‘দক্ষিন মেরুর ঊর্ধ্বে যে অজ্ঞাত তারা, মহাজনশূন্যতায় রাত্রি তার করিতেছে সারা’—
দক্ষিণ মেরুর ঊর্ধ্বে তারাটি যে অজ্ঞাত— সেটি রবীন্দ্রনাথ জানতেন। রবীন্দ্রনাথ কোনওদিন অ্যান্টার্কটিকা যাননি। এমন হয় নাকি? কবিরা দেখা-না দেখা, জ্ঞাত-অজ্ঞাত— সবই তাঁদের অনুভবের আঙিনায় ধরেন, সাজান কবিতায়। অ্যান্টি আরটিকোস— উত্তর মেরুর বিপরীতে, ধ্রুবতারার বিপরীতে। সেখানের তারাগুলি আলাদা— উত্তরের নাবিকেরা পথ হারাবে। আলফা সেঞ্চুরি, বিটা সেঞ্চুরি, সিগমা অক্টানটিস। সময় আর পাথরের খোঁজই আমাকে এনে ফেলল অ্যান্টার্কটিকায়। যাদবপুরে তখন সুদীপ্তাদির কাছে গবেষণার কাজ করছি। সেটা ১৯৯৬। উনি বললেন— যাবে এবার? যাব? নিশ্চয়ই। ভারতের ১৯তম অভিযান। যাবই। মহাদেশ যেতে গিয়ে মহাসমুদ্রের সঙ্গে পরিচয়— সেও আমার সেবারেই প্রথম। কী বিরাট এই ভারত মহাসাগর! আর এত ভূতত্ত্ব পড়ে আমি তো সমুদ্রের বিষয়ে কিছুই জানি না দেখলাম! কিছুই শিখিনি। আর এটারও বয়স তেমন বেশি না— ১৮-২০ কোটি। আগে ছিল একটা টেথিস সাগর। ভারত, অ্যান্টার্কটিকা, আফ্রিকা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে যে মহাদেশ গন্ডোয়ানাল্যান্ড, তার চারিদিক জুড়ে। তখন মানুষ আসেনি। চারিদিকে ডাইনোসররা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। শেষে অ্যান্টার্কটিকা আলাদা হয়ে চলে গেল দক্ষিণ মেরুতে। ভারত একা একা চলল উত্তরের দিকে। যেতে যেতে একদিন তিব্বতের সঙ্গে ধাক্কা। সেও প্রায় চার কোটি বছর আগে। মধ্যের টেথিস সমুদ্রের পলি উঁচু হয়ে ভাঁজ খেয়ে তৈরি হতে লাগল হিমালয় পর্বত। আশ্চর্য! ছিল সাগর হয়ে গেল পর্বত! এ কী খেলা রে ভাই! গন্ডোয়ানা-ভাইবোনদের ঘিরে রইল নতুন ভারত মহাসাগর।
অ্যান্টার্কটিকা যাবার পথেও বাধা-পাঁচিল কি কিছু কম নাকি? বিষুবরেখা পেরিয়ে কিছুদিন গেছি দক্ষিণা পথে। বলা হয় দক্ষিণ সাগর নেপচুনের রাজ্য। সমুদ্র দেবতা নেপচুন। চল্লিশ ডিগ্রি দক্ষিণ অক্ষাংশের কাছে আসতেই, বাপরে, সে কী ঝড় তুফান! রোরিং ফরটিস— গর্জনকারী চল্লিশা। বিশাল বিশাল ঢেউ পাগলের মত উঠছে নামছে। জাহাজ এই ওঠে তো এই পড়ে নিচে। ডেকের ওপর আছড়ে পড়ছে ঢেউ। আমাদের সিয়াচেন ফেরত মিলিটারি বন্ধুরাও আমাদের মতোই গামছা দিয়ে নিজেদের বেঁধে রাখছে জাহাজের বাঙ্কের সঙ্গে। রোলিং আর পিচিং। রান্নাঘরে খিচুড়ি এক দিকে তো কড়াই অন্য দিকে। পাঁচিল শেষ হয় না— রোরিং ফরটিস-এর পর স্রিমিং ফিফটিস। জাহাজ ও আমাদের সম্মিলিত চিৎকার। সাধে কেউ অ্যান্টার্কটিকা আসেনি বেশিদিন আগে, এটাকে জয় করতে! ১৮২০-২১ নাগাদ ব্রিটিশ এবং রাশিয়ান অভিযানের পর সেই ১৯১১, ক্যাপ্টেন স্কট-আমুন্ডসেনদের সময় মানুষ প্রথম দক্ষিণ মেরুতে পা রাখতে পেরেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে ঠান্ডা, সবচেয়ে উঁচু আর সবচেয়ে শুকনো একটা মহাদেশ। আয়তনে অস্ট্রেলিয়ার প্রায় দ্বিগুণ।
