Categories
গল্পগ্রাম |

চড়কডাঙার মাঠে

484 |
Share
| ১৯ অক্টোবর, ২০২১
সুশান্ত পাত্র

অলংকরণ: কমলাকান্ত পাকড়াশী

সন্ধ্যা সাতটা বাজে। ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করে কাঁচা লঙ্কা, পেঁয়াজ দিয়ে পান্তা খেতে বসেছে হাঁদু। এমন সময় তার দাদা চাঁদু বাজার থেকে বিরস বদনে বাড়ি ফিরে এল। বাজারের ব্যাগটা বারান্দায় ধপ করে রেখে বলল, পুঁইশাক আর কুচো চিংড়ি ছাড়া আর কিছুই কিনতে পারলাম না। বাজারে যেন আগুন লেগেছে। হাঁদু কাঁচালঙ্কায় একটা কামড় মেরে বলল, একটু কুমড়ো আনলে না কেন? কুচো চিংড়ি, পুঁইশাকের সঙ্গে জমে যেত একেবারে। চাঁদু তার কোঁকড়ানো পুরনো পাঞ্জাবির পকেট উল্টে বলল, পকেটে ফুটো পয়সাটাও নেই। কিনব কী দিয়ে? আজ সাতদিন হল, কিছু উপার্জন হয় নি। আক্রার দিনের জন্য চালের বাতায় এখানে ওখানে টুকটাক কিছু টাকা গুঁজে রাখা ছিল। আজ ক’দিন তার থেকেই চলেছে। আজ চাঁদু তন্নতন্ন করে খুঁজে একটা মাত্র পঞ্চাশ টাকার নোট পেয়েছিল। চাঁদু বুঝতে পেরেছে চালের বাতা ফতুর।
সে সজোরে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, শেষটায় কি না খেয়ে মরতে হবে?
হাঁদু পান্তা চটকাতে চটকাতে বলল, কাল চাকবেড়ের নাড়ুর সঙ্গে দেখা হল। কথায় কথায় বলল, ষষ্ঠী সর্দার নাকি পেটের দায়ে রেশন দোকানে কেরোসিন মাপার কাজ নিয়েছে।
চাঁদু অবাক হয়ে ডানহাতের তর্জনী নমস্কারের ভঙ্গিতে ঠেকিয়ে বলল, বলিস কিরে! উনি যে এ তল্লাটের সব থেকে গুণী মানুষ। আহা, লোকে বলে, ষষ্ঠী সর্দার তালার গায়ে শুধু হাত বুলিয়ে আনলে নাকি তালা শ্রদ্ধায় খুলে যায়। তাঁর এমন অবস্থা!
হাঁদু বলল, নাড়ু নিজেও বলছিল ইঁটভাঁটার কাজে চলে যাবে। আমাকে বলল, দাদাকে বল অন্য লাইন ধরতে। চুরি-বিদ্যা ছেড়ে দে।
চাঁদু ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল। বলল, চুরি-বিদ্যা ছেড়ে দেব! আমরা কি আজকালকার ছিঁচকে নাকি, যে ছেড়ে দেব? সাতপুরুষের জীবিকা আমাদের। আমাদের বংশগত জীবিকাই হচ্ছে চুরি করা। হুট করে ছেড়ে দেব বললেই ছাড়া যায়। বংশের মুখে কলঙ্ক পড়বে যে!
হাঁদু পান্তা খেতে খেতে বলল, সেই তো।

