ঢাকনা খুলতে গিয়ে যারপরনাই নাজেহাল হচ্ছিল বুচান। কী আঁটোসাঁটো রে বাবা! ঠিক যেন কেউ পেঁচে পেঁচে আঠা ছড়িয়ে রেখেছে! নতুন কেনা রঙের টিউবের ঢাকনা এরচেয়ে ঢের ঢিলেঢালা হয়।
অথচ দিদুর পাতলা ঘুমের সুযোগ নিয়ে, টুলের উপর উঠে, উঁচু তাক থেকে কাচের বয়াম পাড়া যে কী বিপজ্জনক কাজ— সে শুধু বুচান-ই জানে! এতটুকু শব্দ না করে, সেই টুলটাকে আবার আগের জায়গায় রেখে দেওয়াটও কি কম ঝক্কির? পুরনো দিনের কাঁঠালকাঠের জিনিস— পাথরের মতো তার ওজন! টানাহেঁচড়া করতে গিয়ে বুচানের কোমর টনটন করে উঠছিল। তা এতকিছু করে, পা টিপে টিপে, স্বপ্নামাসি আর বুড়ো দারোয়ানের চোখ বাঁচিয়ে, কত আশা নিয়ে ও চালতাতলায় এলো . . . সব আশায় একেবারে মুঠো মুঠো ছাই!
বুচানের হাত-টাত লাল হয়ে উঠেছিল। তাছাড়া তালুর কাছটা জ্বালা-জ্বালাও করছিল অল্প অল্প। অগত্যা কিছুক্ষণের জন্য রণে ভঙ্গ দিতে হল ওকে। দূরে যেখানে অল্প-অল্প ধুলো উড়ছে, একগাদা মনখারাপ নিয়ে সেদিকে তাকাল ও।
এদিককার দুপুরটা ভারী অদ্ভুত। ঠিক কলকাতার মতো নয়। শুধু মনে হয়—এই বোধহয় কিছু একটা হল! চারদিকটা কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া, আশ্চর্য থমথমে হয়ে থাকে। দূরের ঝোপঝাড় আর মাঠগুলো যেন ঘষা কাচের মতো ঝাপসা মনে হয়। কুকুর-বিড়ালগুলো এখানে-ওখানে বসে বসে ঝিমোয়, মানুষগুলো খুব দরকার ছাড়া বিশেষ বের-টের হয় না। এমনকি কলকাতার রাস্তায় ভরদুপুরে কত কাক চোখে পড়ে; আর এখানে হাজারে হাজারে পাখি থাকলে কী হবে, দুপুরবেলায় তাদের কারোর টিকিটির দেখা পাওয়া যায় না। বোধহয় ওদেরও ভাতঘুমের ব্যাপার থাকে!
কিন্তু বুচানের সঙ্গে সাতজন্মেও ভাতঘুমের সম্পর্ক নেই। এমনিতে অবশ্য ওই সময়টা ও ইস্কুলে কিংবা সাঁতারের ক্লাসে থাকে। যেদিন সেসবের বালাই থাকে না— সেদিন দুপুরটা কেটে যায় জমে থাকা হোমওয়ার্ক, আঁকা ইত্যাদি সেরে নিতে। এখন নেহাত গরমের ছুটি চলছে আর সেই ছুটিতে ও মামারবাড়ি এসেছে বলেই সময়টুকু ফাঁকা যাচ্ছে।
একগাদা মনখারাপ নিয়ে আবার বয়ামের দিকে তাকাল বুচান।
আহা, কী সুন্দর মৌরি লজেন্সগুলো! লাল, কমলা, সবুজ, হলুদ, সাদা, গোলাপি . . . ঠিক যেন অ্যাকোরিয়ামের কুচো কুচো নুড়িপাথর। কলকাতাতেও অবশ্য এ জিনিস পাওয়া যায়। কিন্তু এখানকার মৌরি লজেন্সের স্বাদই আলাদা! ঠিক যেমন দিদুর হাতের নাড়ু কিংবা মায়ের বানানো তেলের পিঠে— এই দুটো জিনিস যত ভাল দোকান থেকেই কিনে আনা হোক না কেন, কিছুতেই তাদের স্বাদ বাড়ির মতো খোলতাই হয় না!
এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল বুচান।
বয়ামটা আবার তাকে রেখে আসাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে কিনা, ভাবছিল সেসব কথাও। এমন সময় ওর চোখ পড়ে গেল বৌটার দিকে।
কতই বা বয়স হবে বৌটার? হবে ত্রিশ কি চল্লিশ! মোটাসোটা চেহারা, মাজা মাজা গায়ের রঙ। একগাদা সেকেলে ধরনের কাঁসার বাসনকোসন, নারকেলের ছোবড়া, ছাইয়ের বাটি ইত্যাদি নিয়ে, কুয়োতলা একেবারে আলো করে বসেছে। কী জোরে জোরেই না হাত চালাচ্ছে! ঠুনঠুন করে বাজছে চুড়িগুলো; আর দ্যাখ না দ্যাখ সোনার মতো ঝকঝক করে উঠছে ইয়া বড় বড় জামবাটি, কানাউঁচু থালা, কড়াই, বিরাট বিরাট সরাবাটি।
অচেনা মানুষ দেখে একটু যেন ভরসা পেল বুচান। তবে দুম করে এমন অচেনা-অজানা একজনের থেকে সাহায্য চাওয়াটা উচিত হবে কিনা, সেসব কথাও চিন্তা করল ও। কে জানে— শেষটায় যদি দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে তেড়ে- টেড়ে আসে বা কোমর বেঁধে দিদুর কাছে নালিশ করতে যায়— তবেই হয়েছে আর কী! বুচানের দিদা এমনিতে খুব শান্তশিষ্ট হলে হবে কী, বেচাল একেবারে বরদাস্ত করতে পারে না! একবার বুচানের মামা ভুল করে ঘরের ভিতরে কলার খোসা ফেলেছিল বলে, দিদা তাকে চারঘন্টা দুপুররোদে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল।
কিন্তু লজেন্সের লোভ বড় লোভ!
ইতস্তত করতে করতেই বুচানের মনে পড়ল দিদুর কথা, ‘আমাদের এখানকার লোকগুলো যেমন সরল, তেমনই পরোপকারী। সাহায্য চাইলে কক্ষনও খালি হাতে ফিরতে হয় না।’ তাছাড়া বৌটার মুখে এমন একটা নরমসরম মায়া-মায়া ব্যাপার ছিল যে, একটা আশ্চর্য ভরসা পাচ্ছিল ও।
একটু দোনামনা করে এগিয়ে গেল বুচান।
বৌটার মধ্যে অবশ্য কোনও হেলদোল দেখা গেল না। কে জানে বাবা, কানে শুনতে-টুনতে পায় কিনা! সে আগের মতোই মুখ গুঁজে কাজ করতে করতে, আরও দু’মুঠো ছাই ছড়িয়ে দিল বাসনগুলোর উপরে।
বৌটাকে দিদি বলা যায় নাকি কাকিমা, বুঝতে পারল না বুচান। অতএব একটু আমতা আমতা করে ডাকল ও, ‘এই যে, শুনছেন?’
মুখ তুলল বৌটা, ‘আমায় বলছ নাকি খোকা?’
আর যাই হোক, বৌটা যে অন্তত কালা নয়, ভেবে আশ্বস্ত হল বুচান। ঢক করে মাথা নাড়ল ও, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ। আপনাকেই বলছি। বলছি কি—আমার এই বয়ামটা—মানে এর ঢাকনাটা একটু খুলে দেবেন?’
বয়ামের দিকে তাকাতেই একরাশ কৌতুক ঝিকিয়ে উঠল বৌটার কালো চোখে, ‘এ যে দেখছি ল্যাবেঞ্চুসের শিশি!’
‘হ্যাঁ। এর ঢাকনাটা এমন এঁটে আছে . . . কিছুতেই সুবিধা করতে পারছি না।’
‘বুঝেছি খোকা, বুঝেছি—’ ফিক করে হেসে দিল বৌটা— ‘নির্ঘাত বড়রা ঘুমুচ্ছিল, আর অমনি সেই ফাঁকে সরিয়ে এনেছ—’
বুচানের তো একগাল মাছি, ‘কী করে বুঝলেন?’
শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে, ভুরু নাচিয়ে বৌটা বলল, ‘চুরির জিনিস কখনও সহজে ভোগ করা যায় না। ঠিক কোনও না কোনও একটা বাধা এসে যায়। কই খোকা, দাও দেখি—’ এই না বলে, এক মোচড়ে সে আলগা করে দিল বুচানের সাত রাজার ধন। তার কবজির জোর দেখে তো বুচান থ!