৫৫ ডিগ্রি দক্ষিণ অক্ষাংশ পেরনোর পর থেকেই ছোট থেকে বড় নানা ধরনের আইসবার্গের সঙ্গে দেখা হতে থাকে। এগুলিকে আগে থেকে দেখতে পাওয়ার জন্য আমাদের জাহাজে ছিল রাডার— যাতে রেডিও তরঙ্গের সাহায্যে ওদের গতিবিধি বুঝে পাশ কাটিয়ে যাওয়া যেতে পারে। ধাক্কা লাগলেই তো টাইটানিক। তারপর আবার পদ্মপাতার মত প্যাক আইস আর সমুদ্রের জলে বরফের চাদরের মত সী আইস। বরফ না কেটে এগোনো যাবে না। আমাদের জাহাজ বরফ কেটে কেটেই চলল। শেষে বাইশ দিন পর ডাঙা দেখা গেল। কিন্তু নামব কোথায়? এত বিরাট একটা বরফের পাঁচিল! সমুদ্রের থেকে খাড়া ষাট ফুট উঁচু— আইসশেলফ। এর আগে সব জায়গাতেই আমরা জাহাজ থেকে ‘নেমেছি’— গোয়া, মরিশাস বা কেপ টাউনে। এ তো জাহাজ থেকে ‘উঠতে’ হবে! মনে পড়ল এখানে আসার আগে আউলিতে বাচেন্দ্রী পাল আর ITBP-এর কাছে ১ মাস ট্রেনিংয়ের কথা। আর ঘাম হতে লাগল সেই এক ডিগ্রি ঠান্ডায়। আর ঠিক সেই সময় আমাদের অভিযানের অধিনায়ক জাহাজের খোল থেকে বার করে আনল দুটো হেলিকপ্টার! আমরা ৬০ জন ভাগে ভাগে ‘উঠে’ পড়লাম অ্যান্টার্কটিকার বিখ্যাত মহাদেশীয় হিমবাহের ওপরে— তারপর যাত্রা শুরু হল আমাদের নতুন স্টেশন ‘মৈত্রীর’ উদ্দেশে। ততদিনে ভারতের প্রথম ক্যাম্প ‘দক্ষিণ গঙ্গোত্রী’ বরফে তলিয়ে গেছে। উড়ে যেতে যেতে দেখলাম এই নতুন দেশে কোনও সবুজ নেই, শুধু সাদা আর কঠিন পাথরের খয়েরি রঙ। একটু দমে গেল মনটা। প্রাণ আছে তো?
কিছুদিন লেক প্রিয়দর্শিনীর ধারে মৈত্রী-তে কাটিয়ে আমি আর শান্তনু বেরিয়ে পড়লাম আমাদের নিজস্ব অনুসন্ধানে। দু-তিনটে তাঁবু, প্রচুর শুকনো খাবার, রান্নার গ্যাস, জেনারেটর আর রেডিও সেট সুদ্ধ আমাদের হেলিকপ্টার আমাদের ছেড়ে দিয়ে এল হিমবাহের গায়ে একটা পাথুরে ডাঙায়। ক্যাম্প তৈরি করার পর খেয়ে দেয়ে স্লীপিং ব্যাগে ঢুকে ঘুম। পরের দিন থেকে ম্যাপিংয়ের কাজ শুরু করব— ভূ-বিকৃতির মানচিত্র। কিন্তু ঘুমোব যে, রাত হয়নি তো! রাত কই? তখন ডিসেম্বর মাসের শেষ— অ্যান্টার্কটিকার গরম কাল। দিন আর দিন— সূর্যটা আকাশের এধার থেকে ওধারে ঘোরে, খানিক ওঠা নামা করলেও অস্ত যায় না। সে এক বিড়ম্বনা! অগত্যা তাঁবুর মধ্যে চোখ ঢেকে ঘুম। বাইরে রাত না থাকলেও নিজের মধ্যে দিন রাত হওয়া ঠেকায় কে! তবে যারা শীতকাল কাটায় এখানে, তাদের খুব দুর্দশা। একে ৬ মাস রাত্রি, আর মাইনাস ৮০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড ঠান্ডা। কিছু আলাদা ভাবার সুযোগ নেই। শুধু বেঁচে থাকবার লড়াই। তবে ওদের জন্য অরোরা থাকবে— ভূ-চুম্বকের আকাশে এক বর্ণময় আলোর খেলা— অরোরা অস্ট্রালিস। আমাদের দেখা হবে না এবারে!