গ্রামের নাম চড়কডাঙা। বর্ধিষ্ণু গ্রাম। দেখতে দেখতে আধুনিকতার পালে হাওয়া লাগিয়ে আরও বর্ধিষ্ণু হয়ে উঠছে দিন দিন। কত রকম উপায়ে মানুষের রোজগার বেড়েছে। একমাত্র অন্যথা হল চাঁদু আর হাঁদু। এরা দুভাই চড়কডাঙার নামকরা চোর। বাপ, ঠাকুর্দা, বুড়ো ঠাকুর্দা এই ভাবে বংশ-পরম্পরায় তাদের বৃত্তি হল চুরি করা। পরম যত্নে, মমতায় পরের বংশধরকে শিখিয়ে এসেছে চুরির কলাকৌশল। কীভাবে দশফুট উঁচু পাঁচিল থেকে নিঃশব্দে লাফিয়ে নামতে হয়, বেড়াল পায়ে কীভাবে ছুটে যেতে হয়, সামান্য তার দিয়ে তালা কীভাবে খুলতে হয়, জানালার গ্রিল কীভাবে নিঃশব্দে খুলে ফেলতে হয়, গৃহস্থের ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে সিঁধ কেটে কীভাবে সর্বস্ব সরিয়ে ফেলতে হয়— এসব তাদের কাছে জলভাত।

কী সুন্দর জীবন ছিল তাদের। সন্ধ্যাবেলা ঘুম থেকে উঠে মুখ হাত দিয়ে চাঁদু যেত বাজার করতে। হাঁদু ঘরের কাজ সেরে রাখত। চাঁদু বাজার করে ফিরলে হাঁদু রান্না বান্না সারত। তারপর খাওয়া শেষ করে সেজেগুজে বেরোত চুরি করতে। শেষ রাতে ফিরে চুরির মাল গুছিয়ে রাখতে রাখতে ভোর। তারপর গৃহস্থরা জেগে উঠলে তারা ঘুমিয়ে পড়ত। আসলে তাদের কাজ তো রাতে। তাই রাতটাই তাদের কাছে দিন। দিনটাই রাত। সন্ধেবেলাটাই তাদের কাছে সকাল।

ইদানীং খুব খারাপ যাচ্ছে তাদের দিনকাল। দেখ না দেখ ধাঁই ধাঁই করে পাকা বাড়ি উঠছে চারদিকে। সরকার নাকি বাড়ি করার জন্য টাকা দিচ্ছে। তার সঙ্গে আরও গোটা কয়েক টাকা দিয়ে সবাই ছাদ আঁটা, লোহার গ্রিল দেওয়া বাড়ি বানিয়ে নিচ্ছে। চাঁদু হাঁদু কিছুতেই আর সুবিধা করে উঠতে পারছে না। গত একমাসে সদুবুড়ির একটা দস্তার বালতি ছাড়া কিছুই চুরি করতে পারেনি।

সদুবুড়ি অবশ্য থানা পঞ্চায়েত কিছুই করেনি। কেবল সেদিন বিকেলের দিকে রাস্তা থেকে চিৎকার করে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে গেছে, পুরনো দিনের মোটা দস্তার বালতি। এখনও একটা টোল অব্দি খায়নি। দেড়শো টাকার কমে যেন বেচিস নে হতভাগারা।

এমন হলে চোরদের চলে কী করে! চোরেরাও তো মানুষ! চুরিও তো একটা জীবিকা নাকি? বরং একটা শিল্পকলা বলা যায়। এত পুরাতন একটা শিল্প যে বিলুপ্ত হতে বসেছে, তার কোন হুঁশ আছে মানুষের! সরকারেরও কি উচিত এই ভাবে চোরেদের ভাতে মারা? এভাবে চললে তো ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ‘চোর’ দেখার জন্য মিউজিয়ামে যেতে হবে।

হাঁদু খেয়ে উঠে রান্না বসিয়ে দিয়েছে। সে দেখল, চাঁদু বাজার থেকে ফিরে ইস্তক, বসে বসে কী যেন ভাবছে।
সে বলল, কী ভাবছিস দাদা?
চাঁদু দোনামোনা করল খানিক। তারপর বলল, ভাবছি, চড়কডাঙায় আমাদের চুরি করা আর হবে না। সব বাড়িতে ঢুঁ-মারা হয়ে গেছে। কোথাও সুবিধে হয় নি।
হাঁদু চিন্তিত হয়ে বলল, তাহলে?
—ভাবছি, বাদামতলী যাব।
হাঁদু চমকে উঠে বলল, বাদামতলী! সর্বনাশ।

