলে, আকাশে—
পাখিরা বলে উঠলো, আমরা আকাশে উড়বো। আপনি আমাদের সঙ্গে চলুন। আমরা তো ভগবানকে চিনি না, আপনি চিনিয়ে দেবেন।
বেশ, চলো।
বলে, তারা তিনজনে আকাশে উড়লো।
এইসময় আমার নাতনী মুখ ফেরালো জানালার দিকে। আমার ঘর থেকে আকাশের কিছু অংশ দেখা যায়। নাতনী কী মনে করে হঠাৎ উঠে জানালার শিক ধরে দাঁড়ালো, বললে, দাদাই, একটা প্লেন যাচ্ছে।
বলালাম, তা যাক। তুমি আমার কাছে এসো। গল্প শুনবে না?
শুনবো।
বলে, আবার আমার কাছে এসে বসলো। বললাম, ওরা তিনজন তো আকাশে উড়লো। কাক ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল। জানো তো, যা আমরা জানি না, পণ্ডিতরা তা জানতে পারে। কাক ঠিকই আন্দাজ করেছিল। ভগবান তখন আকাশেই ছিলেন। কিন্তু তবু দেখা হলো না। কেন জানো? ভগবান তখন ঘুমোচ্ছিলেন। দুপুরবেলা তো? তুমি যেমন দুপুরবেলা মাম্মামের কাছে ঘুমোও, ভগবানও তেমনি ঘুমোচ্ছিলেন। ওরে বাবা! ভগবান বলে কথা! তাঁর ঘুম তখন ভাঙাবে কে? তাই বাধ্য হয়ে ওরা ফিরে এলো। এখন কী করা যায়? কাক বললো, যা হয় তোমরা করো, আমি চললাম, আমার কাজ আছে।
বলে, কাক তো চলে গেল।
—তাপ্পর?
এইখানে আমি একটুক্ষণ চুপ করে রইলাম। কারণ, এই-ই আমার গল্পের যাকে বলে, ‘সংকট মুহূর্ত!’ ভগবান স্বয়ং যখন ঘুমে ঢলে পড়েছেন, তখন আমি সাধারণ এক লেখক, কী-ই বা করতে পারি? যদি মনের মতো না হয়, তাহলে আমার পাঠিকা তৎক্ষণাৎ আমাকে নাকচ করে দেবে।
তাপ্পর বলো না? কী হলো?
ঘনঘন তাগিদে অস্থির হয়ে গেলাম। অসহায়ের মতো বলে উঠলাম, তাই তো! কী করা যায় বলো তো? ভগবানও ঘুমোচ্ছেন। আর ওদিকে পণ্ডিতমশাইও পাততাড়ি গুটিয়ে হাওয়া হয়েছেন! কিচ্কি পাখি দুটো এখন কী করে বলো তো? ঘরে ঢুকবে কী করে?
নাতনীর কিন্তু ভাবতে বেশি সময় লাগলো না, সে বলে উঠলো, বাবাই তোমাকে একটা লাঠি দিয়েছে না? সেই লাঠিটা কিচ্কি পাখিদের দাও না? সাপটাকে গিয়ে খোঁচা দিক।
ওরে বাবা! খোঁচা খেয়ে সাপটা আরও রেগে যাবে! রেগে গিয়ে যদি কিচকি পাখিদের খেয়ে ফেলে!
এ সম্ভাবনার কথা আমার পাঠিকার একেবারেই মনে হয় নি। সে চোখ দুটি বিস্ফারিত করলো। সে চোখে ভয়ের ছাপ!
কিন্তু তার লাঠির কথায় আমি যেন একটা পথরেখা দেখতে পেলাম! এই কিচ্কি পাখিরা কী ধরনের পাখি জানি না, তারা ছোট পাখি, না, বড়ো পাখি, তাও জানি না। শুধু এটুকু বুঝতে পারছি, তারা তো মাত্র দুটি প্রাণী নয়, কিচ্কি পাখি আরও আছে।
এরা যদি উড়ে উড়ে গিয়ে তাদের সবাইকে ডেকে নিয়ে আসে, আর তারা ওদের ডাক শুনে যদি হাজারে হাজারে ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসে, তাদের ধারালো ঠোঁট দিয়ে যদি একযোগে আক্রমণ করে, তাহলে পরের ঘর-দখলকারী শয়তান সাপটা যাবে কোথায়?
অজস্র ঠোঁট আর নখের প্রহারে জর্জরিত হয়ে তাকে লেজ গুটিয়ে পালাতে হবে না? বাঃ! তাহলে এই তো দেখছি সমাধান! কিন্তু এভাবে গল্প শেষ হলে আমার তিন বছরের ছোট্ট নাতনীটি কি বিশ্বাস করবে? যদি না করে তাহলে?
ভাবলাম, ‘ভগবান’ যখন পেয়েছি, তখন ভগবানের তথাকথিত ‘গরুড়পক্ষী’ তো আছে। গরুড় পক্ষীরা তো সাপ খায়! সাপেরা তো ওদের ভয় পায় খুব! এই কিচকি পাখিরা যদি হাজারে হাজারে গিয়ে ভগবানের ঘুম ভাঙায়, আর যদি তিনি ওদের প্রার্থনা শুনে তাঁর সেই ‘গরুড়পক্ষী’টিকে পাঠিয়ে দেন, তাহলে তো আর কোনো গোলই থাকে না!
কিন্তু আপনারা বিশ্বাস করুন, আমার তিন বছরের নাতনী গরুড় বা ভগবানের গল্পে কোনোই আস্থা স্থাপন করলো না, তার পছন্দ হয়ে দাঁড়ালো ঐ আগের সমাধানটা! অর্থাৎ, পাখিরা হাজারে হাজারে ঝাঁকে ঝাঁকে একযোগে গিয়ে পড়লো সেই পর ঘর-লোলুপ শয়তান সাপটার ওপর, আর তাকে প্রহারে প্রহারে জর্জরিত করে তাড়িয়ে দিলে।
আর সাপটা যখন মুখ লুকিয়ে পালিয়ে গেল, তখন আমার নাতনীটি আনন্দে যেন লাফিয়ে উঠলো! আমি ওর চোখের দিকে তাকালাম। আমি বুড়ো মানুষ, এবার আমারই অবাক হবার পালা!