Categories
পুজোর খাতা ২০২৪ |

ছদ্মবেশী দীপুপিসি

168 |
Share
| ৩ অক্টোবর, ২০২৪
অনুভা নাথ

চিত্রবিন্যাস/ কমলাকান্ত পাকড়াশী

(একমিনিট ছোট্ট বন্ধুরা, এই গল্পটি লিখে জমা দেওয়া ইস্তক দীপুপিসি ও তার সাঙ্গোপাঙ্গ অর্থাৎ চটি, পেরেক আর ওর বিড়ালিনী— মালপোয়ার ভীষণ গোঁসা হয়েছে। গল্পে আমি, পিসি এন্ড কোম্পানির পরিচয় ঠিকঠাক দিইনি। তাই, আমি ঠোঙা, এই গল্পের লেখক, ওদের কাছে বিস্তর ক্ষমাটমা চেয়ে গল্পের প্রথমেই ওদের সমেত নিজের পরিচিতি দিলাম। কিছু কিছু পাড়া আছে যেগুলো বছরের পর বছর ধরে কী এক অজানা রহস্যময়তায় একই রকমের থেকে যায়। দীপুপিসিও কতকটা ওই ধাঁচের মানুষ। ভারত সরকারের সিক্রেট এজেন্ট থেকে শুরু করে তামাম পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভুত ও গুরুত্বপূর্ণ মিশনে আমাদের এই পিসির অবাধ বিচরণ। বয়স পঁয়ত্রিশও হতে পারে আবার পঁয়তাল্লিশও হতে পারে, মোটা ক্যাপসুলের মতো চেহারা, মাথার চুলগুলো ছোট ছোট করে কাটা, তামা আর লোহা গলিয়ে মিশিয়ে দিলে যেমন রঙ তৈরি হয় পিসির গায়ের রঙ ঠিক তেমন। পিসির সাগরেদ আমরা তিনজন— চটি, পেরেক আর আমি ঠোঙা। পিসি একবার মিশর অভিযানে গিয়েছিল। সেখানে এক মমি পিসিকে মশা ও পোকার হাত থেকে রক্ষার উপায় জিজ্ঞেস করেছিল। পিসি তার মশারিটা মমিকে দিয়ে দিয়েছিল। সেই মমির রিটার্ন গিফট হল মালপোয়া। ইনি একজন অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন বিড়ালিনী। আমার পরিচিতি পর্ব সমাপ্ত হল। এসো বন্ধুরা, এইবার মূল গল্পে প্রবেশ করা যাক।)

‘সবকিছুর একটা শেষ আছে . . . এভাবে কি হয়? আর তাছাড়া আমি দীপুপিসির চেয়ে পাক্কা পাঁচ ইঞ্চি লম্বা! মালপোয়া পিসির কোলে কোলে ঘোরে। একথা তো সকলেই জানে। সে তো আমাকে মোটে পছন্দ করে না, মিষ্টি করে ডাকলেই ঘ্রাও শব্দ করে তেড়ে আসে। কী খেপচুরিয়াস বিড়াল রে বাবা! ষড়যন্ত্রকারীরা পিসির বাড়ির ওপর নজর রাখছে। ওরা তো জানলা দিয়ে আমাকে দেখলেই বুঝে যাবে আমি দীপুপিসি নই’ একথা বলতে বলতে চটি নিজের মাথার পরা বুরুশের মতো উইগটা খুলে ফেলল।

আমি ঘাবড়ে গিয়ে বাড়ির মধ্যে উঁকি দিলাম। দেখি, দীপুপিসি মালপোয়াকে কোলে নিয়ে আয়েস করে বসে রসগোল্লা খাচ্ছে! এখন যদি পিসি চটির কথা শুনতে পায় তাহলে কী কাণ্ড করবে তা আমি আর ভাবতেও পারলাম না।

আমি পেরেকের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললাম, ‘সময় বেশি নেই, চটিকে এখুনিই বেরোতে হবে’।

চটি মাথা জোরে জোরে চুলকাতে চুলকাতে বলল,
‘এই উইগটা কী কুটকুট করে রে বাবা, উফ্ মাথার সব চুল উঠে গেল . . .’
তারপর আবার উইগটা পরে নিয়ে ভালো করে মাফলার জড়িয়ে সে বাইরের দিকে বেরিয়ে গেল। পিসি এসব কিছুই নজর করল না।