বাদামতলী চড়কডাঙার পাশের গ্রাম। অনেক বড়লোকের বাস সেখানে। বেশ বড় গ্রাম। গঞ্জ এলাকা। একটা বড় বাজার আছে সেখানে। মেলা টাকা পয়সার কারবার হয় দু’বেলা। এজন্য গ্রামের লোক নিজেরা টাকা দিয়ে দুজন নেপালীকে চৌকিদার রেখেছে। তারা সারারাত কুকরি হাতে গ্রাম পাহারা দেয়। চাঁদু হাঁদুর বাবাও বাদামতলী চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গণপিটুনি খেয়েছিল। আশেপাশের কোন গ্রামের চোর বাদামতলী চুরি করতে যায় না ভয়ে।
হাঁদু বলল, তুই জানিস না, কেউ বাদামতলী চুরি করতে যায় না?
চাঁদু বলল, এটুকু রিস্ক নিতেই হবে।
—বাবা কিন্তু ধরা পড়েছিল।
—সেই জন্যই আরও যেতে হবে। বাবার অপমানের বদলা নিতে হবে।
—তাহলে চল, আগে শ্মশান কালীর পুজো দিয়ে আসি।
চাঁদু বলল, আমাদের হাতে সে-সময় নেই। আমাদের এখন শিরে সংক্রান্তি। বাবা বলতেন, বিপদকালে নিয়ম নাস্তি।
হাঁদু কথাটার মানে ভালো বুঝল না। তবে বাবা যখন বলে গেছে নিশ্চয়ই ভালো হবে। সে এবার রাজি হল।

গভীর রাতে তারা সাজতে বসল। দুজনে পরল খাকি বারমুডা। খাকি রঙটা অন্ধকারে মিশে যায় একেবারে। খালি গায়ে চবচবে করে তেল মাখল। তারপর সারা গায়ে, মুখে আড়াআড়ি চুনের দাগ টানল। সাজসজ্জা শেষ হলে তাদের দেখতে লাগল কঙ্কালের মতো। তার পর তারা মা কালীর ফটোর নীচে দুটো জবাফুল রেখে প্রণাম করল। হাঁদুর কাঁধে একটা ঝোলা। এই ঝোলার মধ্যে তাদের দরকারী সব জিনিসপত্র আছে।

তারপর তারা যখন বাড়ি থেকে বেরোল সমস্ত গ্রাম একেবারে নিঝুম। ঘুমে একেবারে অচেতন।

বাদামতলী উত্তর দিকে। চড়কডাঙার পরে বড় একটা মাঠ। বেশ বড় মাঠ। আড়ে প্রায় মাইলটাক হবে। গ্রামের নামেই মাঠের নাম— চড়কডাঙার মাঠ। গরমের ধান কাটা হয়ে গেছে বলে, মাঠ এখন খালি। মাঠে নেমে দুজনে হরিণ পায়ে দৌড় শুরু করল। আকাশে চাঁদ নেই। অন্ধকার তার ঘন আস্তরণ বিছিয়ে দিয়েছে চরাচর জুড়ে। তাতে অবশ্য চাঁদু-হাঁদুর কোনও সমস্যা নেই। তারা দিব্যি দেখতে পাচ্ছিল। কোথায় ছোট্ট উঁচু আল, কোথায় জল নিকাশি সরু নালা, কোথায় ইঁদুরের গর্ত। সব তাদের চোখের সামনে দিনের মতো ভেসে উঠছিল।

