বেলা প্রায় বারোটা বাজে। রাজীব, রিমা, রোহন গাড়ি থেকে নেমে বাড়িটায় ঢুকল। বাড়িটা পুরনো হলেও বেশ মজবুত। তবে চারপাশে খুব নোংরা জমে আছে। বন্ধ বাড়ি এরকম হওয়াই স্বাভাবিক।
রাজীব চৌধুরী পঞ্চয়েত বিভাগে চাকরি পেয়েছে সেই উজানপুরে। রাজীব বিবাহিত, ওর একটা তিন বছরের ছেলে আছে—রোহন। রাজীব এম এস সি পাশ। এতদিন প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করত, এখন পরীক্ষা দিয়ে একেবারে পঞ্চায়েত সেক্রেটারি হয়ে গেছে। রাজীবের মূল বাড়ি কলকাতাতেই।
অমিয় চৌধুরী রাজীবের সম্পর্কে কাকু হন।
ওদের উজানপুরে মূল বাড়ি। ওঁর বাবা মা কেউ বেঁচে নেই আর উনি কর্মসূত্রে কলকাতায় থাকেন। রাজীবের উজানপুরে চাকরি পাওয়ার কথা শুনেই তিনি বললেন, ‘অন্য কোথাও ঘর ভাড়া নেওয়ার কী দরকার রাজীব? আমাদের বাড়িটা তো খালি পড়ে আছে অনেকদিন থেকে। ওখানেই তোরা থাকবি।’
‘অনেকদিন বন্ধ ঘরগুলো কি ঠিকঠাক আছে কাকু। ওখানে থাকা যাবে বাচ্চা নিয়ে।’
‘অবশ্যই যাবে। ঘরগুলো অনেক মজবুত। শুধু কাউকে এনে পরিষ্কার করিয়ে নিস।’
‘আচ্ছা যেমন তোমার ইচ্ছে।’
বাড়িতে ঢোকার পর এত অপরিষ্কার দেখে রাজীবের স্ত্রী রিমা বলল, ‘কাউকে ডেকে নিয়ে এসো। ঘরগুলো ভালো কিন্তু পরিষ্কার করতে হবে। বাড়িটা বেশ বড়। কিন্তু এতগুলো ঘর আমাদের লাগবে না। দু’তিনটে ঘর হলেই হবে।’
‘আচ্ছা দেখছি কাউকে পাওয়া যায় কিনা!’
রাজীব বেরিয়ে গেল। রোহন এসেই দুষ্টুমি শুরু করে দিয়েছে নোংরার মধ্যেই। ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। রিমা ওর পিছু পিছু বেরিয়ে এল। বাইরে বেরিয়ে দেখল একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। গায়ের রং কালো, বেঁটে, মাথায় টাক, নাক চ্যাপ্টা, চোখ দুটো ছোট ছোট। চেহারা অনেকটা আদিবাসীদের মতো। পরণে একটা ময়লা ফতুয়া আর হাঁটু অবধি ধুতি, খালি পা। বয়স ত্রিশ এর কাছাকাছি হবে ।
‘কী চাই এখানে?’ রিমা জিজ্ঞেস করল।
‘দিদি আপনেরা বাড়ি ঘর পরিষ্কারের লোক খুঁজছিলেন না? তাই আমি চইলা আইলাম’।
‘তুমি কি করে জানলে আমরা লোক খুঁজছিলাম’।
‘নূতন বাড়িতে আইছেন পরিষ্কার তো করতে হইব’।
‘কিন্তু তুমি ভিতরে ঢুকলে কী করে? গেট তো বন্ধ!’
‘ওই দেখেন একটা ছোট গেট আছে! ওই দিকেই আইছি—’
রিমা তাকিয়ে দেখল সত্যি বড় গেটের পাশে একটা ছোট গেট। কিন্তু লোকটা চোর-টোর নয়তো! কাজে লাগাবে কি? আবার রাজীব যদি কাউকে খুঁজে না পায় তাহলে ঘরদোর কে পরিষ্কার করবে? থাকতে হবে তো এখানে।
‘এই তোমার নাম কী? বাড়ি কোথায়?’
‘আমার নাম ঘেঁচু। বাড়ি বাংলাদেশে।’
‘এ আবার কী ধরনের নাম! বাংলাদেশ থেকে এখানে কী করে এলে?’
‘আমার নাম ঘনশ্যাম দাস। সবাই ঘেঁচু ডাকত। অনেকদিন আগেই বাংলাদেশ থেকে আইছি দিদিমণি।’
‘ঠিক আছে। ঘরগুলো ভালো করে পরিষ্কার করো তো।’
‘করতাছি দিদিমণি—’
রিমা রোহনকে নিয়ে বসল। ঘেঁচু এতো তাড়াতাড়ি ঘরগুলো পরিষ্কার করল যে তাই দেখে রিমা একেবারে অবাক হয়ে গেল। এ যেন মেশিন!
‘আর কিছু করতে হইব দিদিমণি?’
