Categories
প্রকৃতির ডাকঘর |

জলাভূমির সাতকাহন ২

1150 |
Share
| ২১ অক্টোবর, ২০২০
ডঃ সুস্মিতা সেন

ভূগোলের অধ্যাপিকা, শ্রীশিক্ষায়তন কলেজ

জলাভূমি, চিত্র সৌজন্য: লেখিকা

জলাভূমি বলতে কী বোঝায়?

জলাভূমি বলতে বোঝায় সেই সব জমিগুলো যেগুলো জলজ উদ্ভিদ, লতা, গুল্ম, ঘাস (যা আবার পরিবর্তিত হয়ে সার বা জ্বালানি হিসাবেও ব্যবহার করা যায়)— এইসবে ভরা। এইরকম জমি প্রাকৃতিকভাবে বা মানুষের তৈরিও হতে পারে। জলাজমির জল স্থির বা বহতা দুইই হতে পারে; মিষ্টি, নোনা আবার মিশ্রিত ঈষৎ নোনাও হতে পারে। যেসব জলাভূমিতে জোয়ার ভাঁটা খেলে সেইখানে ভাঁটার সময় জলের গভীরতা ছয় মিটারের বেশি হয় না।

পরবর্তীকালে বিশেষ সংরক্ষণের কারণে র‍্যামসার— নদী অঞ্চল, সমুদ্রের তটীয় অঞ্চল, জলাভূমির মধ্যের দ্বীপ এবং ছয় মিটারের বেশি গভীর জলাভূমির অংশকেও জলাভূমির আওতায় আনা হয়েছে।

জলাভূমি নানারকমের হয় যেমন:

১। সামুদ্রিক (সমুদ্রের তটবর্তী হ্রদ ও উপহ্রদ (lagoon); জোয়ার ভাঁটা খেলে এমন তটর্বতী পাথুরে অঞ্চল, প্রবাল প্রাচীর)
২। নদীর মোহানা অঞ্চলের জলাভূমি (বদ্বীপ, জোয়ার ভাটা খেলে নাতিশীতোষ্ণ ও হিম মণ্ডলের এমন জলাভূমি, ম্যানগ্রোভ জলাভূমি)
৩। হ্রদজনিত (যেসব জলাভূমি হ্রদের সঙ্গে যুক্ত)
৪। নদীজনিত (যে সব জলাভূমি নদীর সঙ্গে যুক্ত)
৫। প্যালাসট্রাইন (Palustrine) (মিষ্টি জলের উদ্ভিদ-পরিপূর্ণ জলাভূমি)

এছাড়াও আছে মানুষের তৈরি জলাভূমিগুলো যেমন:

১। মাছ, চিংড়ি ইত্যাদি চাষের খামার আর পুকুর
২। জলসেচ দেওয়া চাষের জমি
৩। নুনের খাত বা কূয়া
৪। জলাধার
৫। জলপূর্ণ গর্ত যা খুড়ে কাঁকড় তোলা হয়
৬। ময়লা জলের চাষের খামার
৭। খাল

এখন প্রশ্ন হল জলাভূমি নিয়ে এত আলোচনার কী দরকার? আমাদের জীবনে এর গুরুত্ব কী?

১। সারা পৃথিবীতে জলাভূমি বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীর বাসস্থান এবং আশ্রয়স্থল। আবার এদের মধ্যে মাছ আর অনেক অমেরুদণ্ডী প্রাণী (শামুক, গেঁড়ি গুগলি জাতীয়) আর পাখি জলাভূমিতেই থাকে আর বাসা বাধে।

২। আবার কোনও কোনও জলাভূমিতে এমন উদ্ভিদ ও প্রাণী পাওয়া যায়, যা আর অন্য কোথাওই পাওয়া যায় না। ফলে দেখা যায় যে জলাভূমিতে সাধারণ এবং বিরল প্রজাতির এই দুই রকমেরই উদ্ভিদ ও প্রাণী থাকে। এছাড়া ব্যাঙের মতো নানা উভচর প্রাণীও এখানে পাওয়া যায়। এরই জন্য জলাভূমির জীববৈচিত্র্য খুব বেশি হয়।

