Categories
পুরাণপাড়া |

ক্যালিপ্সোর দুঃখগাথা

37 |
Share
| ২৮ জুন, ২০২৪
মানস শেঠ

চিত্রঋণ/ উইকিপিডিয়া

শান্ত দ্বীপ ওজিজিয়া৷ সেই দ্বীপে এসে থামল এক কাঠের ভেলা৷ প্রায় ন’দিন এভাবে ভাসতে ভাসতে ক্লান্ত ইথাকা রাজ্যের রাজা ওডিসিউস৷ দশ বছর ধরে চলা ট্রয়ের যুদ্ধশেষে রাজা ওডিসিউস ফিরে আসছিলেন নিজের দেশে৷ কিন্তু ছায়ার মতো লেগেছিল বিপদ৷ শেষ বিপদটাই অপেক্ষা করছিল সূর্য দেবতা হেলিওসের দ্বীপে৷ সেখানে বাস করত হেলিওসের সাত পাল ষাঁড় এবং ভেড়া৷

এই দ্বীপের পাশ দিয়ে যাবার সময় ওডিসিউসের সহচর ইউরিলোকুস অনুরোধ করল, রাতের খাবার তৈরি করার জন্য দ্বীপটিতে নোঙর ফেলতে৷ ওডিসিউস অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনুরোধটা মেনে নিলেন৷ কিন্তু তিনি তাঁর সব সহচরের কাছ থেকে প্রতিজ্ঞা আদায় করে নিলেন যে, কেউ পালের পশুদের কোনোরকম অনিষ্ট করবে না৷ তাহলেই বিপদ!

দ্বীপে নামার পরই শুরু হল ঝড়৷ টানা একমাস৷ সমুদ্র দেবতা পসেইডনের অভিশাপ ছিল এর পেছনে৷ একদিন ওডিসিউস দেবতাদের উদ্দেশে নিরিবিলিতে প্রার্থনা করার জন্য দ্বীপের ভেতরের দিকে চলে গেলেন৷ ঠিক সেই সময় প্রতিজ্ঞা ভেঙে ইউরিলোকুস বাকি সবাইকে রাজি করাল যে, দেবতাদের তুষ্ট করে ঝড় থামার জন্য পালের পশুগুলিকে বলি দেবার৷ যেমন বলা, তেমন কাজ৷ ওডিসিউস ফিরে এসে দেখেন, সর্বনাশ! ওদিকে সূর্য দেবতা হেলিওস রেগে আগুন৷ তিনি অন্য দেবতাদের বললেন, তাঁরা যদি এই পশুহত্যার প্রতিশোধ না নেন, তাহলে তিনি পাতালে গিয়ে মৃতদের উপর আলোকবর্ষণ করবেন৷ পৃথিবী থাকবে অন্ধকার৷

হেলিওসের কথা শুনে দেবতাদের রাজা যিউস বললেন, ওদের জাহাজ যখন সমুদ্রের মাঝে থাকবে, তখন তিনি জাহাজের উপর বজ্র দিয়ে আঘাত করবেন৷ জাহাজ চুরমার হয়ে যাবে, আর একজনও বাঁচবে না৷
ওডিসিউসরা দেবতাদের ফন্দির কথা জানত না৷ ঝড় থামলে তারা সমুদ্রে জাহাজ ভাসাল৷ আর ঠিকই জাহাজের উপর বজ্রপাতও হল৷ এতে ওডিসিউস ছাড়া সকলেই মারা গেল৷ ওডিসিউস ভাঙা জাহাজের টুকরো নিয়ে ভাসতে ভাসতে এসে পৌঁছলেন ওজিজিয়া দ্বীপে৷
ওজিজিয়া দ্বীপে তখন একা থাকত ক্যালিপ্সো৷ ক্যালিপ্সো একজন নিম্ফ৷ গ্রিক এবং ল্যাটিন পুরাণে বর্ণিত একটা নির্দিষ্ট এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত দেবীকে ::‘নিম্ফ’ বলা হত৷ ক্যালিপ্সো নামের অর্থ ‘লুকিয়ে রাখা’৷