কিছুক্ষণ পরে গাড়ির শব্দে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘যাক, চটি গাড়ি চেপে বেরোল, এইবার আমার পালা’।
পিসি রসগোল্লার শেষ রসটুকু খেয়ে মালপোয়াকে সঙ্গে নিয়ে শোওয়ার ঘরের দরজা বন্ধ করল। মিনিটখানেকের বিরতি। তারপরই পিসিকে দেখে আমার আর পেরেকের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল।
কিন্তু, পিসি নির্বিকার গলায় বলল, ‘ঠোঙা, হাঁ করে দেখার কিছু নেই, আমি পাঁচরকম কায়দায় শাড়ি পরতে পারি, হু হু বাওয়া যা ছদ্মবেশ নিয়েছি, ওদের চোদ্দপুরুষের ক্ষমতা নেই আমায় চিনবে।’
পেরেক বলল, ‘তুমি নিজে নিজেকে চিনতে পারছ? জীবনে কখনও শাড়ি পরেছ? সারা জীবন তো প্যান্টলুন আর জামা পরে কাটিয়ে দিলে!’
পিসি ওর দিকে যেমন জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকাল তাতে শীতকাল না হলে পেরেক নিশ্চিত পুড়ে যেত!
তারপর আমরা দেখলাম পিসি একগলা ঘোমটা টেনে পেছনের দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।

এরপর কেটে গেছে দীর্ঘ একমাস। আমরা পিসির কোনও খবর পাইনি। এরই মধ্যে একদিন দুপুরে ঘটে গেল অবাক ঘটনা! পেরেক এই একমাস যাবৎ মালপোয়ার জন্য জোমাটো, সুইগিতে খাবার আনিয়ে যাহোক করে চালাচ্ছিল। কিন্তু, দুদিন হল মালপোয়া বেঁকে বসেছে। বহু কষ্টে তার গলার আওয়াজ রেকর্ড করে বার বার শুনলাম। পাঁচশোবার শোনবার পর বুঝলুম, সে আসলেই বলতে চায়, বাইরের খাবার খেয়ে তার মেদ বৃদ্ধি হয়েছে, অতএব, বাড়ির রান্না করা খাবার তাকে দিতে হবে! এমন বেআক্কলে কথা শোনা ইস্তক আমরা দু’জনেই একদম চুপ মেরে গেছি। বেড়ালের রান্না করা আমাদের কম্মো নয়। তাও এ যে সে নয়, অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন বিড়ালিনী!

সেদিনই দুপুরে কড়া নাড়ার শব্দে দরজা খুলে দেখি, একজন লোক দাঁড়িয়ে। পরনে ধুতি, ইয়া লম্বা গোঁফের আড়ালে প্রায় পুরো মুখটাই চাপা পড়ে গেছে। নিজেই তড়বড় ভোজপুরিতে যা বলল, তার মানে করলে দাঁড়ায়, সে আমাদের বিড়ালিনী মালপোয়ার জন্য রান্না করবে। আমি আর পেরেক আকাশ থেকে পড়লাম। আমরা তো কারোকেই মালপোয়ার রান্নার কথা বলিনি। এই লোকটি তাহলে কোথা থেকে জোগাড় হল? ততক্ষণে দেখি মালপোয়া একলাফে লোকটির কোলে উঠে পড়েছে। লোকটির দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখি কোথায় কী? এ তো আমাদের দীপুপিসি দাঁড়িয়ে!

পিসি বৈঠকখানায় জমিয়ে বলেই বলল, ‘কয়েক খিলি পান আন তো দেখি, এই ক’দিন পান না খেয়ে জিভে চড়া পড়ে গেছে’। ততক্ষণে চটিও এসে পৌঁচেছে।
পিসি আসনপিঁড়ি হয়ে বসে নিজের নকল গোঁফে তা দিতে দিতে বলল, ‘হু হু বাওয়া, আমার সঙ্গে চালাকি! সিক্রেট মিশন সাকসেসফুলি কমপ্লিট করে চলে এলাম, আর চক্রান্তকারীরা বুঝতেও পারল না’—
আমরা তিনজন ততক্ষণে পিসির চারিদিকে গোল হয়ে বসলাম। পিসি পান চিবুতে চিবুতে অভিযানের গল্প শুরু করল।

