‘বাড়িতে আজ তোর জন্য দারুণ সারপ্রাইজ’, স্কুল থেকে ফেরার পথে দাদু বললেন আমায়। উত্তেজনায় মন প্রায় দৌড়ে পৌঁছতে চাইছে বাড়ি, না জানি কী জিনিস রয়েছে অপেক্ষায়। অবশেষে এল সেই মুহূর্ত। আমার হাতে তুলে দেওয়া হল বেশ কয়েকটি রংবেরঙের কাগজের টুকরো, যার চারদিকে সমান করে খাঁজ কাটা। এতদিনে এই জিনিসটার নাম আমি কিন্তু জেনে গেছি— ডাকটিকিট। ডাকবাক্সে পিওন যে চিঠিগুলি ফ্যালে তারই এক কোণায় সাঁটা থাকে সযত্নে। মনে পড়ে গেল স্কুলের বন্ধু সব্যসাচী তার রঙিন স্ট্যাম্প অ্যালবামটি ক্লাসে এনে ক’দিন আগেই আমাদের তাক লাগিয়েছিল। বাড়ি ফিরে সেদিন চুপি-চুপি দুঃখ করে বলেছিলাম, ‘ইস! আমারও যদি একটা এরকম কিছু থাকত!’ সেদিন তাই যেন আমার ইচ্ছাপূরণেরই জন্মদিন। আজও ডাকযোগে সেই আমার প্রথম-পাওয়া ডাকটিকিটগুলো যেন পিছু ডাকে আমায়— হারানো রামধনুমাখা শৈশবকালে। ছুট্টে ফিরে যাই ছোট্টবেলায়। আমাদের দুই আত্মীয় থাকতেন সুদূর মার্কিনদেশে ও পশ্চিম জার্মানিতে। সেখান থেকে আসা এয়ারোগ্রামেই আটকানো ছিল খ্রিস্টমাসের ছবি-ভরা সেই ডাকটিকিটগুলো। সালটা বোধ হয় ১৯৮৭।
সেই শুরু। এক নতুন বন্ধুত্বের পথ চলা। ডাকটিকিটের অমোঘ ডাকে তখন আমার অন্য সব খেলাধুলো ডকে। এসে গেল নতুন অ্যালবাম। স্কুলের বন্ধুদের মধ্যেও কিছুটা রোগ ছড়িয়ে দিলাম আমি। তবে সে সংক্রমণ ভাল লাগার, ভালবাসার, নতুনকে জানার। তার আগে কি জানতাম Maggi-র সাথে মিল থাকা Magyar বলতে পূর্ব ইউরোপের ছোট্ট দেশ হাঙ্গেরিকে বোঝায় বা Sverige আসলে সেই সময়ের বিখ্যাত টেনিস স্টার স্টেফান এডবার্গের জন্মভূমি সুইডেন? বন্ধুদের মধ্যে কোড ল্যাঙ্গুয়েজ, ‘চল Helvetica যাবি?’ সুইজারল্যান্ড বলার থেকে Helvetica যেন অনেক বেশি আপন এক রূপকথার রাজ্য। সেই রাজ্যের এন্ট্রি টিকিটও তো জুগিয়েছিল এই ডাকটিকিটই! আজ বড়বেলায় এসে রোমাঞ্চ হয় এই ভেবে যে কীরকম বিশ্বজয়ের স্বাদ পেয়েছিলাম স্কুলের দৈনিক ‘স্ট্যাম্প এক্সচেঞ্জ’-এর হাটে সেরা ডাকটিকিট নিজের বুক পকেটে পুরে। বুকটা কি ইঞ্চি দশেক চওড়া হয়ে যায়নি সেই দিনগুলোয়?
এরপর ধীরে ধীরে বয়স বাড়ল। সাথে বাড়ল ডাকটিকিটের নেশাও। ভরে উঠল স্ট্যাম্প অ্যালবাম। নানা দেশের সংস্কৃতি, কীর্তি, ইতিহাস, ভৌগোলিক বৈচিত্র, খেলাধুলো, পশুপাখি, বিশিষ্ট মানুষজন, আরও কত কী ধরা পড়ল আদরের অ্যালবামের পাতায় পাতায়। শখ হয়ে উঠল বিশ্ববিচিত্রার সাথে নতুন করে পরিচয়ের এক দুর্দান্ত ক্যাটালিস্ট। আমিও নিজের অজান্তে হয়ে উঠলাম মনোযোগী ফিলাটেলিস্ট (philatelist)। সবসময় কড়া নজর— কোনও বন্ধুর নিকট-আত্মীয় বিদেশযাত্রার কোনও বিমান ধরছে কিনা বা কারোর বাড়িতে হঠাৎ আবিষ্কার হয়েছে কিনা অতি পুরনো কোনও par avion লেখা এয়ারমেল! পাওয়া তো যেতেই পারে আরও কিছু অমূল্য রতন! ডাকটিকিটের ডাকে এতদিনে জেনে গিয়েছি অনেক গোড়ার কথা। ১৮৪০ সালে ইংল্যান্ডের ডাকঘর থেকে প্রকাশিত পৃথিবীর প্রথম ডাকটিকিট মহামূল্য ‘পেনি ব্ল্যাক’। বিলেতের মহারানির মাথার দাম যে কত হতে পারে প্রথম জেনে ছিলাম এই ডাকটিকিটের হাত ধরেই তো! আরও জানতে পারলাম ১৮৫৩ সালে ছাপা প্রথম তিন-কোণা ডাকটিকিটের কথা। ‘কেপ অব গুড হোপ’ নামক অন্তরীপের কিছু ডাকটিকিট নাকি ভুল ছাপা হওয়ায় স্ট্যানলি গিবনস নামক এক ইংরেজ সংগ্রাহক বড়লোক হয়ে গিয়েছিলেন রাতারাতি। ভুল হলে নম্বর কাটা যায় এটাই তো নিয়ম! তা যে শাপে বরও হয়ে উঠতে পারে সেটা কি ডাকটিকিট না জমালে বুঝতাম?
আজকের ব্যস্ত সময়ে ডাকটিকিট হয়তো হারিয়েছে তার জন্মগত জৌলুস। ইমেইল-এর চাপে এয়ারমেল আজ পাড়ি দিয়েছে কোনও হারানো অজানা দেশে। চিঠি লেখা ছেড়ে এমএমএস, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ-এই বুঁদ আজকের প্রজন্ম। তবু মলিন হয়নি আজও ডাকটিকিটের কৌলিন্য। হারানো দিনের স্মৃতির আঠালো-গন্ধে-মাখা ‘স্ট্যাম্প হিঞ্জ’-এর সাথে আটকে, আমার মতো বহু মানুষের ছোটবেলার কোনও আলমারির গুপ্তকুঠুরির ভিতরে, আজও নিশ্চিন্তে নিশ্চয়ই নিঃশ্বাস নিচ্ছে ডাকটিকিটের চিরনবীন দুনিয়া। সময়ের ধূলিকণা আজও তাদের ছুঁতে পারেনি। হয়তো পারবেও না কোনওদিন।