সেদিন সকাল থেকে বৃষ্টি। দিনের বেলাতে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। ঝমঝম করে একটানা জল ঝরেই চলেছে আমাদের টিনের চালাতে। পাশের বাড়ির তেঁতুলগাছের মাথা ধোঁয়া-ধোঁয়া হয়ে আছে।
দাওয়াতে বসে ঠাকুমা, আমি, বাবা, কাকা ভাত খাচ্ছি কালো পাতার মতো দেখতে শোলমাছের ঝোল দিয়ে। আমাদের খাওয়া শেষ হলে মা, কাকিমা খেতে বসবে। মা খেতে দিচ্ছে, কাকিমার মাথায় যন্ত্রণা বলে ঘরে শুয়ে আছে। ঠাকুমা দাওয়া থেকেই হাতমুখ ধুয়ে নিল শব্দ করে। কুলকুচি করল, কাকিমাকে ঘরে গিয়ে ডাকতেই দেখল কাকিমা নেই। অথচ ঘন্টাখানেক আগে ঘরে গিয়ে শুয়েছে। একটি দরজা, বেরতে হলে তো আমাদের সামনে দিয়েই বেরতে হবে, কোথায় গেল তবে!
এমনই সময়ে ছাতা মাথায় গিয়াস কাকা খবর দিয়ে গেল, কাকিমা পুকুরের জলে পা ডুবিয়ে বসে। গিয়ে দেখা গেল সত্যি তাই। ওই বৃষ্টির ভিতর পিছল ঘাটের পাশে গাবগাছের শিকড়ে বসে। চুল ছেড়ে দেওয়া, ল্যাপ্টানো। সিঁদুর মুছে যাওয়া। চোখ জবাফুলের চেয়েও লালরঙের।
রেললাইনের ওধার থেকে ওঝাকে খবর দেওয়া হলে সে এল। ওঝার গায়ে একটা চাদর সবসময় থাকে, কাঁধে ঝোলা। ঝোলা থেকে ঝাঁটা, হলুদ, সর্ষে এসব বেরল। চলল কথাবার্তা। চিৎকার। ওঝা গলার পর্দা তুলে বলল— বল তো তুই কে? কাকিমা খোলা গলায় বলল— কেন বলব রে ড্যাকরা মিনসে! তোর রক্ত খাব শুকনো ঘাড় ভেঙে।
ওঝা বিড়বিড় করল। তারপর হলুদ পোড়াল ছাতার আড়ালে। দিয়ে চেঁচাতে লাগল— তুই বলবি না, তোর বাপ বলবে। আমাকে হুমকি! এই দ্যাখ হলুদপোড়া। এই দ্যাখ ঝাঁটা। বলে সপাসপ মারতে লাগল ঝাঁটার বাড়ি। সর্ষে ছুঁড়ে দিতে লাগল।
মা দুঃখিত মুখ করে চলে যেতে লাগল। ঠাকুমা দাঁড়িয়ে। বাবা-কাকা। আমার কষ্ট হচ্ছিল ওই মার দেখে। পাড়ার লোক দূরে দূরে দাঁড়িয়ে আছে জলে ভেজা ছবির মতো।
এমনই সময় কাকিমার দেহে-ভর-করা পেত্নী বলতে লাগল, কেন লুকিয়ে চুরি করে চুল ছেড়ে কাকিমা শোলমাছের ডিম খেয়েছে! তাই সে উঠেছে।
তবে সে এবারে ছেড়ে যাবে। বৃষ্টি একটু ধরো-ধরো। কাকিমা জলভর্তি কলসি মুখে করে দাঁতে চেপে গাবতলা থেকে বাড়ি অবধি নিয়ে গিয়ে জ্ঞান হারাল।
পাশের কচুবনে সাপের গর্তের পাশে ভিজে ভিজে হাওয়ায় ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে। ছোটবেলার সেই দুপুরের কথা ভাবলে এখনো গা ছমছম করে ওঠে।