৩। এর মধ্যে থেকে বহু উদ্ভিদ ও প্রাণী মানুষের জীবন ও জীবিকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো একদিকে যেমন খাবার, ওষুধ এবং বাসস্থানের জন্য জরুরী তেমনিই হাজার হাজার মানুষের জীবিকা এই জলাভূমিকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠে।

জলাভূমির উদ্ভিদ
জলাভূমির উদ্ভিদ বলতেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে ধান। এছাড়াও আছে মাদুরকাঠি, নলখাগড়া, শোলা, পদ্ম, শালুক, শাপলা, কচুরিপানা, পানিফল, মাখানা, ঝাঁঝি, হোগলা, কলমী, শুষনী, নানারকমের পানা ও আরও কত কী; সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের সুন্দরী, গরান, গোলপাতা ও ছোট বড় আরও অনেক গাছ ও লতাপাতা।

জলাভূমির পশুপাখি
পশুর মধ্যে মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ি, শামুকজাতীয় প্রাণী, শুশুক, কচ্ছপ, ভোঁদড়, ঘড়িয়াল, পোকামাকড় এবং আরও কত কী। আর পাখির কথা বলতে গেলে কত যে অজস্র প্রজাতির পাখি এই জলাভূমিতে দেখা যায় যে তার আর ইয়ত্তা নেই। কেউ সারাদিন জলে জলে ঘোরে; আবার কেউ জল থেকে খাবার নিয়ে উড়ে চলে যায়; আবার কেউ কেউ বছরের একটা সময় এসে ভিড় জমায়। এরা পরিযায়ী পাখি, অনেক দূরের ঠাণ্ডা জায়গা থেকে আসে। এরা দেশ বিদেশের সব পাখি। নিজেদের ঠাণ্ডা বাসস্থান ছেড়ে কয়েক মাস একটু কম ঠাণ্ডা যেখানে সেইরকম পরিবেশে থাকতে ভালবাসে।

কিছু পাখি যেমন পানডুবি, পানকৌড়ি, গয়ার, জলপিপি, কায়েম, কোঁচবক, সাদাকাঁক, শামুকখোল, মদনটাক, জলপায়রা, জলময়ূর, নাক্টাহাঁস, সরাল হাঁস, বালি হাঁস, মেটেহাঁস, ডাহুক, ডাউখোল ইত্যাদিকে সারাদিন জলাভূমিতে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। আবার আরেক জাতীয় পাখি জলাভূমিতে থেকে মাছ আর ছোট প্রাণী ধরে নিয়ে গিয়ে খায়। এদের মধ্যে আছে ছোট মাছরাঙ্গা, শঙ্খচিল, সিন্ধু ঈগল, ফটকা মাছরাঙ্গা, সাদাবুক মাছরাঙ্গা, কোড়াল ইত্যাদি।

নানা দেশ-বিদেশ থেকে আসা পাখিদের মধ্যে গিরিয়া হাঁস, দিগহাঁস, খুন্তেহাঁস, বড়রাঙ্গামুড়ী, ভূতিহাঁস, বামুনিয়া হাঁস, পিংহাঁস, জৌরালী, বড়গুলিন্দা, ছোট গুলিন্দা, লালপাবাটান, চখাচখি, ডোরাশির ও আরও কতরকমের পাখি আছে। তারা সাইবেরিয়া, সুমেরু অঞ্চলগুলি থেকে আসে, আবার কেউ কেউ হিমালয় থেকেও উড়ে আসে।

এই জীববৈচিত্র্যের ভাণ্ডার ছাড়াও জলাভূমির আরও অনেক উপকারিতা আছে সেগুলো আমরা একটু একটু করে জানব।

ঋণ: ১। Ramsar Information Paper No.1 ২। Naturalist, Prakriti Samsad, VOL III 2004