‘কুকুর হইতে সাবধান!’— এই ধরনের সাইন বোর্ড আমরা যেকোনও বাড়ির দরজায় যাতায়াতের পথে দেখে থাকি। এখন প্রশ্ন হল, কুকুর কি বাঘ-সিংহ যে সাবধান হতে হবে তাদের থেকে? আমি এখন যে কুকুরের গল্প বলব তার নাম হল কুতুয়া। কুতুয়া ছিল একটি তিব্বতি কুকুর, যার প্রজাতি ‘লাসা অ্যাপসো’। আমরা সবাই জানি তিব্বত খুব ঠান্ডা একটি জায়গা। সেখানকার বাসিন্দা হয়ে কুতুয়া যে কলকাতার এই গরমে দীর্ঘ এগারো বছর কাটিয়ে দেবে সেটা আমরা ভাবতে পারিনি। কুতুয়াকে পাওয়ার ঘটনাটাও ভারী অদ্ভুত!
আমি ছোট থেকেই একটি যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি, যেখানে অ্যাকোয়েরিয়ামে রঙিন মাছ, ছাদে নানারকম ফুলের গাছ ছিল। সেগুলোর নিয়মিত যত্ন নিতেও দেখেছি বাবা-কাকাদের। আমার বরাবর ইচ্ছে ছিল একটি কুকুর পোষার। কিন্তু বাড়িতে বড় কাকিমাকে বাদ দিয়ে প্রায় সবাই বলেছিল বাড়িতে কুকুর আনলে আমাদের দু’জনকেই বাড়ির বাইরে থাকতে হবে। আমার বড় কাকিমা একটি স্কুলে পড়াতেন এবং উনি ছিলেন আদ্যোপান্ত এক পশুপ্রেমী। তাঁরও ইচ্ছে ছিল যে বাড়িতে একটি কুকুরের আগমন হোক। কিন্তু বাকি সকলের ফরমান শোনার পর, তাঁরও সাহস হয়নি যে কাউকে না জানিয়ে হঠাৎ করে বাড়িতে একটি কুকুর নিয়ে আসেন।
আমি যখন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন হঠাৎই এক দুপুরে কাকিমা স্কুল থেকে এসে আমাকে জানান যে তাঁর স্কুলের উল্টোদিকেই ইনফ্যান্ট জেসাস চার্চ-এর ফাদার ওঁকে ডেকেছিলেন। তাঁর কাছে কেউ একটি কুকুরছানা দিয়ে গেছে, যাকে তিনি এমন কারও হাতে তুলে দিতে চান যে ওর কোনও অযত্ন করবে না। তিনি সরাসরি কাকিমাকে বলেন যে, ‘তুমি ওকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে বড় করে তোলো।’ এদিকে কাকিমার সাহসই হয়নি যে কাউকে না জানিয়ে কুকুরছানাটাকে বাড়িতে নিয়ে আসবেন। অগত্যা আমাকে এসে বলেন আর আমি শোনামাত্রই পড়াশোনা ছেড়ে কাকিমার সঙ্গে সোজা চার্চে চলে যাই। এই ব্যাপারটা বাড়িতে দাদু ছাড়া আর কাউকে বলার সাহস হয়নি এই ভয়ে যে বাকিরা জানতে পারলে বাড়ি থেকে বেরতেই দেবে না। যাই হোক, চার্চে পৌঁছে দেখি ফাদারের ঘরে একটি বেতের ছোট্ট ঝুড়ির মধ্যে সাদা তুলোর বলের মতো একটি কুকুরছানা, যার শুধু চোখ দু’টো আর নাকটা কালো। দেখেই বললাম, আমি একে বাড়ি নিয়ে যাব, কপালে যাই থাক। ফাদারও খুব খুশি। আমরাও আর সময় নষ্ট না করে ওকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবতে লাগলাম এর পর বাড়ি ঢুকে কী যুদ্ধটাই না হবে! কিন্তু কোথায় কী! বাড়ি ঢোকার পর কোলে কুকুরছানা দেখে প্রথমে সবাই অবাক! তারপর মুহূর্তেই সবাই বলে উঠল, ‘ওমা! কী সুন্দর!’ ব্যাস, নিমেষেই আমার আর কাকিমার ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে গেল। কিন্তু বিপদ তখনও কাটেনি, কারণ তখনও বাবা-কাকারা অফিস থেকে বাড়ি ফেরেনি। সবচেয়ে বড় বিপদ এরপরই হওয়ার কথা। কিন্তু তাঁরাও বাড়ি ফিরে সবাইকে অবাক করে দিয়ে কুকুরছানাটিকে দেখে একটুও রাগ করলেন না। শুধু বললেন, ‘পশু চিকিৎসক দেখিয়ে নিও। ওর সমস্ত ওষুধ, ভ্যাকসিন ইত্যাদির যেন গাফিলতি না হয়!’ আমার আর কাকিমার আরও একবার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল।
এরপর আমরা কুতুয়াকে এক নামকরা পশু চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর জানতে পারি যে ও একটি ‘লাসা অ্যাপসো’ প্রজাতির কুকুর, যারা ঠান্ডায় থাকতে পছন্দ করে। ওর খাবারের চার্ট এবং ওষুধ সব জেনে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। ইচ্ছে ছিল কখনও কুকুর পুষলে তার নাম রাখব কুতুয়া। এই নামটা অ্যাস্টারিক্সে ছোটবেলায় পড়েছিলাম, সেই নামটাই রাখলাম। শেষমেশ ইচ্ছে পূরণ হল।