‘নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা তো আমরা সবাই জানি। এটি ছিল প্রাচীন পৃথিবীর সর্বপ্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে গৌতম বুদ্ধ থেকে শুরু করে হিউএন সাং পর্যন্ত এসেছিলেন। কিন্তু, এটির ধ্বংসকাহিনি বড় করুণ। ১১৯৬ সালে বকতিয়ার খিলজি এটি ধ্বংস করেন। কথিত আছে, এখানকার গ্রন্থাগারে এত বই ছিল যে, আগুন লাগাবার পর সেই গ্রন্থাগারে একটানা তিনমাস আগুন জ্বলেছিল! সেই জগতখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের যখন আরও একটি ভাগ আবিষ্কৃত হল তখন ভারত সরকার সেখানকার প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানাল . . . ’
পিসি একটু থেমে আবার বলল, ‘এতদিন রাশিয়া থেকে মিশর— পৃথিবীর অনেক জায়গায় বিভিন্ন অভিযান চালিয়েছি, কিন্তু এবারের বিষয়টা ছিল সকলের চেয়ে আলাদা—’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন? সেখানে কি লুকানো গুপ্তধন ছিল?’
পিসি রহস্যময় হাসি হেসে বলল, ‘তার চেয়েও দামী জিনিসের সন্ধান পেয়েছি সেখানে—’
মালপোয়া জিজ্ঞাসু সুরে ম্যাও বলে উঠল।
আমরাও বিস্ফারিত চোখে পিসির দিকে তাকিয়ে।
পিসি মালপোয়াকে কোলে নিয়ে বলতে শুরু করল।
‘নালন্দার একটা অংশ আগেই আবিষ্কৃত হয়েছিল। মাসখানেক আগে মূল অংশ থেকে চার কিলোমিটার দূরে এটির আরও একটি অংশ জুওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া আবিষ্কার করে। এই নতুন আবিষ্কারের কথা প্রথম থেকেই গোপনীয় রাখা হয়েছিল। তবুও একটা দল সেই খবর জেনে যায়। তাই ওরা আমার ওপর নজর রাখতে শুরু করে। তবে, আমিও ছদ্মবেশে ওদের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে যেতে পেরেছিলাম।