বয়ামটা ফেরত দিতে দিতে বৌটা বলল, ‘এই দেখো খোকা, পিঁপড়ে আটকানোর জন্য আগে মোটা কাগজ দিয়ে তারপর ঢাকনা আঁটা হয়েছিল। ওইজন্যই খোলা যাচ্ছিল না।’
বুচানের আর তর সইছিল না।
বয়াম হাতে নিয়েই, কাগজ-টাগজের দিকে না তাকিয়ে, সঙ্গে সঙ্গে একমুঠো লজেন্স মুখে ভরে ফেলল ও।
মুখ নাড়তে নাড়তে বুচান জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, আপনাদের বাড়ি কোথায়?’
‘এই তো—এখানেই। আর তোমাদের?’ আবার কাজ করতে করতে উত্তর দিল বৌটা।
‘আমাদের বাড়ি তো কলকাতায়। এখানে আমার মামারবাড়ি। এখন গরমের ছুটি কিনা, তাই বেড়াতে এসেছি। ওই যে দোতলা সাদা বাড়িটা, ওইটাই আমার মামারবাড়ি।’
বাড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বৌটা বলল, ‘ও, দত্তদের বাড়ির নাতি তুমি। তা তোমার বাবা-মাও এসেছেন বুঝি?’
‘না না,’ দু’পাশে মাথা নাড়ল বুচান— ‘বাবার তো এখন রোজ অফিস। মা-ও ওইজন্য আসতে পারেনি। তবে আমাকে নিতে ওরা আসবে। সে এখনও দিন দশেক দেরি আছে—’ আবার আরেক মুঠো মৌরি লজেন্স মুখে ভরল বুচান।
বৌটা আড়চোখে ব্যাপারটা দেখতে দেখতে বলল, ‘তবে ভরদুপুরে, একা একা চালতাতলায় ঘোরাঘুরি করাটা কিন্তু তোমার মোটেই ঠিক হচ্ছে না খোকা। তারউপর আবার মিষ্টি খাচ্ছ!’
‘কেন? এখানে কি বাঘ-ভল্লুক আছে নাকি?’ একটু ছমছম করে উঠল বুকানের বুকের ভিতরটা।
মুখ দিয়ে চুকচুক আওয়াজ করল বৌটা, ‘আহা, তুমি যে দেখছি কিছুই জানো না খোকা! তোমরা কলকাতার ছেলারা খালি ইংরিজিই পড়েছ!’ তারপর এক ঝটকায় গলাটাকে ভারী রহস্যময় করে নিয়ে সে বলল, ‘শোনোনি: কথায় আছে—ঠিক দুপুরবেলা, ভূতে মারে ঢেলা? এই ভরদুপুরেই তো তেনারা ঘুরে বেড়ান। আর চালতাতলা, বেলতলা, শ্যাওড়াতলা— এসব যে তেনাদের প্রিয় জায়গা— সে কথা কে না জানে!’
হেসে ফেলল বুচান, ‘ও, ভূত! না না, ভূতে আমি মোটেই বিশ্বাস করি না। আমাদের সায়েন্স টিচার সতেরো রকমের উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, ভূত-টূত কিছু হয় না। সব বোগাস!’
বৌটা মনে হল ভারী অসন্তুষ্ট হল।
পেঁচার মতো মুখ করে, একটা বগিথালার কিনারা ঘষতে ঘষতে বলল, ‘সে তোমাদের ওই টিচার না মাছের চার— সে সতেরো রকম কথাই বলুক আর সাতাত্তর রকমই বলুক— তাতে তো আর তেনাদের কথা মিথ্যে হয়ে যায় না। তেনারা হলেন বাতাসের মতো। দেখা যায় না, শোনা যায় না; কিন্তু না থাকলে পৃথিবীটাই চলে না।’
খুব মজা পেল বুচান, ‘তা তুমিও তো একা একা চালতাতলায় এসেছ। তোমার ভয় করছে না বুঝি?’