গা গরম হওয়ার আগেই তারা মাঠ পেরিয়ে বাদামতলী পৌঁছে গেল। আজ প্রথম দিন বলে তারা গলিঘুঁজির মধ্যে ঢুকল না। বড়ো রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগল। পথের দুধারে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাদের। নেপালী চৌকিদারের সামনে যেন না পড়ে যায়, তাই খুব সাবধানী তারা। অল্প সময়ের মধ্যে চাঁদু একটা বাড়ি পেয়ে গেল। চারিদিকে পাঁচিল দেওয়া, ছড়ানো দোতলা একটা বাড়ি। তার ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলছে, বাড়িটায় প্রচুর জিনিস আছে।

প্রথমে তারা ভালো করে পাক খেয়ে দেখে নিল বাড়িটা। মনে হচ্ছে কুকুর নেই। পুরো বাড়িটা একেবারে ঘুমে মগ্ন। চাঁদু হাঁদুকে গ্রিন সিগন্যাল দিল।

শুকনো পাতার মতো দুজনে পাঁচিল পেরিয়ে বাগানে নামল। লোহার শক্ত দরজা। সুবিধা হবে না। চোখে চোখে
ইশারা হয়ে গেল। জলের পাইপ বেয়ে ছাদে উঠতে দুজনের শুধু কয়েকবার নিঃশ্বাস পড়ল। ছাদের উপরে একটা ঘর। বাইরে থেকে তালা লাগানো। তার মানে ঘরের মধ্যে কেউ নেই। চাঁদু এগিয়ে গিয়ে তালার গায়ে হাত রাখল। চাবি দিয়ে খুলতে যতক্ষণ সময় লাগে, তার আগেই সে তালাটা খুলে পাশের আংটায় ঝুলিয়ে রাখল। পাল্লা ঠেলতেই যেন ঝলসে গেল তাদের চোখ।

ঘরে একটা প্রদীপ জ্বলছে। অল্প আলোতে দেখা গেল, ঘরটা আসলে মন্দির। একধারে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কালী মূর্তি। দেবীর গা জুড়ে ঝলমল করছে সোনার গয়না। মাথায় মুকুট, গলায় হার, হাতে চওড়া মানতাসা, বালা, কোমরে কোমরবন্ধ, পায়ে বালা। সারাঘর যেন ঝলসে উঠছে সোনার দ্যুতিতে।

চাঁদু আর হাঁদু খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর চাঁদু ঘরে ঢুকতে যেতে হাঁদু টেনে ধরল তাকে।
—দাদা, ঠাকুর।
—তাতে কী?
—পাপ হবে।
—দ্যুৎ।
—ঠাকুরের জিনিস ছুঁতে নেই।
—এখানে যা আছে, সারা জীবনের জন্য আর চিন্তা নেই।
—লোভ করিস না। মা কালী কিন্তু . . .
—তিন বছর বড় করে পুজো দেব।
—নরকে যাবি।

চাঁদু একটু থমকাল। বরাবর তারা নিয়ম মেনেই কাজ করে। তাদের বাবা বলত, চোরদেরও কিছু আদর্শ, নৈতিকতা থাকা দরকার। না হলে জাতশিল্পী হওয়া যায় না। ছিঁচকে হয়েই থাকতে হয়। কিন্তু এত সোনার লোভ সংবরণ করা মুশকিল। সারাজীবন বসে বসে খাওয়া যাবে।
চাঁদু বলল, দেখ, আমরা তো কালীর পুজো করি।
—হু।
—তাহলে কালী আমাদের মা। আমরা তাঁর ছেলে।
—হু।
—মায়ের জিনিসে ছেলের অধিকার থাকে না?
—থাকে।
—তবে।
—এটা আমাদের ঠাকুরঘর না। গয়নায় আমাদের অধিকার কিসে?
—তুই বুঝে দেখ, আমরা আজ এখানে কেন আসতে গেলাম? এই গ্রামে এত বাড়ি থাকতে কেন এখানেই আসতে গেলাম? এদের মন্দির কেন ছাদের উপরে? কেন একটা মাত্র তালা লাগানো?
—কেন?
—মায়ের ইচ্ছা আমরা এগুলো নিই। এতদিন পরে মা আমাদের দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন। আমাদের দুঃখ দূর করার জন্য আমাদের এখানে টেনে এনেছেন। মা নিজেই এসব দিতে চান আমাদের। চেয়ে দেখ মায়ের মুখের দিকে, যেন আমাদের ডাকছেন গয়নাগুলো নিতে।

