Categories
ভাষাপুকুর |

গুরুদেবের খেয়াল-খুশি

596 |
Share
| ৯ মে, ২০২১
সুধীরচন্দ্র কর

বিশ্বভারতীর গ্রন্থাগারিক

চিত্র সৌজন্য: economictimes.com

কবির বাতিক ছিল বায়োকেমিক। ওষুধ পরকেও বিলাতেন, কিন্তু তাঁর নিজের ক্ষেত্রে ওর ব্যবহার-পদ্ধতিটাই ছিল দেখবার মতো। হাতের কাছে টেবিলের উপর সাজানো থাকতো অষ্টপ্রহর শিশিগুলো, খানিকক্ষণ পরে-পরেই বাঁ হাত উপুড় করে নিয়ে ডান হাতের তেলোয় ঠুকে মুখে পুরতেন ওই শিশি থেকে চার-পাঁচটি করে গুটিকা। শারীরিক পটুতা, মস্তিষ্কের স্নায়ু-সবলতা কতটা রক্ষিত হয় তিনিই জানেন, কিন্তু উঠতে-বসতে ওই বায়োকেমিকই নিয়েছিল টেনে তাঁর বিশ্বাস ও অধ্যবসায়।

খেয়াল-খুশিগুলো ছিল অদ্ভুত রকমের। শরীরই নাকি আগে, শরীরের দিকেও খেয়াল ছিল। যে যা বলত, স্বাস্থ্যরক্ষার জন্যে গুরুদেব তাই করতেন। একবার কে বললে– রোজ রোজ আমলকী ছেঁচে খাওয়া উপকারী। আশ্রমে আমলকী গাছ মেলা; তলায় তলায় ফলের ছড়াছড়ি। গুরুদেব হুকুম দিলেন, রোজ তাঁকে আমলকী ছেঁচে দিতে হবে। কিছুদিন পরে কলকাতায় আশ্রমের অভিনয়। গুরুদেবও যাবেন। সেবার তিনি অমনি গেলেন না, সঙ্গে নিলেন আমলকী। চাকরদের প্রধান কাজই দাঁড়ালো এতো-এতো আমলকী ছেঁচা। সবাই অবাক! করছেন কী গুরুদেব! তা, কে শোনে কার কথা! এমনি চলল ক’দিন– আমলকী সেবন। সহ্যেরও সীমা আছে। হঠাৎ দেখা দিল এমনি অসুখ, নিতে হল শয্যা! তখন ডাকো ডাক্তার, আনো ওষুধ। এদিকে নাটকে যাওয়া বন্ধ, গুরুদেব রেগে সারা! সে এক ব্যাপার।
যাক, আমলকী বাতিল হয়ে গেল। তবু মৃত্যুর তিন-চার বছর আগেও স্বাস্থ্যের জন্য কত যত্ন যত্ন– কাঁচা স্যালাড, কাঁচা সর্ষে পাতা প্রভৃতি চিবিয়ে খেতেন ভাতের আগে। সে সব বাগান থেকে তক্ষুনি তোলা হত; গোছা ধরে মূলসহ সাজানো থাকতো টেবিলের ডিসের পাশে। . . .

. . . অভিনয়ে গিয়েছেন কলকাতায়। কি মনে হল–বলে বসলেন, সাদাসিদে ভাবে থাকবেন। কম্বল হবে শয্যাসম্বল। সঙ্গে সঙ্গে কম্বলওয়ালার আমদানি হতে লাগল দলে দলে। মোটা খসখসে দিশি কম্বল। গদি উঠিয়ে পঁচিশ-ত্রিশখানা কম্বল পাতা হল, তৈরি হল বিছানা। শুধু কি তাই, মেজেয় কম্বল, জানালায় কম্বল। কম্বলে জোড়াসাঁকোর ঘর ভরা। এদিকে কদিন পরেই শুরু হয়ে গেল ছটফটানি। –খেয়ে ফেললে রে ছারপোকা! ঝাড় বিছানাপত্তর, রোদে দে, ধুয়ে দে গরমজলে, মেরে ফেল, শিগগির মেরে ফেল ওই আপদগুলোকে ইত্যাদি। করা হল সবই। কোথায় ছারপোকা! আসল কথা কম্বলের কুটকুটে রোঁয়া-ফোটার জ্বালা। গা উঠল চুলকুনিতে ফুলে। তাঁর ধারণা– এ ছারপোকারই খোঁচা।

চাকরের দল রোজ সেই পঁচিশ-ত্রিশখানা কম্বল রোদে দিতে লাগল, তবু অসোয়াস্তির শেষ নেই। তখন হল মশার দোষ। এল ফ্লীট্ ঘর-দোরে তো দেওয়া হলই, বললেও অবিশ্বাস জাগবে –সোফায় তিনি বসে থাকতেন চোখ বুজে,–আর তাঁর চাকররা তাঁরই হুকুমে দরজা-জানালা সব এঁটে ঘর অন্ধকার করে নিয়ে মশামাছির লোপের জন্য তাঁর অমন গায়ে অবধি ছড়িয়ে দিত সেই অপূর্ব জিনিসটি। পিচকারি ভরে ভরে প্রায় জবজবে করে তুলত জোব্বাগুলি। এমনি কদিন গেল। তবু রোগশয্যার পূর্ব অবধি কম্বলের গদিই ছিল বহাল।

. . . এসব তো গেল তাঁর খেয়ালের দিকের কথা। তাঁর মনের মতো কিছু হলে খুশির লক্ষণটি ছিল, চেয়ারে বসা থাকলে, গা একটু এলিয়ে দিয়ে ঘন ঘন পা দোলানো। প্রস্তুত হয়ে ওঠার লক্ষণ ছিল সশব্দ গলাঝাড়া। যখন-তখন উত্তরায়ণ কাঁপানো শব্দ আশ্রমের বহুদূর অবধি শোনা যেত।

ঋণ: কবি-কথা, সুধীরচন্দ্র কর