খুব একটা আত্মবিশ্বাসীর হাসি হেসে বউটা বলল, ‘আমার আবার ভয় কী? আমার হাতে পেঁচো-পাঁচির মাদুলি বাঁধা আছে না? তাছাড়া আমার গুরুমন্ত্র নেওয়া আছে। যাদের গুরুমন্ত্র নেওয়া থাকে, ভূত-পিশাচ-দত্যি-দানো তাদের কিচ্ছু করতে পারে না—’
ব্যাপারটা যে বুচান খুব পরিষ্কার বুঝল, তা নয়।
তবু বেশি কিছু জিজ্ঞাসা করলে পাছে বৌটা ভেবে নেয় যে, ও কিছুই জানে না—তাই খুব বুঝদারের মতো, গলাটা ভারী করে বুচান বলল, ‘ও।’
‘আচ্ছা, তুমি এমন চুরি করে ল্যাবেঞ্চুস খাচ্ছ কেন? তোমাকে বুঝি এমনিতে ল্যাবেঞ্চুস দেয় না? পেটে কৃমি আছে নাকি?’ কড়াইয়ের কালি তুলতে তুলতে জিজ্ঞাসা করল বৌটা।
পেটে কৃমি থাকাটা মোটেই সুবিধার কথা না।
অতএব তাড়াতাড়ি মাথা নাড়ল বুচান, ‘না না। আমি তো ফি সপ্তায় কৃমির ওষুধ খাই, কাঁচাহলুদের রস খাই। কৃমি হবে কোত্থেকে? আসলে আমার মা বলে দিয়েছে, আমি যেন প্রতিবার মিষ্টি খাওয়ার পর অবশ্যই দাঁত মাজি। ওইজন্য দিদু সবসময় আমাকে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে লজেন্স খাওয়ায়, তারপর দাঁত মাজিয়ে মুখ কুলকুচি করিয়ে নেয়।’
বৌটা কী বুঝল কে জানে! হিড়হিড় করে কপিকল টেনে বালতি বালতি জল তুলল। তারপর ডলে ডলে বাসনগুলো পরিষ্কার করতে লাগল।
বুচান বলল, ‘বাবাহ্, তোমার গায়ে তো খুব জোর! আমাদের ওই দারোয়ানটা পর্যন্ত একবালতি জল টানলে হাঁপিয়ে যায়।’
মুখ বেঁকাল বৌটা, ‘তোমাদের ওই দারোয়ানের কথা আর বোলো না খোকা! রাতদিন শুধু খাচ্ছে আর ঘুমুচ্ছে। কোনও কাজের না—’
তাড়াতাড়ি প্রতিবাদ করে উঠল বুচান, ‘না না। ও কিন্তু চমৎকার পাহারা দেয়। দু’বার দু’খানা চোরকে হাতেনাতে ধরেছে—’
বুচানের কথা শুনে বৌটা তো হেসে বাঁচে না! খুব কষ্ট করে, কোনওরকমে হাসি থামিয়ে সে বলল, ‘বলো কী খোকা . . . তোমাদের ওই দারোয়ান চোর ধরেছে? ওহ্ . . . তেমন তেমন চোর হলে না, তাদের এক রদ্দায় ও মুচ্ছো যাবে! বুঝেছ?’
কাঁধ ঝাঁকাল বুচান, ‘এমন চোর-তেমন চোর বুঝি না। ধরেছিল, তাই জানি—’
হঠাৎ বৌটার চোখদুটো ঢুলুঢুলু হয়ে এল।
খুব রহস্য করে বলল, ‘খালি তুমি কেন, সবাই তাই-ই জানে বটে। তবে আসল কথাটা অন্য—’
‘বেশ তো। তা তুমিই বলো আসল কথাটা কী,’ আরেক মুঠো লজেন্স মুখে ভরল বুচান।
হঠাৎ খুব উদাস হয়ে গেল বৌটা, ‘আচ্ছা খোকা, তুমি পুষ্পকুমারীর কথা জানো?’
ঘাড় নাড়ল বুচান, ‘হ্যাঁ, জানি তো। মায়ের কেমন যেন ঠাম্মা হতেন!’
