মিশরের রাজাদের বলা হত ফ্যারাও। একদিন ফ্যারাও খুফু তার ছেলেদের নিয়ে রাজপ্রাসাদের বারান্দায় বসে গল্প করছিলেন। দ্বিতীয় রাজকুমার হোরদাদেফ কথায় কথায় তাঁকে বলল, ‘মহারাজ, আপনি তো সেদিন এক জাদুকরের অদ্ভুত ঐন্দ্রজালিক ব্যাপার দেখেছিলেন, কিন্তু আমি তার চাইতেও এক ক্ষমতাশালী জাদুকরের খোঁজ জানি— যিনি মানুষের মাথা কেটে ফেলে আবার তাকে জোড়া লাগাতে পারেন। আর শুধু তাই নয়, তিনি ভগবান জোথের বাসস্থান কোথায়, তাও জানেন। আপনি যদি সত্যি তা জানতে পারেন তাহলে তাঁর কাছ থেকে পিরামিডের জন্যে নক্সা পাওয়াও খুব শক্ত হবে না।’
রাজা খুফু খুব খুশি হয়ে বললেন, ‘বেশ তাঁকে আমার কাছে নিয়ে এসো।’ পিতার অনুমতি পেয়ে হোরদাদেফ সেই বিখ্যাত ঐন্দ্রজালিকের খোঁজে নীল-নদের বুকে নৌকা ভাসিয়ে দিলেন। মিশরের এই বিখ্যাত ঐন্দ্রজালিকের নাম দেদী। একশ দশ বছর তার বয়স। কিন্তু বুড়ো-থুত্থুরে হলে হবে কী! ঐ বয়সেও সে একটা ষাঁড়ের অনেকটা একাই খেয়ে ফেলতে পারে— আর শুধু তাই নয়— তার সঙ্গে চাই পাঁচশ রুটি আর একশ গেলাস মদ। এমনই তার খাওয়ার ঘটা।
রাজকুমারের নৌকা গিয়ে যেখানে জাদুকরের বাস, সেই দেদসেফ্র শহরে নোঙর করল। রাজপুত্র যখন গিয়ে তার দোরগোড়ায় পৌঁছল, জাদুকর তখন দরজার কাছে শুয়ে খুব ঘুমচ্ছিল। ঘুম ভাঙতে রাজকুমারকে দেখে উঠতে যাবে এমন সময় সে বললে, ‘মিশরের ফ্যারাও আপনাকে উপযুক্ত সম্মানে অভ্যর্থনা করবেন; আমি সেইজন্যই আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।’ জাদুকর খুশি হয়ে তাকে খুব আশীর্বাদ করে বলল, ‘তোমার পিতার আত্মার স্বর্গবাস হোক।’
জাদুকরকে নিয়ে দেশে ফিরে এসে রাজকুমার পিতাকে তার সংবাদ দিতেই তিনি সুখী হয়ে বললেন, ‘তুমি এক্ষুণি তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো।’
রাজাকে অভিবাদন করে বুড়ো জাদুকর তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল। রাজা বললেন, ‘কই এর আগে তো তোমাকে আর কখনও দেখিনি?’
জাদুকর বললে, ‘আপনি খবর পাঠিয়েছেন— আর আমিও এসে হাজির হয়েছি।’
রাজা বললেন, ‘তুমি নাকি মানুষের মাথা কেটে ফেলে আবার জোড়া লাগাতে পারো, সত্যি?’
জাদুকর মাথা নুইয়ে বললে, ‘সত্যি মহারাজ।’
রাজা তক্ষুণি এক বন্দীকে সেইখানে আনতে আদেশ দিলেন। জাদুকর বলল,’বিনা প্রয়োজনে কেন মিছামিছি মানুষকে নিয়ে টানাটানি, মহারাজ?’
রাজা তখন একটি হাঁস আনতে বললেন। হাঁসটাকে কেটে একদিকে ফেলে রাখা হল। কিন্তু কী আশ্চর্য? কিছু মন্ত্র উচ্চারণ করতেই দুটো আলাদা জিনিস বেমালুম জুড়ে গেল— আর হাঁসটা ঘরের ভেতরে প্যাঁক প্যাঁক করে ঘুরে বেড়াতে লাগল।
এইবার নিয়ে আসা হল প্রকাণ্ড এক রাজহাঁস। এর বেলাতেও ঠিক তেমনি! অবাক কাণ্ড!
