Categories
গল্পগ্রাম |

জ্ঞানতীর্থ

342 |
Share
| ১৯ জানুয়ারী, ২০২২
বীরেন্দ্রকুমার গুপ্ত


নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। একজন অভ্যাগত এসেছেন।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম হল দ্বারপাল অভ্যাগতকে প্রশ্ন করেন, অভ্যাগতর উত্তরে সন্তুষ্ট হলে তারপর তাকে ভিতরে প্রবেশের অধিকার দেন।
প্রধান দ্বারপাল বীটপালের নিকট সংবাদ গেল যে নতুন একজন অভ্যাগত সমাগত।
অভ্যাগতকে ঠিক যুবকও বলা যায় না— প্রৌঢ়ও বলা যায়না। দীর্ঘ গৌরকান্তি, মুণ্ডিত মস্তক, হাতে কমণ্ডলু, পরিধানে গৈরিক, মুখে মৃদু হাসি।
দ্বারপাল প্রশ্ন করেন, ‘আপনি এ প্রতিষ্ঠানে প্রবেশের অধিকার চান?’
মৃদু উত্তর আসে, ‘হাঁ।’
পুনরায় দ্বারপাল প্রশ্ন করেন, ‘তা’হলে আপনি নিশ্চয়ই এ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের নিয়মও জানেন। প্রশ্নের উত্তর পেলে তবে প্রবেশের অধিকার জন্মে। তার পূর্ব্বে আমাদের জানার আছে— আপনার এখন বিশ্রামের প্রয়োজন নেই তো? আপনি ক্লান্ত নন তো?’
‘না, আমি কাল রাত্রে এখানে পৌঁছেছি। আপনাদের বহির্ভাগের এ অতিথিশালায় বিশ্রাম, আহার, পানীয় সবই পেয়েছি। এখন একবার প্রবেশের অধিকারটুকু পেলেই হয়। আপনি প্রশ্ন করুন’।
‘বেশ বলুন, অন্নের শক্তি কি?’
‘অন্ন মনের শক্তি দেয়— মন অন্নময়’।
‘দ্রুতগতি সবসময় ভাল না কার কার?’
‘প্রথমত, রাজার। এদিক ওদিক ছুটাছুটি করলে লোকে তাঁকে সাধারণ লোক ভাববে। দ্বিতীয়ত, রাজার হাতির। তার ধীর গমনেই রাজার সম্মান। তৃতীয়ত নারীর। ধীর চলাতেই তার সম্মান ও সৌন্দর্য’।
‘বেশ, এবার আর একটি প্রশ্ন— জীবনকে কী দিয়ে গাঁথা উচিত?’
‘পুণ্যকর্ম্মের ফুল দিয়ে’।
‘বেশ তুমি পেলে এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের অধিকার। মনে রেখো যুগ যুগ ধরে এর পবিত্রতা রক্ষা করে চলবে— এর খ্যাতি অক্ষুণ্ণ রাখবে। তোমার জ্ঞানের দীপ্তি যেন এর দীপ্তিকে উজ্জ্বলতর করে’।