হঠাৎ খুব দুঃখী-দুঃখী হয়ে উঠল বৌটার মুখ, ‘আহা রে, বড় ভালো মেয়ে ছিল সে। তার বাপ ছিল না, মা ছিল না, ঠেঙাড়ে এক মাসি-মেসো ছাড়া আর কেউ ছিল না . . . তোমার মায়ের দাদু তাকে পছন্দ করে, বাড়ির বউ করে এনেছিল। বড় ভালোবাসত সে এই বাড়ির লোকজনদের। কী তার কাজকর্ম! কী তার হাতের রান্না, সেলাইফোঁড়াই . . . গাছ পুঁতবে তো ফুলে ফলে ডাল ভেঙে পড়বে; বাসন মাজবে তো কাঁসাও সোনার মতো চকচক করবে; লেপ-কাঁথা বানাবে একেবারে নিখুঁত। কার কী পছন্দ, কার কখন কোনটা দরকার— সব ছিল একেবারে তার নখের ডগায়। বাড়ির লোকও তাকে একেবারে মাথায় করে রেখেছিল। তা এমন বউকে কোন বোকাই বা আর হেলাফেলা করে? তো সেবার যখন মড়ক লাগল আর গ্রাম কে গ্রাম উজাড় হয়ে যেতে লাগল— তখন পুষ্পকুমারীও পড়ল সেই রোগে। দু’দিন ভুগতে না ভুগতেই বেচারির শ্বাস ছেড়ে গেল। বদ্যিমশাই অবধি শোকের চোটে মুচ্ছো গেলেন।’ আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখের কোনা মুছল বৌটা।
‘তারপর?’
‘তারপর আর কী? চোখের জলে-নাকের জলে ভেসে সবাই তার দাহ করে এল। কিন্তু শেষ বললেই কি আর শেষ হয় খোকা? তারও শেষ হল না। এত মায়া কাটিয়ে সে কোত্থাও যেতে পারল না। সে-ই তো তোমার মামারবাড়ির আসল পাহারাদার। সেই থেকে কোনও চোর এই বাড়ি থেকে কুটোগাছও সরাতে পারে না। বাড়িতে ঢোকার সময় অবশ্য তারা কিছুই টের পায় না। কিন্তু চুরির জিনিস কি সহজে ভোগ করা যায় খোকা? তারা যখন সব হাতড়ে বের হয়, তখন তাদের পথ আগলে দাঁড়ায় পুষ্পকুমারী। তারাও অমনি মুচ্ছো যায়। তারপর, সকাল হলে তোমাদের দারোয়ান এসে তাদের দেখতে পায়, পাকড়াও করে আর নিজে বাহাদুরি নেয়—’
‘ওহ্, সেই ভূতুড়ে গল্প!’ হাই তুলল বুচান।
বৌটা মনে হল খুবই বিরক্ত হল, ‘গল্প হবে কেন? আমি কি শহরের লোকের মতো বানিয়ে বানিয়ে মিছে কথা বলি নাকি? এসবই নিয্যস সত্যি। নয়তো তোমাদের ওই দারোয়ান— যে কিনা এককোপে একটা নারকেল দু’টুকরো করতে পারে না—চোর ধরা কি তার কম্মো?’
‘আচ্ছা, আমি নাহয় বিশ্বাস করলাম যে এসব সত্যি। কিন্তু তুমি এত কথা জানলে কেমন করে? চোরগুলো তোমাকে বলেছে বুঝি?’
বৌটা ঝটপট বাসনগুলো গুছিয়ে নিল।
তারপর সেসব সামলে, উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তোমারও যেমন কথা! আমি জানব না তো জানবে কে? আমিই যে পুষ্পকুমারী। দিনের বেলা সংসারের কাজকম্ম সারি আর রাত জেগে বাড়ি পাহারা দিই—’ এই না বলে, চোখের সামনে সে একেবারে সিঁড়ি ভাঙার মতো তরতর করে কুয়োর মধ্যে নেমে গেল। চোখের সামনে থেকে মুছে যাওয়ার আগে বাসনগুলো যেন সত্যিই একবার সোনার মতো ঝিলমিল করে উঠল।
কেমন যেন চক্কর দিয়ে উঠল বুচানের মাথাটা।
ওর আঙুলগুলো আপনিই আলগা হয়ে এল আর অমনি ঝনাৎ শব্দ করে, হাত থেকে পড়ে গেল বয়ামটা।
কাচ ভেঙে, নিমেষের মধ্যে লজেন্সগুলো ছড়িয়ে পড়ল ধুলোর মধ্যে।
কে যেন ওর কানের কাছে বলে উঠল, ‘বলেছিলাম না, চুরির জিনিস সহজে ভোগ করা যায় না? মিলল তো?’