Categories
রকমারিনগর |

গ্রাফোলজির সহজপাঠ । ৪

557 |
Share
| ২০ জানুয়ারী, ২০২১
সময়িতা বন্দ্যোপাধ্যায়

গ্রাফোলজিস্ট ও গ্রাফোথেরাপিস্ট

ছবি ও গ্রাফিক্স: কমলাকান্ত পাকড়াশী

সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এডলফ হিটলারের আদেশে প্রচুর মানুষকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ভরছেন নাৎসি বাহিনী। তোমরা হয়তো শুনে থাকবে যে এই সমস্ত কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে মারাত্মক অত্যাচার করা হত মানুষের ওপর। শুধু অত্যাচার নয়, তাদের যে সব ঘরে রাখা হত, সেই ঘরগুলি বেশিরভাগ সয়মই কনকনে ঠাণ্ডা থাকত এবং কোনও রকম আরামের ব্যবস্থা ছিল না সেগুলোতে। খাবার দাবার যা দেওয়া হত তাও অত্যন্ত নিম্নমানের।

ফেলিক্স ক্লাইন নামের এক যুবককে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বন্দী করেন নাৎসিরা। এর কিছুদিন পর নাৎসি অফিসাররা খবর পান যে— এই যুবক নাকি গ্রাফোলজি জানে। তাকে নিয়ে আসা হয় অফিসারের ঘরে। জার্মান অফিসাররা তাকে জিজ্ঞাসা করেন যে সে তাদের হাতের লেখা বিশ্লেষণ করে কিছু বলতে পারবে কিনা। ফেলিক্স দেখে ঘরটি খুব আরামের, বেশ গরম। সে বলে সে পারবে, কিন্তু কাজটি সময়সাপেক্ষ। এবার জার্মান অফিসাররা এক এক করে তাদের হাতের লেখা দিতে থাকেন ফেলিক্সকে। ফেলিক্স প্রথমে ভয়ে ভয়ে, তারপর একটু করে বাড়তে থাকা সাহসের সাথে এক এক জন অফিসারের চরিত্র বিশ্লেষণ করে বলতে থাকে। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনে অফিসাররা। আর ওই উষ্ণ ঘরে বসে এই গ্রাফোলজিস্ট ঘরের আরাম উপভোগ করতে করতে হাতের লেখার ম্যাজিক দেখাতে থাকে। এইভাবেই আনন্দ, আরামে কাটে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের একটা দিন। সব বলা হয় গেলে অফিসাররা খুশি হয়ে একটা চিজ স্যান্ডউইচ উপহার দেন ফেলিক্সকে। সে সেই স্যান্ডউইচ নিয়ে ফিরে যায় ক্যাম্পে এবং ১৭ জন মিলে ভাগ করে নেয় এই একটুকরো আনন্দ। যতদিন এই ছেলেটি ক্যাম্পে বন্দী হয়ে ছিল ততদিন ধরে বাকি বন্দীর হাতের লেখার ওপর গবেষণা চালিয়ে যায়।

১৯৭২ সালে এই ফেলিক্স ক্লাইনই নিউ ইর্য়ক শহরে স্থাপন করেন ন্যাশনাল সোসাইটি অফ গ্রাফোলজি। এই বিজ্ঞানের উৎপত্তি কিন্তু তা বলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার নয়। এর উৎপত্তি অনেক অনেক বছর আগে। ৩৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে দার্শনিক অ্যারিস্টটল এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ‘speech is the expression of ideas or thoughts or desires, handwriting is the visible form of speech. Just as speech can have inflections of emotion, somewhere handwriting is an expression of emotions underlying the writers’ thoughts, ideas, desires’।

এরপর এই নিউ ইর্য়ক থেকে শুরু করে বিশ্বব্যাপী বিক্ষিপ্তভাবে চলতে থাকে গ্রাফোলজি চর্চা। তবে সংগঠিতভাবে গ্রাফোলজির পড়াশোনা শুরু হয় ১৬২১ সালে যখন একজন ইতালীও ডাক্তার ডাঃ ক্যামিললো বালদি প্রথম বই লেখেন এই বিষয়টি সম্পর্কে।

মজার ব্যপার হল, ১৬৭৪ সালে ভারতবর্ষে শিবাজী ‘ছত্রপতি’ উপাধি পান এবং ঐ সময়ই শিবাজির অস্ত্রশিক্ষাগুরু শ্রী রামদাস রাজ্যের সেনাপতি নিয়োগ করতেন শুধুমাত্র যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা দেখে নয়, তাদের হাতের লেখা দেখেও।

অষ্টাদশ শতক থেকে বিভিন্ন দেশে আলাদা আলাদাভাবে শুরু হয় গ্রাফোলজি চর্চা। ইউরোপীয় দেশগুলিতে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে বিষয়টি পড়ানো শুরু হয়। এই ক্ষেত্রে যে দেশের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তা হল জার্মানি। একটা এত বড় বিষয়ের ইতিহাস এক-দু’দিনে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু যে গল্পটা না বললে আজকের আলোচনা থামানো যাবে না সেটা বলি। উইলহেম প্রেয়ার (Wilhelm Preyer) নামক এক ফিজিওলজির অধ্যাপক জার্মানিতে এক অভিনব রিসার্চ করেন এমন কিছু মানুষকে নিয়ে যাদের কোনও না কোনও দুর্ঘটনায় হাত কাটা গেছে।

প্রেয়ার এদেরকে পা-এর আঙুল বা মুখের মধ্যে কলম ধরে লিখতে শেখান। তারা সেইভাবে লেখা শিখে গেলে তাদের আগেকার হাতের লেখার সঙ্গে পায়ের বা মুখের লেখার তুলনা করা হয়। অদ্ভুতভাবে দেখা যায় যে লেখাগুলোর (আগের ও পরের) মধ্যে বেশ কিছু চরিত্রগত মিল আছে। এই থেকে প্রেয়ার এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে ‘Hand’ writing আসলে ‘Brain’ writing। এই বিষয়টি তার ‘সাইকোলজি অফ হ্যান্ডরাইটিং’ নামক বইতে উল্লিখিত আছে।

আজ আপাতত আমার গপ্পো এখানেই শেষ। পরের মাসে আবার ফিরে আসছি এমন অদ্ভুত অদ্ভুত কিছু গল্প নিয়ে।