হোমারের মহাকাব্য ‘ওডিসি’ থেকে জানা যায় যে, ক্যালিপ্সোর পিতা হলেন এটলাস এবং মা প্লাইয়োনি৷ যেহেতু ক্যালিপ্সো এই দ্বীপের নিম্ফ, তাই দ্বীপটিকে সুন্দর করে তোলার দায়িত্বও তার৷ নিজের বাড়িকে সে ভরিয়ে তুলেছিল বাগান আর ঝর্না দিয়ে৷
ওডিসিউস যখন ওজিজিয়াতে নামলেন তখন রাত্রিবেলা৷ তিনি হাঁটা শুরু করলেন দ্বীপের ভেতরের দিকে৷ কিছুদূর গিয়ে দেখলেন বিশাল গুহা৷ গুহাকে গরম রাখার জন্য জ্বলছে আগুন৷ বেশ দূরে রাখা আছে জুনিপার গাছের ফল থেকে পাওয়া তেল আর পাইন গাছের কাঠ৷ সেগুলো পুড়ে পুড়ে তৈরি করছে সুগন্ধ৷ এরই মাঝে ক্যালিপ্সো গান গাইতে গাইতে তার তাঁতে সোনার তৈরি মাকু দিয়ে কাপড় বুনে যাচ্ছে৷

ক্যালিপ্সো অসুস্থ ওডিসিউসকে দেখে তাঁর সেবা করল৷ ওডিসিউস সম্পূর্ণ সুস্থ হবার পর তারা দুজনেই খুবই বন্ধু হয়ে গেল৷ ওডিসিউস যেন কোনো নৌকা বানিয়ে দ্বীপ ছেড়ে চলে যেতে না পারেন, সেজন্য সমস্ত যন্ত্রপাতি ক্যালিপ্সো লুকিয়ে রাখল৷
এভাবেই কেটে গেল সাত বছর৷ পুরো ওজিজিয়া দ্বীপ জুড়ে ওডিসিউসের জন্য আনন্দদানের ব্যবস্থা হলেও, ওডিসিউস ইথাকার জন্যে অত্যন্ত টান অনুভব করতেন৷

বিশেষত, স্ত্রী পেনেলোপি আর দুই পুত্রের অভাব খুব বেশি বোধ করতে শুরু করেছিলেন ওডিসিউস৷ কিন্তু ক্যালিপ্সোকে তিনি বলতেও পারছিলেন না চলে যাওয়ার কথা৷ শেষে দেবী এথেনাকে মনের কথা বললেন ওডিসিউস৷
এথেনা গেলেন যিউসের কাছে৷ বললেন, তার ভক্ত ওডিসিউসকে ক্যালিপ্সো আটকে রেখেছে ওজিজিয়া দ্বীপে৷ সে এখন নিজের রাজ্য ইথাকায় ফিরতে চায়৷ কিন্তু ক্যালিপ্সো তাকে আসতে দিতে চায় না৷ ওডিসিউসকে সে অমরত্ব দিতে চায়৷ শুনে যিউস তাঁর দূত হারমিসকে বললেন, ক্যালিপ্সোকে গিয়ে বলো, একজন দেবী হিসেবে মরণশীল মানুষের সাথে আজীবন থাকাটা তার কাজ নয়৷
হারমিসের বলা কথাগুলো ক্যালিপ্সোকে খুশি করতে পারেনি৷

কিন্তু ক্যালিপ্সোর রাগ একসময় পড়ে এল৷ সে রাজি হল ওডিসিউসকে তার নিজের রাজ্যে পাঠাতে৷
শুধু তাই নয়, নৌকা বানানোর জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসও দিল সে৷ সমুদ্রপথে যেন কোনো সমস্যা না হয়, সেজন্য খাদ্য হিসেবে রুটিও দিয়ে দিল৷
এমনকী সমুদ্রের বাতাসকেও মৃদু আর যাত্রাপথের অনুকূল বানিয়ে দিল৷ ওডিসিউস তাঁর নৌকা ভাসানোর পর থেকে ক্যালিপ্সো আকুল প্রতীক্ষায় সমুদ্রের তীরে বসে থাকত৷ যদি তার হারানো বন্ধু আবার ফিরে আসে!
এভাবে থাকতে থাকতে ক্যালিপ্সো জীর্ণ, শীর্ণ হয়ে পড়ল৷
কিন্তু যে পথে ওডিসিউস গেছে, সে পথ থেকে সে চোখ সরাত না৷