Categories
পুরাণপাড়া |

গরুড়ের দর্পচূর্ণ

1327 |
Share
| ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০
কুলদারঞ্জন রায়

১৮৭৮-১৯৫০। শিশুসাহিত্যিক, মূলত অনুবাদক। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ভ্রাতা।

(বাঁদিক থেকে) প্রথম চিত্র: দক্ষিণ ভারতীয়, ১৮২৫। শিল্পী অজ্ঞাত। দ্বিতীয় চিত্র: গরুড় গজ-কচ্ছপের যুদ্ধ দেখছে। শিল্পী প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃতীয় চিত্র: গরুড় কৃষ্ণের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করছে। শিল্পী বি. রায়। ঋণ: Wikimedia Commons ও কাশীরামদাসের মহাভারত

গরুড় পাখির খাদ্য হল নাগ। তাই গরুড়ের নাম শুনলেই নাগরা ভয়ে ভয়ে থাকে। সেইজন্যই অনন্তনাগের পুত্র মণিনাগ এই ভয় কাটানোর জন্য স্থির করলেন তিনি শিবের তপস্যা করবেন। দিনরাত এক করে তিনি এমন কঠিন তপস্যা করলেন যে স্বয়ং মহাদেব উপস্থিত হয়ে তাঁকে বললেন ‘আজ থেকে আর কোনও ভয় নেই। গরুড় তোমাদের কোনও ক্ষতি করতে পারবে না।’

বর পেয়ে মণিনাগ ছুটলেন গরুড়ের বাসায়। সেখানে গিয়ে তিনি বাড়িতে না ঢুকলেও নির্ভয়ে আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতে লাগলেন। মণিনাগকে হাতের কাছে পেয়ে গরুড়ও ছাড়বার পাত্র নন, তিনি তাঁকে বাড়িতে বন্দি করে রাখলেন।

অন্যদিকে শিবের বাহন নন্দী অনেকক্ষণ মণিনাগকে দেখতে না পেয়ে, প্রভুকে গিয়ে বললেন ‘মণিনাগ যে গেল আর তো ফিরে এল না। তবে কি গরুড় তাকে খেয়ে ফেলেছে নাকি নিজের বাড়িতে বন্দি করে রেখেছে?’ মহাদেব দিব্যদৃষ্টিতে দেখে বললেন ‘গরুড় মণিনাগকে বন্দি করে রেখেছে, তুমি গিয়ে বিষ্ণুকে একথা জানাও। আর মণিনাগকে সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এস।’

নন্দী শিবের কথামতো বিষ্ণুর কাছে গিয়ে সব জানালেন। তখন বিষ্ণু গরুড়কে ডেকে মণিনাগকে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু গরুড় নাছোড়বান্দা, সে বলল ‘প্রভু, নাগ আমার খাদ্য, ওকে দিয়ে দিলে আমি খাব কী? আমি ওকে কিছুতেই দেব না।’ একথা শুনে বিষ্ণু বললেন ‘তোমাকে আমি অন্য খাদ্যের জোগাড় করে দেব। এখন তুমি ওকে ছেড়ে দাও।’ তাও গরুড় সেখান থেকে এক পাও নড়ল না, সে বলল ‘আপনি আমার সঙ্গে অত্যন্ত অন্যায় করছেন। প্রভুরা ভৃত্যকে কত ভাল ভাল জিনিস দেন, আর আপনি আমার থেকে এইভাবে আমার খাদ্যটুকুও কেড়ে নিতে চাইছেন? অথচ আপনি যখন আমার পিঠে চড়ে দৈত্যদের সঙ্গে লড়াই করেন তখন আমার কষ্ট হলেও আমি তো কিছু বলি না।’

গরুড়ের কথা শুনে বিষ্ণু হেসে বললেন ‘তোমার গায়ে জোর আছে একথা আমি মানি। কিন্তু তুমি আমায় বহন কর বলে তোমার এত অহঙ্কার? আমি না চাইলে তুমি আমায় বহন করতে পারতে না, সেই প্রমাণ তোমায় এক্ষুণি দিচ্ছি। এই আমার বুড়ো আঙুল, এটা বহন করে দেখাও তো।’ বলেই তিনি নিজের বুড়ো আঙুলটি গরুড়ের মাথায় রাখলেন। সেই আঙুলের চাপে গরুড়ের মাথা নত হয়ে যেতে লাগল, তারপর তাঁর মাথাটি কাঁধের ভিতর ক্রমশ ঢুকে যেতে লাগল এবং কাঁধটি চ্যাপ্টা হয়ে গেল। কষ্ট সহ্য করতে না পেরে গরুড় হাত জোড় করে নারায়ণকে বললেন ‘আমি আপনার ভৃত্য, আমার অপরাধ আপনি ক্ষমা করে দিন। আমি আপনার আদেশ অমান্য করে অন্যায় করেছি, আমায় ক্ষমা করুন প্রভু।’

গরুড়ের দুর্দশা দেখে লক্ষ্মীর করুণা হল, তিনি বিষ্ণুকে বললেন ‘তুমি ওকে ক্ষমা করে দাও, ও এক্ষুনি মণিনাগকে ছেড়ে দেবে।’

এরপর বিষ্ণুর কথামতো নন্দী মণিনাগকে মুক্ত করে গরুড়কে সঙ্গে করে মহাদেবের কাছে গিয়ে সবকথা খুলে বললেন। তখন মহাদেবের নির্দেশে গৌতমী-গঙ্গায় স্নান করে গরুড় আবার তাঁর আগের শরীর ফিরে পেলেন এবং বিষ্ণুর কাছে ফিরে গেলেন।

ঋণ: পুরাণের গল্প, কুলদারঞ্জন রায়। চলিত করেছেন জয়তী ভট্টাচার্য।