হাঁদু ধন্দে পড়ে গেল। সে ভালো করে মায়ের মুখ দেখতে লাগল। দাদার কথা কি সত্যি? সত্যিই যেন হাসি হাসি লাগছে মায়ের মুখখানা। হাঁদুর ভাবনার মধ্যেই চাঁদু ঘরের ভেতর থেকে ঘুরে এসে বলল, চল হয়ে গেছে।

হাঁদু দেখল মায়ের গায়ে আর কোনও অলংকার নেই। কেবল অদ্ভুত এক স্মিতহাস্য জেগে রয়েছে প্রতিমার মুখে। বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল হাঁদুর। সে আর দাঁড়াল না। চাঁদুর পিছু পিছু নেমে এল নীচে। তারপর কয়েক কদম দৌড়ে তারা নেমে পড়ল চড়কডাঙার মাঠে।

মাঠের মধ্যে নিঃশব্দে খানিকক্ষণ হাঁটার পর চাঁদু বলল, আর কোনও চিন্তা নেই। মাঠ পেরোলেই বাড়ি। ব্যস। উঃ, এত সহজে এত বড় কাজ করে ফেললাম। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।
হাঁদু বলল, আমারও না। গয়নাগুলো সত্যি সোনার তো?
—কী যে বলিস? সোনা চিনতে চোরের কখনও ভুল হয়। আজ বড় মওকা মেরেছি রে ভাই।

হাঁদুর ভয় কেটে গেছে। এখন মনে হচ্ছে দাদা ঠিক বলেছিল। নাহলে এত সহজে এত বড় কাজ হল কী করে?
সে বলল, উঃ, আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে না। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে গান করি।
চাঁদু বলল, কর না। কে বারণ করেছে? এই মাঠের মাঝে কে শুনতে আসছে?
হাঁদু মনের আনন্দে গান শুরু করে দিল। তার নিজের বানানো, খুব পছন্দের গান। যেদিন খুব খুশি থাকে, সেদিন সে এই গান করে।
হাঁদু গাইছিল—
ভোর হল, দোর দিয়ে হাঁদু বাবু শোও রে।
কটকটে দিন এল যতখুশি ঘুমাও রে।
ঐ দেখ রবি মামা গেছে খুব রেগে রে।
রোদে যদি যাও তবে গা যাবে পুড়ে রে।
ভোর হল দোর দিয়ে হাঁদু বাবু শোও রে।
হাঁদুর গলায় একটুও সুর নেই। স্বর খসখসে। তার বীভৎস আওয়াজ মাঠের নীরবতাকে তোলপাড় করে তুলল।