কুতুয়া ‘লাসা অ্যাপসো’ প্রজাতির কুকুর ছিল যেহেতু, সেহেতু ওদের ব্যাপারে আমার কিছু কৌতূহল তৈরি হয়। পড়াশোনা করতে গিয়ে দেখি যে, তিব্বতের বৌদ্ধ মনাস্ট্রিগুলোয় এই কুকুরদের রক্ষী (গার্ড) হিসেবে পোষা হত। কেউ কেউ বলেন ‘অ্যাপ’ শব্দটির তিব্বতি মানে ‘ঘেউ-ঘেউ করা’ আর ‘সো’ শব্দটির অর্থ হল, ‘রক্ষা’ করা। অর্থাৎ যারা শব্দ করে রক্ষা করে। ইতিহাস বলে, খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় আটশো বছর আগে থেকেই তিব্বতের মনাস্ট্রিতে, গৃহে এই কুকুরদের পোষা হত। নিজস্ব এলাকায় অপরিচিত কেউ ঢুকলেই এরা ডাকাডাকি জুড়ে দিত, যার ফলে চোর বা অন্যান্য অনুপ্রবেশকারীদের সমস্যা হত। তিব্বতিরা বিশ্বাস করত যে, লামারা মৃত্যুর পর এবং পুনর্জন্মের আগে এই লাসা অ্যাপসোদের দেহে থাকত। তাই এই কুকুর তারা বিক্রী করত না। একে শুধুমাত্র উপহার হিসেবে দেওয়া যেত। তবে, বিশ শতকের প্রায় মধ্যভাগ থেকে এর বিক্রী শুরু হয়।
লাসা অ্যাপসোরা সাধারণত ১০.৭৫ ইঞ্চি লম্বা হয়। এদের ওজন হয় সাড়ে পাঁচ থেকে সাড়ে ছয় কেজি। এরা মূলত খয়েরি, সাদা ও ধূসর বর্ণের হয়। এরা খুবই বুদ্ধিমান এবং ভাল করে ট্রেইন করলে এরা শান্ত থাকে। কিন্তু ভাল করে ট্রেইন না করলে অপরিচিত ব্যক্তিদের প্রতি এদের আগ্রাসী মনোভাব প্রকাশ পায়। এরা বেশ সামাজিক, তাই এরা অন্যান্য কুকুরদের সঙ্গে মেলামেশা পছন্দ করে। লাসা অ্যাপসোদের গড় আয়ু ১২-১৪ বছর। এবার ফিরে যাই কুতুয়ার গল্পে।
কুতুয়া আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠতে লাগল। প্রথমে সেরেল্যাক, তারপর দুধ-পাঁউরুটি, কিছুদিন পর চিকেন স্টু এবং অবশেষে ডাল, ভাত আর মাংসের ঝোল খেয়ে তিব্বতি কুকুর আদ্যোপান্ত বাঙালি হয়ে উঠল। গরম লাগলে খাটের তলায় বা মেঝেতে চিৎপাত হয়ে শুয়ে নিজে নিজেই ঠান্ডার ব্যবস্থা করে নিত। বাড়িতে তখন এ.সি ছিল না আর কুতুয়াও কখনও আমাদের সে ব্যাপারে বিব্রত করেনি। বাড়িতে সবার প্রিয় হয়ে উঠেছিল ও অল্প সময়ের মধ্যেই। আবার নতুন চটি ছিঁড়ে দেওয়া বা ফার্নিচারের কোণ চিবিয়ে ফেলার মতো দুষ্টুমি করলে মারও খেত। শুধু দু’টো জিনিস আমরা কুতুয়ার জন্য বন্ধ করে দিয়েছিলাম— বেড়াতে যাওয়া আর কালী পুজোতে বাজি ফাটানো। কিন্তু তার বদলে ও আমাদের যে ভালবাসা দিয়েছিল তার কোনও তুলনা হয় না।
কুতুয়া কলকাতার গরমে দীর্ঘ এগারো বছর আমাদের সঙ্গে ছিল। আমাদের বাড়িতে আসার দিন থেকে চলে যাওয়ার দিন পর্যন্ত ও আমাদের বাড়ির সবাইকে কোনও কারণ ছাড়াই ভালোবেসেছে। সামান্য বিস্কুট বা এক টুকরো কেক দেখে কুতুয়া যে আনন্দ পেত, অনেক কিছু পেলেও বোধহয় অনেকে সেই আনন্দ পায় না। আমরা বাইরে থেকে বাড়ি ফিরলে কী করে যেন জেনে যেত যে বাড়ির লোক বাড়িতে ফিরেছে! তখন তার কী দৌড়োদৌড়ি! ল্যাজ নেড়ে, ঝাঁপিয়ে পড়ে আহ্লাদে আটখানা হয়ে যেত একেবারে! আমাদের জীবনের একটা বড় সময় কুতুয়া আনন্দে ভরিয়ে দিয়ে গেছে।
আমি কুকুর দেখে ভয় পাই না, যারা পায় তাদের বিদ্রূপও করি না। শুধু একটা জিনিস জানি ও বিশ্বাস করি যে, এমন সঙ্গী পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার যে তোমার জীবনটা কিছু সময়ের জন্য অনেকটা আনন্দে ভরিয়ে দেবে। আজকে আপাতত এই পর্যন্ত। আবার খুব শিগগিরি ফিরব নতুন সারমেয় সংবাদ নিয়ে কয়েকদিনের মধ্যে।