আমি আর ড: আহমেদ যখন নালন্দার নতুন আবিষ্কৃত জায়গায় গিয়ে পৌঁছলাম তখন দুপুরের রোদে ঝলমল করছে চারিদিক। রঙ চটে যাওয়া, ভাঙা ইটগুলোয় সেই আলো যেন আকাশের গায়ে মেঘ লাগার মতো জমে উঠেছে। আমরা স্তূপটির দিকে এগিয়ে গেলাম। ততক্ষণে প্রত্নতাত্ত্বিকের একটা বড় দল আশেপাশে খননকার্য শুরু করেছে। আহমেদ আমাকে স্তূপের পশ্চিমদিকে নিয়ে গেল। ছাতা আকৃতির জায়গাটার লাল ইট অনেক বিবর্ণ হয়ে সাদাটে হয়ে গেছে। কেমন যেন নিস্তব্ধ, চুপচাপ। এখানে আশেপাশে আমি আর আহমেদ ছাড়া আর কেউ নেই। ঢালু ছাদটার চারপাশে লম্বা খিলান, মাঝখানটা খালি। আমরা চারপাশ ভালো করে পর্যবেক্ষণ করছিলাম। কাজ করতে করতে কখন যে বেলা পড়ে এসেছে তা বুঝতে পারিনি। খেয়াল হল যখন দেখলাম, বিকেলের রোদ দিনের শেষ ট্রেনের মতো সন্ধ্যার গন্তব্যে পৌঁছাতে ব্যস্ত। আমরা ঠিক করলাম আগামীকাল এখানে আবার আসব। আর তখনই ঘটল একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা—’
এতদূর পর্যন্ত বলে পিসি চুপ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। আমরা তখন রীতিমতো উত্তেজিত। মালপোয়াও পিসির কোলে বসে ঘনঘন লেজ নাড়ছে। পিসি আর এক খিলি পান খেয়ে বলতে শুরু করল—
‘তখন, স্তূপের খিলানগুলের গায়ে পাতলা চাদরের মতো বিকেলের ছায়া জড়িয়ে যাচ্ছে। হঠাৎই ফুট খানেক দূরে ইটের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে
দেখলাম, পাথরের একটা পদ্মফুল। ফুলটার পাপড়িগুলো ফেটে গেছে। কিন্তু সেটির অপূর্ব ভাস্কর্য এতবছর পরও অবাক করা সুন্দর। ফুলটির মাথায় বসানো সবুজ রঙের একটা পান্না। আমি ওটা আহমেদকে দেখালাম। আমরা দুজনেই পাথরের পদ্মের দিকে এগোলাম . . .’
পেরেক পিসিকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা পদ্মটিকে দেখে এত অবাক হলে কেন?’
পিসি খুশি হল। বলল, ‘গুড কোশ্চেন, এই তো তোর ঘিলু কাজ করছে। নালন্দা শব্দটি সংস্কৃত ‘নালম’ আর ‘দা’ দুটি শব্দের যোগাযোগ থেকে এসেছে। ‘নালম’ মানে পদ্ম আর ‘দা’ মানে ফুল। পদ্ম আবার জ্ঞানের প্রতীক। তাই, আদ্যপান্ত ইটের তৈরি এই প্রাগৈতিহাসিক স্তূপের মধ্যে পাথরের তৈরি পদ্মফুল কেন? এই প্রশ্ন আমাদের মাথায় চাগাড় দিয়ে উঠল। আমি নিচু হয়ে পদ্মটিকে ধরলাম। তারপর কী মনে হতে পাথরের পদ্মের মাথায় লাগানো পান্নায় জোরে চাপ দিলাম—’
আমি সকলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সবাই দীপুপিসিকে রুদ্ধশ্বাসে দেখছে। এমনকি মালপোয়া পর্যন্ত পিসির কোলে বসে উত্তেজনায় ঘন ঘন লেজ নাড়ছে!
পিসি বলে চলেছে—
‘ঘড়ঘড় শব্দে নিচে তাকিয়ে দেখি আমাদের দু’জনের পায়ের কাছে মেঝেতে একটা ফাটল তৈরি হচ্ছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে পাশে সরে গেলাম। কিন্তু আহমেদ টাল সামলাতে না পেরে ফাটলটার মধ্যে পড়ে গেল। একটু পরে দেখলাম, মাটির নীচে আলো আঁধারিতে একটা ভাঙা সিঁড়ি নেমে গেছে। ততক্ষণে আমাদের আশেপাশে অন্য দলগুলো অনেক আগেই সেদিনের কাজ শেষ করে চলে গেছে। অগত্যা আমি কারোকে না পেয়ে সিঁড়ির সামনে গিয়ে আহমেদের নাম ধরে ডাকলাম। কেউ সাড়া দিল না। আমি নীচে নামতে শুরু করলাম। ভাগ্যিস সঙ্গে একটা টর্চ ছিল তাই রক্ষে। কিছুটা নেমে দেখলাম, আহমেদ পড়ে রয়েছে। শ্বাস মৃদু। তার মানে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। এসব ক্ষেত্রে সাহায্যকারী দলের সঙ্গে যোগাযোগ করা নিয়ম। কিন্তু, তোরা তো আমায় চিনিস—’ পাশ থেকে চটি ফিসফিস করে বলে উঠল, ‘তা আবার চিনি নে, হাড়ে হাড়ে চিনি’।
আমি ওকে কনুই মেরে চুপ করালাম। এবারের অভিযানের জন্য চটিকে পিসির নকল সাজতে হয়েছিল, তাই সে খানিক বিরক্ত।
আমরা আবার পিসির কথা শুনতে শুরু করলাম।