তারপর এল এক গরু। তার মাথা কাটা হল। জাদুকরের মন্ত্রে গরু যে শুধু বেঁচে উঠল তা নয়, একেবারে তার পেছনে পেছনে চলল।
রাজা খুশি হয়ে বললেন, ‘শুনতে পাই তুমি ভগবান জোথের বাসস্থানেরও সন্ধান রাখো, তাও কি সত্যি?’ দেদী বলল, ‘সে নক্সা অবশ্য আমার কাছে নেই, কিন্তু তা কোথায় লুকোনো আছে সে সন্ধান আমি জানি। হেলিওপোলিসের এক মন্দিরের কোনে, বিশেষ কক্ষে সেগুলো গুপ্ত আছে। একটা বাক্সের ভেতর সমস্ত নক্সাগুলো রেখে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সাধারণ লোকের ক্ষমতা নেই যে গিয়ে তা নিয়ে আসতে পারে।’
রাজা খুফু জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, সে নক্সা কে আনতে পারে, বলো তো?’
জাদুকর জবাব দিল, ‘রা নগরের প্রধান পুরোহিতের স্ত্রী রূদ দেদিৎ-এর গর্ভে তিনটি ছেলে জন্মাবে। এদের মধ্যে বড় ছেলেই হবে হেলিওপোলিসের প্রধান পুরোহিত আর সে-ই এই নক্সাগুলো পাবে। আর শুনুন মহারাজ! সে-ই তার ভাইদের নিয়ে এই বিশাল মিশর দেশ শাসন করবে।’
জাদুকরের এই ভবিষ্যদ্বাণী শুনে রাজার মুখখানা একেবারে মেঘে-ঢাকা আকাশের মতো থমথমে হয়ে উঠল। রাজাকে চুপ করে থাকতে দেখে জাদুকর আবার বলল, ‘কী ভাবছেন মহারাজ? আপনার পর আপনার ছেলেই রাজা হবে। তারপর রাজা হবে আপনার নাতি। আর সে নাতির পরেই প্রধান পুরোহিতের তিন ছেলের একজন এই রাজ্যের ভারগ্রহণ করবে।’
রাজা খানিকটা চুপ করে থেকে বললেন, ‘আচ্ছা, এই ছেলেরা কখন জন্মাবে তা তুমি বলতে পার?’
জাদুকর সময়টা বলে দিলে রাজা বললেন, ‘আমি ঠিক সেই সময় সেই মন্দিরে থাকব।’
তারপর রাজা জাদুকরকে যথাযোগ্য সম্মান দেখিয়ে তার প্রচুর খাদ্যের ব্যবস্থা করে দিলেন। জাদুকর সেদিন দ্বিগুণ খাবার খেয়ে ফেলল। আস্তে আস্তে পুরোহিত-পত্নীর সন্তান জন্মগ্রহণ করবার দিন এগিয়ে এল। প্রধান পুরোহিত আর তাঁর স্ত্রী এক সঙ্গে বসে দেবী আইসিস, তাঁর বোন নেপসিস এবং জন্ম দেবতা মেস্থেষ্ট আর ব্যাঙের দেবতা হেট, সৃষ্টিকর্তা খুমুর কাছে প্রার্থনা করলেন। তাঁরা স্বামী-স্ত্রীতে প্রার্থনা করলেন— ওগো দেবতারা, তোমরা আমাদের ছেলে তিনটিকে দেখো। এরাই ভবিষ্যতে সমস্ত মিশর দেশের রাজা হবে। দেবতারা তাঁদের প্রার্থনা শুনে খুব খুশি হলেন এবং নর্তকীর বেশে পৃথিবীতে নেমে এলেন। আর তাঁদের সঙ্গে পেছনে পেছনে এলেন সৃষ্টি-দেবতা খুমু সকলের জিনিসপত্র নিয়ে।
প্রধান পুরোহিতের গৃহদ্বারের সম্মুখে এসে তাঁরা সকলে মিলে নৃত্যের এক তরঙ্গ তুললেন। পুরোহিত এসে তাঁদের গৃহে প্রবেশ করতে অনুরোধ করলেন। দেবতারা সকলে মিলে চুপি চুপি পুরোহিত-পত্নীর ঘরে লুকিয়ে রইলেন। প্রথম ছেলে জন্মালে দেবী আইসিস তার নাম দিলেন উসারকফ, দেবী মেস্থেষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী করলেন— এই হবে মিশরের সম্রাট। সৃষ্টি-দেবতা বর দিলেন, তুমি বীর হবে।