চলতে লাগল কাজ— দিনে ১০-১৫ কিলোমিটার হাঁটা, পাথর আর তাদের বাঁক ও মোড়ের ম্যাপ বানানো, ছবি তোলা, নমুনা নেওয়া। একটা দুটো তিনটে ভাঁজ এই পাথরে? এই সব ২০০ কোটি বছরের পুরনো পাথরে? চার্ণকাইট— তাতে নীল কোয়ার্টজ, খন্ডালাইট— তাতে লাল রুবি, সাদা আনর্থসাইট, কালো আলট্রাম্যাফিক! অনেকটা আমাদের পূর্বঘাট পাহাড়ের মতো। জোড়া ছিল নাকি কোনওদিন? সে আরেক সন্ধান। ক্যাম্পে ফিরে নানা ধরনের পরীক্ষামূলক খাবার বানানো— যেমন ঢ্যাঁড়শ দিয়ে চিংড়ি, কফি দিয়ে ভাত। তবে অধিকাংশ দিনেই মাংস, পরোটা দিয়ে। বেশিরভাগই আগে থেকে রান্না করে জমিয়ে রাখা। মিলিটারি রেশন। আমাদের ফ্রিজ ছিল না। বরফের ভিতরে গর্ত খুঁড়ে আমরা খাবার দাবার, মাখন, আইসক্রিম জমিয়ে রাখতাম। একদিন ক্যাম্পে ফিরে দেখি বরফের ওপর গোলাপি রঙের চিত্রবন্যা। চতুর্দিকে রঙের টিউবের মত আইস্ক্রিমের আস্তরণ ছড়ানো। আর সেটা ঘিরে ৫-৬টা স্কুয়া পাখির উল্লাস নৃত্য। স্কুয়া অ্যান্টার্কটিকার ঈগল। মাংসাশী। সীল বা পেঙ্গুইন ধরে খায়। তাদের এমন আইস্ক্রিমপ্রীতি কে-ই বা ভেবেছিল! ওখানে এর আগে কোনও ভয় ছিল না আমাদের। কোনও জন্তু নেই সেদেশে— না তুষারচিতা, না মেরু ভল্লুক। ডাইনোসর সরীসৃপকূলের পর বড় স্তন্যপায়ীদের বিবর্তনটাই হয়নি এখানে। কিন্তু সেদিন ঘুমোতে যেতে একটু ভয় ভয় করছিল। দু-একটা দুঃস্বপ্নও দেখেছিলাম মনে হয়, চারপাশে আমাদের লাল রঙের তাঁবুর টুকরো ছড়িয়ে আছে আর কয়েকটা স্কুয়া মাখন লাগিয়ে কী একটা খাচ্ছে!