এখন হয়েছে কী, সেদিনটা ছিল শনিবার, তায় অমাবস্যা। এই দিন ভূতেদের সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তার উপর অমাবস্যা থাকার জন্য বিশেষ পরবের দিন। এক ভূত মাঠে ঘুরতে বেরিয়ে ছিল। হঠাৎ হাঁদুর এমন অপার্থিব নারকীয় গান তার কানে গেল। আরামে কান দু’খানা একেবারে কটকট করে উঠল। সে স্যাঁৎ করে হাওয়ায় ভেসে চাঁদু হাঁদুর কাছে চলে এল। দুজনের গায়ের চুনের দাগ-দেওয়া দেখে তার মনে হল এ দু’জনেও নিশ্চয়ই ভূত। ভূত নইলে এমন গান গাওয়া কি সম্ভব!
সে পিছনে এসে বলল, বাঃ বেড়ে গাইছেন তো! কার লেখা?
চাঁদু, হাঁদু দারুণ চমকে ঘুরে তাকাল। দেখল তাদেরই মতো বেশবাস করা একজন পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমটা চমকে গেলেও, বুঝল তাদের মতো কোনও চোর। নিশ্চয়ই চুরি করতে দেখে তাদের পিছু নিয়েছে।
চাঁদু বলল, কে রে তুই?
সে বলল, আমি একজন নতুন ভূত।
দু’ভাই ঘাবড়ে গিয়ে বলল, নতুন ভূত? মানে?
—মানে, এই মাত্র মাসখানেক হল আমি ভূত হয়েছি।
চাঁদু বলল, ভূতের ভড়কি দিয়ে মাল হাতড়ানোর ধান্ধা। ইয়ার্কি হচ্ছে?
নতুন ভূত আহত গলায় বলল, ইয়ার্কি করছি? ছিঃ, এসব কী বলছেন? আমি সত্যি বলছি। আপনার গান শুনে আমি মুগ্ধ হয়েছি।
চাঁদু অবিশ্বাসের সুরে বলল, তুই কী করে জানলি, আমরা এখানে?
নতুন ভূত বলল, আমি তো ঈশেন কোনের বাবলা গাছটায় থাকি। আজ ছুটির দিন। তাই আমি যাচ্ছিলাম উচিলদার খগেন বাড়ুইয়ের বাগানে।
হাঁদু এবার বলল, কেন, সেখানে কেন?
—খগেন বাড়ুই তার পুকুরের কচুরিপানা তুলেছে কদিন আগে। কচুরিপানা পচে দুর্দান্ত দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে। নাক যেন একেবারে ঝাঁঝিয়ে ওঠে। আমি সেই ঘ্রাণ নিতে যাচ্ছিলাম। পথে গান শুনে চলে এলাম। কচুরিপানা পচার গন্ধের থেকেও আপনার গান সরেস।
চাঁদু তাড়াতাড়ি তাকে কাটানোর জন্য বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে। এখন যা যেখানে যাচ্ছিলি।
নতুন ভূত বলল, সে পরে গেলেও চলবে। গন্ধ তো আর পালাচ্ছে না। বলছি, একটু গান না আবার। আমি গান বেজায় ভালোবাসি কিনা! আর একবার না শুনে আপনাদের ছাড়ছি না। এরকম গান আজকাল সহজে মেলে না।
চাঁদু কী বলতে যাচ্ছিল। হাঁদু তার কানে কানে বলল, দাদা, মনে হচ্ছে এ সত্যি সত্যি ভূত। পায়ের দিকে দেখ। যেন ভেসে আছে।
চাঁদু দেখল সত্যি। সে যেন মাটিতে দাঁড়িয়ে নেই। হাওয়ায় ভাসছে। ঘুড়ির মতো দুলছে। লতপত করছে গোটা দেহ।
চাঁদু তুতলে উঠল, তু . . . তু . . . তুমি সত্যি সত্যি ভূত নাকি?
নতুন ভূত বলল, ভূতের আবার সত্যি মিথ্যে কী? ভূত তো ভূত।
চাঁদু বলল, হাঁদু, পালা।
দুজনে দৌড়তে শুরু করল। নতুন ভূত, আরে, পালাচ্ছেন কেন? শুনুন না। আর একবার গান না গানটা। শুনুন না। আরে পালাচ্ছেন কেন? ও মশাইরা . . .
এইসব বলতে বলতে সে তাদের পিছু নিল। চাঁদু হাঁদু প্রাণ ভয়ে দৌড়চ্ছে। তাদের পিছু পিছু নাছোড়বান্দা নতুন ভুত। প্রাণের ভয়ে চাঁদু হাঁদু আর পথ খুঁজে পাচ্ছে না। অন্ধকারে ঢেকে গেছে তাদের চোখের আলো। শুধু সামনের দিকে দুজনে ছুটে চলল অন্ধের মতো। তাদের কেবলই মনে হচ্ছিল এই বুঝি পিঠে একটা ঠান্ডা ছোঁয়া এখুনি এসে পড়বে। তারা আর থামতে পারল না। দম ধরে গেল, হাঁপিয়ে গেল। তবুও তারা ছুটে চলল। ছুটেই চলল।