‘আমাদের ব্যাগগুলো খুলে জিনিসপত্র বের করো।’
‘আইছা’—
ঘর পরিষ্কারের পরই রোহন দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছে। ওর গাড়ি নিয়ে খেলতে শুরু করে দিয়েছে ।
‘পিছনদিকে যাইবা না ছোটবাবু। ওদিকে সাপখোপ আছে—’
‘তুমি কি করে জানলে এসব—’
‘ওদিকে সবসময় সাপ থাকে। কামড় দিলে মানুষ মইরা যায় আমি জানি’।
‘আচ্ছা কাজ করো। বেশি কথা বলো না।’
রিমা ভাবছে ঘরটাকে কীভাবে গুছিয়ে নেবে! বাড়িতে আসবাবপত্র সবই আছে। যদিও একটু পুরনো। রিমা ঘেঁচুকে দিয়ে এটা ওটা করাচ্ছে। কিন্তু ওকে যা বলছে নিমেষেই যেন করে দিচ্ছে। আর মনে হচ্ছে এ-বাড়ির সবকিছু ওর চেনা। এর মধ্যে রোহনকেও দেখছে। রিমা বেশ খুশি। ক্লান্ত শরীরে কিছু করতে ইচ্ছে করছে না। তবে লোকটাকে বেশ পছন্দ হয়েছে তার।
ঘন্টা দেড়েক পর রাজীব ফিরে এল কিছু খাবার নিয়ে। এখন আবার কে রান্নাবান্না কে করবে? কাজ করার জন্য কাউকে পায়নি।
কিন্তু বাড়িতে ঢুকে সবকিছু পরিষ্কার দেখে রাজীব তো অবাক। কে করল পরিষ্কার?
রিমা বেরিয়ে বলল, ‘দেখো সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেছে। খাবার কিছু এনেছ? খুব ক্ষিদে পেয়েছে—’
‘আরেব্বাস! সবকিছু পরিষ্কার করল কে?’
‘বাবা, ঘেঁচু সবকিছু পরিষ্কার করেছে—’ বলল ছোট্ট রোহন।
‘ঘেঁচু? সে আবার কে?’ রাজীব বিস্মিত।
রিমা বলল,‘ ওই যে ওদিকে কাজ করছে। ওকেও কিছু খেতে দিই। বেচারা অনেকক্ষণ ধরে কাজ করছে—’
‘আচ্ছা দাও—’
রিমা ওদের খাবার দিয়ে ঘেঁচুর জন্য খাবার নিয়ে গিয়ে দেখল ওখানে কেউ নেই। অনেক ডাকাডাকি করল কিন্তু কোনো সাড়া নেই ।
রাজীব বলল, ‘এইভাবে চট করে কাউকে ঢুকতে দিও না। নতুন জায়গা, কাউকে চেন না। তোমরা দুজন বাড়িতে থাকবে। আমি তো সারাদিন অফিসেই থাকব। দেখেশুনে চলতে হবে—’
রিমা বলল, ‘লোকটা তো কোন টাকাও নেয়নি’।
পরদিন রাজীব অফিসে যাবার পর রিমা রান্না করছিল। রোহন বারান্দায় খেলছিল।
হঠাৎ রোহন বলল, ‘মা, ঘেঁচু এসেছে!’
রিমা ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল সত্যি ঘেঁচু দাঁড়িয়ে আছে বাইরে।
‘একি তুমি এখন কোথা থেকে এলে? কাল হঠাৎ কোথায় চলে গিয়েছিলে?’
ঘেঁচু তার হলুদ দাঁতগুলো বের করে বলল, ‘কাজ ছিল দিদিমণি!’
‘ওভাবে না বলে চলে যাবে না। এখন কেন এসেছ?’
‘আপনি একা ভাইকে দেখব। যদি বাইরে চইলা যায়। আর কাজ কিছু থাকলে বলেন—’
‘তাহলে ঘর মুছে দাও, বাসনগুলো মেজে দাও। রোহনের সাথে খেলা করো। আর দুপুরে ভাত খেয়ে যাবে—’
‘আচ্ছা’।
ঘেঁচু চটপট কাজ সেরে রোহনের সঙ্গে খেলতে থাকে। রিমা রান্না করে ওকে খেতে দেবার সময় দেখল যে আবার ঘেঁচু উধাও। মনে মনে বিরক্ত হল রিমা— ‘এই হয়েছে এক আপদ! কাজ করে অথচ খাবার দেবার সময় ওকে পাওয়া যায় না—’
ঘেঁচু এভাবে দু’দিন না খেয়ে চলে গেল। তারপর রিমার কাছে খুব বকুনি খেয়ে কিছুটা খাবার খেয়ে যেতে লাগল। প্রতিদিন দুপুরে ঘেঁচু আসে। কাজ করে। রোহনের সঙ্গে খেলা করে। অল্প কিছু খাওয়াদাওয়ার পর হঠাৎ উধাও। কিছু বললে উত্তর দেয় না। শুধু হাসে।
রাজীব সব শুনে বলল, ‘আর ওকে ঢুকতে দিও না। কে জানে লোকটা কেমন! আমি তো এখনও দেখলাম না!’