‘আমি একাই অন্ধকারে সুড়ঙ্গের মধ্যে চলতে শুরু করলাম। সুড়ঙ্গ কোথাও সরু আবার কোথাও নিচু হয়ে গিয়েছে। অনেক জায়গায় তো বুকে হেঁটে এগোতে হল। এভাবে প্রায় কুড়ি মিনিট কাটল। একবার ভাবলাম, ফিরে যাই। এই সুড়ঙ্গে ধ্বস নামলে এখানেই মরে পড়ে থাকতে হবে। কিন্তু ওই যে, রোখ চেপে গিয়েছিল। একসময়, টর্চের কম আলোয় দেখলাম, সুড়ঙ্গের বাঁদিকে ওপরে ওঠার সিঁড়ি। কোনও রকমে গুঁড়ি মেরে উঁচু নিচু পাথরের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলাম। ওপরে একটা চওড়া ছাদের মতো জায়গা বানানো হয়েছে। এত ধুলো আর নোংরা যে তাতে আমার পা ডুবে যেতে লাগল। আমি সেসব ভ্রূক্ষেপ না করে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। কিছুটা এগিয়ে বাঁদিকে আলো ফেলে যা দেখলাম তাতে তো আমার চক্ষু চড়ক অবস্থা! অবাক কাণ্ড একেবারে, সেখানে থরে থরে সাজানো তালপাতা,ভূর্জপাতার পুঁথি! আর কী আশ্চর্য, এত হাজার বছর পরও সেই পুরানো পুঁথিগুলি একটুও নষ্ট হয়নি। আমি আনন্দে নেচে উঠলাম। তার মানে, নালন্দা বিহারের সমস্ত পুঁথি ধ্বংস হয়ে যায়নি। এই পুঁথি আবিষ্কারের মধ্যে দিয়ে হয়তো ভারতের তো বটেই সারা পৃথিবীর ইতিহাসের কিছু অংশ আবার নতুন করে লেখা হবে। এই অভূতপূর্ব আবিষ্কার করতে পেরে আমি যারপরনাই আনন্দিত হয়ে উঠলাম।’
আমি উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলাম, ‘তারপর?’
পিসি বলল, ‘তারপর,আমি তাড়াতাড়ি করে বাইরের পথে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু,সেখানে ঘটল এক কাণ্ড!’
আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম, ‘কী?’
পিসি বড় বড় চোখ করে বলল, ‘সারি সারি বইয়ের সামনে রাখা রয়েছে আগের মতোই আরও একটা পাথরের পদ্মফুল। তবে, সেটির মাথায় বসানো লাল রঙের ইয়া বড় একটা রুবি। আরও একটু ভালো করে লক্ষ করাতে দেখলাম, বইগুলোর পাশে এদিক-ওদিকে ছড়িয়ে রয়েছে বেশ কিছু নরকঙ্কাল। আমি যা বোঝার বুঝে গেলাম। লাল পদ্মটিকে একটুও স্পর্শ না করে সন্তর্পণে নিচে নেমে এলাম।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তারপর?’
পিসি বলল, ‘তারপর আর কী, নটে গাছটি মুড়োল, আমার গল্প ফুরোল। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার প্রতিনিধিরা সেই পুঁথি উদ্ধার করলেন। আহমেদের জ্ঞান ফিরেছিল পরে—’
চটি বলল, ‘আর সেই চক্করে আমাকে তোমার ছদ্মবেশ নিতে হল!’

আমি ভয়ে ভয়ে পিসির দিকে তাকালাম, এইবার বুঝি পিসি চটিকে রাম ধাতানি দেবে . . . কিন্তু, সেসব না করে পিসি তার পান-খাওয়া লালচে দাঁত বার করে হাসতে হাসতে বলল, ‘দীপমালা রায়ের ছদ্মবেশ নিতে পেরে তোর তো গর্বিত হওয়া উচিত রে।’
আমি আর পেরেক ঠিক ঠিক বলে মাথা নাড়তে লাগলাম। চটি আর হালে পানি না পেয়ে চুপ করে গেল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিন্তু, পিসি ওই লাল পদ্ম আর নরকঙ্কালের বিষয়টা তো পরিষ্কার হল না’ . . .
পিসি খানিক চুপ করে বলল, ‘নালন্দার ওই গ্রন্থাগারটি ছিল লুকানো জায়গা। মানুষের লোভই তার ধ্বংসের কারণ। একথা নালন্দার কর্তাব্যক্তিরা জানতেন। তাই তাঁরা বানিয়েছিলেন এক অভিনব কৌশল। লুকানো লাইব্রেরিতে অবাঞ্ছিত কোনও মানুষ চলে গেলেও বাইরে বেরিয়ে আসা ছিল কঠিন। সে লোভের বশবর্তী হয়ে ওই লাল পদ্ম স্পর্শ করলেই সিঁড়ি ঘুরে গিয়ে বাইরে আসবার সব রাস্তা বন্ধ হয়ে যেত। তখন মানুষটির পচে মরে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকত না। আমি পদ্মের ওপর লাল চুনি দেখে সেইরকম একটা আশঙ্কা করেছিলাম, তাই সেটিকে স্পর্শ করিনি।’

আমরা কিছুক্ষণ রুদ্ধশ্বাসে বসে রইলাম। সম্বিত ফিরল পিসির গলার আওয়াজে। শুনলাম পিসি মালপোয়াকে আদর করে বলছে, ‘সংস্কৃত ভাষায় লেখা সেই অমূল্য পুঁথির কিছু কপি করা অংশ আমার সঙ্গে রয়েছে, এগুলো থেকে আমি মালপোয়াকে পড়াব!’
এইকথা শুনে আমাদের চোখ বিস্ময়ে গোল রসগোল্লার মতো বড় বড় হয়ে গেল! বিড়াল সংস্কৃত পড়বে? কে কোন যুগে এসব শুনেছে?
অবাক হওয়ার তখনও কিছু বাকি ছিল, আমরা তিনজন মালপোয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি, সে তার দুধসাদা লেজ নেড়ে হাসিমুখে পিসির দিকে তাকিয়ে ম্যায়ওওওও করল, যার বাংলা মানে করলে দাঁড়ায়, ‘শুভস্য শীঘ্রম!’