গ্রামের মানুষ খুব ভোরে উঠে পড়ে। মুখ হাত ধুয়ে অনেকে গরু বাঁধতে মাঠের দিকেও আসে। এরকম একজন খুব ভোরে মাঠে গরু বাঁধতে এসে দেখতে পেল চাঁদু হাঁদু দুই ভাই চড়কডাঙার মাঠে গোল হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। অবাক হয়ে চাঁদুর পিঠে হাত দিতেই সে দড়াম করে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। চাঁদুকে পড়ে যেতে দেখে হাঁদুও পড়ে গেল। চিৎকার চেঁচামেচিতে গ্রামের আরও লোক ছুটে এল।

বাদামতলীর বিখ্যাত ধনী ব্যক্তি হলেন বীরেন সামন্ত। রোজের মতো ভোরে উঠে কূলদেবীকে প্রণাম করতে গিয়ে দেখলেন মায়ের গায়ের একটাও অলংকার নেই। চিৎকার চেঁচামেচি করে লোক জড়ো করে ফেললেন তিনি। ‘মায়ের অলংকার ফিরিয়ে আনবই’ এই প্রতিজ্ঞা করে লোকজন নিয়ে তিনিও বেরিয়ে পড়লেন চোর খুঁজতে। গোলমাল শুনে সদলবলে মাঠের মধ্যে এসে পড়লেন।

চাঁদুর পাশে থলেটা পড়েছিল। বীরেন উপুড় করে দিতেই সব অলংকার বেরিয়ে পড়ল। তিনি চিনতে পারলেন তাঁর কূলদেবীর অলংকার।

চাঁদু হাঁদুর যখন জ্ঞান ফিরল দেখল সারা গ্রামের লোক তাদের ঘিরে আছে। দু’ভাই লজ্জায় মাথা নীচু করে থাকল। এত বছরের চোরজীবনে এমন লজ্জায় তারা কখনও পড়েনি। হাঁদু ভয়ের চোটে সব হুড়মুড় করে বলে ফেলল। দিনের আলোতেও তার ভূতের ভয় এখনও কাটেনি।

গ্রামের লোকেরা তেড়ে মারতে এল। বীরেন বাধা দিলেন।

বললেন, থাক, থাক। এমনিতেই ভুতের হাতে পড়ে কম হেনস্থা হয়নি। আর মারধর কোরো না। উচিত শিক্ষা হয়েছে ওদের। আমার জিনিসও আমি ফিরে পেয়েছি।
তারপর চাঁদু হাঁদুকে বললেন, কিছুদিন ধরে রাতে পাহারা দেওয়ার জন্য দারোয়ান রাখব বলে ভাবছিলাম। তোরা যদি চুরি ছেড়ে দিবি কথা দিস, তাহলে তোদের রাখতে পারি।
তারপর আর কী! চাঁদু হাঁদু এখন বীরেন সামন্তের দারোয়ান। এই ব্যবস্থায় সবাই খুব খুশি। গ্রামের লোকেরাও হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। তারা এখন নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে।

শুধু সদু বুড়ি খুশি নয়। বুড়ি প্রায়ই দুঃখ করে বলে, গাঁয়ে একটাও চোর নেই, এ কেমন গাঁ বাপু? এমন গাঁ কি ভালো? কেমন যেন নিরিমিষ্যি নিরিমিষ্যি লাগে। দূর দূর।