‘তুমি দুপুরে বাড়ি থাকো না। ও আসে, বাড়ির কাজ করে দেয়। ও তো আমাদের কোন ক্ষতি করে না। একটা টাকা এখনও ও নেয়নি বরং আমাকে সাহায্য করে। রোহনকে দ্যাখে। আর রোহনও এই কদিনে ওর সঙ্গে বেশ মিশে গেছে। দুপুর হলেই বলবে, ‘মা ঘেঁচু দাদা এখনও এল না।’
রাজীব বলল, ‘আরে টাকা নেয়নি বলে আরও বেশি চিন্তা। কে জানে ওর চুরির উদ্দেশ্য আছে কিনা!’
একদিন রোববার দুপুরে রাজীব, রোহন, রিমা একজনের বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে যাবে। রাস্তায় রাজীব মিষ্টি কেনার জন্য দোকানে গেছে। রিমা রোহনকে নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ রোহন একটা কুকুরকে দেখে দৌড় দিল রিমার হাত ছেড়ে। ও কুকুরকে খুব ভয় পায়। রাস্তায় অন্যদিক থেকে একটা লরি আসছিল। রিমা চিৎকার করতে থাকে। আশেপাশের লোক জড়ো হয়। একটু পরে রিমা দেখতে পায় ঘেঁচু ওকে কোলে নিয়ে আসছে। রোহনের কিছু হয়নি।
‘ঘেঁচু তুমি ওকে কোথায় পেলে?’
‘ছোটবাবু তো ওদিকে চইলা গেছিল। সামনে বড় গাড়ি আইতাছে। একটুর লাইগা গাড়ির নীচে পইরা যাইত। আমি ওরে কোনরকমে বাঁচাইয়া আনলাম—’
‘খুব দুষ্টু হয়েছে ছেলেটা। তুমি এখানে না থাকলে কী যে হত—’
‘কিছু হইব না দিদিমণি। আমি সবসময় ওর সঙ্গে থাকুম। বাচ্চা আমার খুব পছন্দ।’
‘তোমার তো ঠিকানা নেই। হঠাৎ করে উধাও হয়ে যাও!’
‘হে হে হে কাজ থাকে যে দিদিমণি!’
রিমার পাশে বেশ কয়েকজন লোক এসে দাঁড়িয়েছে। রাজীবও এসেছে।
রাজীব বলল, ‘একি রিমা! তুমি কার সঙ্গে কথা বলছ?’
‘কেন ঘেঁচুর সঙ্গে! রোহন দৌড়ে চলে গেছিল! যদি ঘেঁচু ওকে না বাঁচাত তাহলে যে কী হত—’
‘কোথায় ঘেঁচু?’
‘ওই তো!’— রিমা ঘুরে দেখল কেউ নেই। শুধু একটা গরম হাওয়া অনুভব করল।
‘তোমার যে কী হয়েছে বুঝি না আমি। এই ঘেঁচু তোমার মনে গেঁথে আছে। আমি তো আজ পর্যন্ত ওকে দেখতে পেলাম না—’ রেগেমেগে বলল রাজীব।
‘না বাবা ঘেঁচু দাদা এসেছিল—’ রোহন বলল।
‘চুপ কর। আশেপাশের লোকজন হাসছে। চল যাই। সবাই তোমাকে পাগল ভাবছে—’
রাজীবের কথা শুনের রিমার মনে হতে লাগল, এই ঘেঁচু কে? বড় রহস্যময় এই ঘেঁচু!
পরদিন রাজীবের কাকু অমিয়বাবু এলেন। বললেন, ‘তোরা এসেছিস তাই বাড়িটা দেখতে এলাম। বাড়িতে অনেকদিন আসিনি—’
‘খুব ভালো কাকু। কয়েকদিন থাকুন না আমাদের সঙ্গে—’
‘কাজ না থাকলে থাকতাম রে মা। দাঁড়া তোদের আমাদের পরিবারের পুরনো একটা ছবি দেখাই। এখন অবশ্য অনেকেই বেঁচে নেই—’
অমিয়বাবু অনেক খুঁজে একটা বাঁধানো ছবি নিয়ে এলেন। রিমা চা নিয়ে এল। রোহন ছবিটা দেখে বলল, ‘মা দেখ ঘেঁচু দাদা . . . ’
রিমা ছবিটা হাতে নিয়ে দেখল ছবিতে অনেকের সঙ্গে ঘেঁচু নীচে মাটিতে বসে আছে। অবিকল এখনকার মতো দেখতে।
‘কাকু এটা কে?’
‘এ তো আমাদের বাড়ির পুরানো কাজের লোক। বিয়ে করেনি। খুব ভালো ঘরদোর পরিষ্কার করত। বাচ্চাদের খুব ভালোবাসত। খুব চটপটে ছিল—’
‘সে এখন কোথায়?’
‘সে তো প্রায় দশবছর আগে একদিন দুপুরে পিছন দিকটা পরিষ্কার করতে গিয়ে সাপের কামড়ে মারা গেছে—’
‘মাগো এতদিন ভূত আমাদের বাড়ি আসত। কী সাংঘাতিক! এই জন্যই মাঝে মাঝে উধাও . . .’— বলেই মাথা ঘুরে পড়ে গেল রিমা।