দ্বিতীয় পুত্রের নাম হল সাহুরা। দেবতারাও আগের মতো তাকেও বর দিলেন। তৃতীয় পুত্রের বেলাতেও তাই। নাম হল–কাকা। তারপর দেবতারা বিদায় নিয়ে ফিরে চললেন। পুরোহিত তাঁদের এক বস্তা যব উপঢৌকন দিলে সৃষ্টি-দেবতা খুমু তা কাঁধে তুলে নিলেন। ফেরার সময় দেবী আইসিস বললেন, ‘দেখ, একটা অলৌকিক কাণ্ড কিছু করা যাক, তাহলে পুরোহিত বুঝতে পারবে সত্যি সত্যি আমরা কে আর কেনই বা এসেছিলাম।’ তাঁরা করলেন কী, চুপি চুপি যবের বস্তার ভেতরে একটা রাজমুকুট লুকিয়ে রাখলেন। তারপর ভীষণ ঝড়ের সৃষ্টি করে পুরোহিতের বাড়ি ফিরে গিয়ে বললেন, ‘আজকের এই দুর্যোগে বস্তাটা আপনার এখানেই রেখে যাই— দিন পনেরো পরে এসে আবার নিয়ে যাব।’
পুরোহিত বস্তা তাঁর ভাণ্ডারে তুলে রাখলেন। এর দিন কয়েক বাদে পুরোহিত-পত্নী তার দাসীকে ডেকে বললে, ‘যা তো ভাণ্ডার থেকে যব বের করে নিয়ে আয়, মদ তৈরি করতে হবে।’
দাসী ফিরে এসে বললে, ‘সেই না নর্তকীদের বস্তা ছাড়া আর তো যব নেই মা!’ পুরোহিত-পত্নী বললে, ‘আচ্ছা, তাই নিয়ে আয়।’ দাসী যখন গিয়ে আবার ঘরে ঢুকল—হঠাৎ কোত্থেকে নাচ-গানের শব্দ তার কানে ভেসে এল। সে অবাক হয়ে ছুটে গিয়ে তার প্রভু-পত্নীকে খবর দিল। পুরোহিত-পত্নী প্রথমটা ধরতে পারলে না কোত্থেকে গান বেরোচ্ছে, তারপর যবের থলেতে কান রাখতেই সব জানা গেল। সে তাড়াতাড়ি থলেটা একটা সিন্দুকে ভর্তি করে স্বামীকে খবর দিল। তারপর দুজনের আনন্দ দেখে কে!
দাসীটা একদিন পুরোহিতের স্ত্রীর খুব বকুনি খেয়ে এদের ছেলে যে রাজা হবে সেকথা বলবার জন্য সে তার মামাবাড়ি চলে গেল এবং তার মামাকে সব কথা খুলে বলল। কিন্তু তার মামা এই সব কথা শুনে তার ওপর ভয়ানক চটে গিয়ে তাকে নদীতে জল আনতে পাঠিয়ে দিল। নদীতে ছিল কুমির— মেয়েটাকে নিয়ে সে ভুস্ করে ডুবে যে কোথায় তলিয়ে গেল!
দাসীটার মামা তখন পুরোহিতের বাড়ি গিয়ে দেখে, পুরোহিত-পত্নী বসে বসে কাঁদছে। সে বললে, ‘ঠাকরুণ, আপনি কাঁদছেন কেন?’
পুরোহিত-পত্নী বলল, ‘আমার ছেলে রাজা হবে, আমার দাসী সেই খবর রাজাকে বলে দিতে গেছে।’
লোকটা বলল, ‘ঠাকরুণ, আপনি দুঃখ করবেন না। আমায় গিয়ে সব কথা বলেই সে গেল নদীতে জল আনতে, সেখানে তাকে কুমিরে ধরে নিয়ে গেছে।’
কাজেই রাজা খুফু পুরোহিতের ছেলেদের জন্মের খবর আর পেলেন না। জাদুকরের ভবিষ্যদ্বাণী সার্থক হল। কালক্রমে তারাই হল মিশরের একচ্ছত্র সম্রাট।
[এই গল্পটির বয়স প্রায় সাত হাজার বৎসর।]ঋণ: শিশুভারতী