অ্যান্টার্কটিকায় এই বরফ-পাথরের মরুভূমিতে গুপ্তধন কিছু কম নেই— হিরে, সোনা, চুনী, পান্না, কয়লা, পেট্রোল, ইউরেনিয়াম— কী নেই! মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েনি কেন যুদ্ধ করে দখল নিতে? দক্ষিণ মেরুর দখলদার? পারেনি, কেননা সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা এক হয়ে বলেছিল এই একটা দেশ থাক শান্তির জন্য, বিজ্ঞানের জন্য। ১৯৯১-এর অ্যান্টার্কটিকা চুক্তি— বা মাদ্রিদ প্রোটোকল— কেউ এটাকে লুঠপাট করে বসতি গড়তে পারবে না। তার আগেই জানা হয়ে গিয়েছে অ্যান্টার্কটিকার ওপরে ওজোনের স্তর ক্রমশ হালকা (ফুটো) হয়ে যাচ্ছে— এই যন্ত্র-সভ্যতার বেপরোয়া সিএফসি ব্যবহারে। মহাজাগতিক ক্ষতিকর ঊভি-বি রশ্মী এই ফুটো দিয়ে পৃথিবীতে প’ড়ে পৃথিবীর সমস্ত জীব জগত ধ্বংস করে দেবে। ১৯৮৭ সালেই বিজ্ঞানীরা সারা পৃথিবীতে সিএফসি ব্যাবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন— মন্ট্রিল প্রোটোকলের মধ্যে দিয়ে সব ক’টি দেশ তাতে সম্মতি দিয়েছে। বন্ধ হয়েছে গাড়ি, ফ্রিজ, এয়ারকন্ডিশনারে হ্যালন আর সিএফসির ব্যবহার। আর ২০১৫-র মধ্যেই— কী আশ্চর্য— ওজোন স্তরের এই ক্ষত অনেকটা সেরে গেছে— মানুষ পেরেছে, মানুষ পারে তাহলে! সবাই মিলে যদি চায়!
একদিন একটা পথভোলা পেঙ্গুইন এসে হাজির আমাদের ক্যাম্পের কাছে। কোনও তুষার ঝড়ে পথ হারিয়ে সমুদ্রের দিকে যাবার বদলে পৌঁছেছে উল্টোদিকে দেশের ভিতরে। হেঁটে, না খেয়ে খেয়ে রোগা হয়ে গেছে বেচারা। কী খেতে দিই, কীভাবে বাঁচাই? দুধ দিই, খায় না, জল দিই, খায় না, চিংড়ি দিই, তাও খায় না! রেডিওতে যোগাযোগ করলাম মৈত্রীর সঙ্গে— আরে এরা কী খায়? বলল— ওরা নাকি ছোট্ট ক্রিল (চিংড়ির মত), মাছ, স্কুইড-ছানা এসব খায়— কিন্তু সবই ভাসমান অবস্থায়, সাস্পেন্সন-ফিডার। তুমি ওকে কিছুই খাওয়াতে পারবে না। তাহলে তোমরা হেলিকপ্টার নিয়ে এসে একে সমুদ্রে ছেড়ে এসো প্লিজ— ও এখানে বাঁচবে না! মৈত্রী জানাল এর মধ্যে আমার কিছু করার নেই। পেঙ্গুইন যেমন ক্রিল খেয়ে বাঁচে, স্কুয়া তেমন পেঙ্গুইন খেয়ে বাঁচে। এটা একটা খাদ্য শৃঙ্খলা— মানুষ সেখানে নাক গলালে ক্ষতিই করবে শুধু। উপলব্ধির সঙ্গে সঙ্গে একটা দীর্ঘ বিষণ্ণতা ক্রমশ ঘিরে ধরতে লাগল।
আজ প্রায় কুড়ি বছর পরে যখন দেখি পৃথিবীটা ক্রমশ আরও গরম হয়ে যাচ্ছে বলে অ্যান্টার্কটিকার আইসশেলফের অংশ গলে গলে যাচ্ছে, বড় বড় টুকরো হিমশৈল হিসেবে সমুদ্রে ভেঙে পড়ছে, ভেঙে পড়ছে পেঙ্গুইনদের ডিম পাড়ার রুকারি, বেড়ে যাচ্ছে সমুদ্রের জলতল— তখন ভাবি আরও বড় কোনও ক্ষতি কি আমরা করে ফেলেছি পৃথিবীর? কেমন করে এই ক্ষত নিরাময় করব আমরা?
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝির থেকেই আবহাওয়া খারাপ হতে লাগল— বরফ পড়া শুরু হল তার সঙ্গে ঝড় ঝাপটা। জলের হ্রদগুলি বরফে বুজে যেতে লাগল। এবার ফিরতে হবে। দেরি হলে সমুদ্রর জল জমে যেতে শুরু করবে। আমাদের জাহাজ আর বেরতে পারবে না। যেমন হয়েছিল শ্যাকল্টনের অভিযানে। তারপর এক অসামান্য উদ্ধারের অপেক্ষায় গোটা একটা বছর।
কিন্তু সেটা তো অন্য গল্প।