অভ্যাগত তবুও প্রবেশ করেন না। তিনি দ্বারপালের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাস্যের সঙ্গে বলেন, ‘প্রবীণের দল কি এমনি করেই অতীতকে ভুলে যায়! আমাদের জন্য অতীতের কি একটু স্নেহরশ্মিও পড়ে না?’
দ্বারপাল অবাক। এ মধুর হাসি, এ উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টি, এ উন্নত নাসিকা সর্ব্বোপরি— ঐ কমণ্ডলু যে বড় চেনা। বহুদিন এদের সঙ্গে পরিচয়। এ কে? সুগত? তাই তো সুগত কি ফিরে এল! তবে যে শুনেছিলাম— অস্ফুটে উচ্চারণ করেন, ‘সুগত!’
‘হাঁ সুগতই। তবু ভাগ্য যে এতক্ষণে অভাগার কথা মনে পড়েছে!’
উভয়ে পরস্পরের আলিঙ্গনে আবদ্ধ হন। সুগত বলেন, ‘সমগ্র ভারতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিক্রমা প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। হঠাৎ কাল মহা আচার্যদেবের আদেশ বাণী পেয়েছি— দ্রুত প্রত্যাবর্তনের আমন্ত্রণ’।
সৌম্য সুগত প্রবেশ করেন।
অদূরেই আচার্যদেবের প্রকোষ্ঠ।
আচার্য্যদেব বৃদ্ধ— কার জন্য গভীর আগ্রহে অতি প্রত্যূষ থেকেই প্রতীক্ষার দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে রয়েছেন।
সৌম্য সুগত গিয়ে তাঁকে প্রণাম করেন।
আচার্যদেব তাঁর মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেন, প্রশ্ন করেন, ‘কাল এসেছ?’
‘হাঁ’।
‘কাল সংযম পালন করেছিলে আমার চিঠির নির্দেশমত?’
‘হাঁ’।
‘তোমার প্রাতঃকৃত্য হয়ে গেছে?’
‘ব্রাহ্মমুহূর্তেই উঠেছি’।
‘মনে রেখো আজ তোমাকে উপবাস করতে হবে। আজ অমাবস্যায় প্রতিপদ আসবে; প্রতিপদের সূচনায় তোমাকে আমি আমার যা বক্তব্য বলব’।
‘আচার্যদেবের যেমন আদেশ’।
‘ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিভ্রমণ শেষ হয়েছে কি?’
‘প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল— মদ্র অঞ্চলে সবে প্রবেশ করেছিলাম, এমন সময় আপনার আদেশ পেলাম। ফিরে এলাম’।
‘ভালোই করেছ। মদ্র অঞ্চল গতানুগতিক পথে চলে— নবজ্ঞানধারা দেয় না’।

সুষুপ্ত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়।
চারদিকে গভীর নিস্তব্ধতা— কোথাও প্রদীপ-রেখা প্রতিভাত হচ্ছে না।
একমাত্র মহাআচার্যদেবের গৃহে আলো দেখা যাচ্ছে।
আচার্যদেব আসনে বসা।
তাঁর সামনেই আবার একটি আসনে বসা সৌম্য সুগত।
আচার্যদেব বলেন, ‘সুগত, এ রাত্রির শুভমুহুর্ত এখন উপস্থিত। তোমায় এখন সব বলছি। জরা আমাকে ক্রমশ গ্রাস করছে। আমার মনে হয় আমি আর বেশিদিন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করতে পারব না। তোমার প্রবেশের দিন থেকে এ দীর্ঘ পঁচিশ বছর তোমাকে আমি লক্ষ্য করে এসেছি। কিশোর বালক তুমি যেদিন এসেছিলে সেদিনটির কথা এখনও আমার বেশ স্পষ্ট মনে পড়ে। একটু একটু করে তোমার জ্ঞান পুষ্ট করার প্রয়াস পেয়েছি। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বাদশবর্ষ অধ্যয়ন সমাপ্ত হলে তোমার বাবা যেদিন তোমাকে ফিরিয়ে নিতে এসেছিলেন, সেদিন আমি তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম, বলেছিলাম, “সুগতকে আমাদের দান করুন, বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করুন”। তিনি ক্ষুণ্ণ হয়ে বলেছিলেন, “আমার প্রথম পুত্র— ওর উপর আমার যে অনেক ভরসা”। আমি বলেছিলাম, “আমারও যে সর্ব্বোশ্রেষ্ঠ ছাত্র— ওর উপর আমার নয়, সমগ্র ভারতের, সমগ্র ধরিত্রীর অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা”।’
সুগত নতমস্তকে উত্তর দেয়, ‘হাঁ আমার সব মনে আছে। আমারও ফিরে যাওয়ার তেমন আগ্রহ ছিল না’।
‘ঠিক বলেছ। উপযুক্ত শিষ্যের মতই তো কথা বলেছ। জ্ঞান মহাদ্রব্য— জ্ঞানপ্রাপ্তি মহাপ্রাপ্তি। আমি লক্ষ্য করেছি তুমি কীভাবে একান্ত সাধকের মতো সে পথে অগ্রসর হয়েছ। আমি দেখেছি— অন্য সকলে যখন রাত্রির গভীরতায় সুখনিদ্রায় মগ্ন, তুমি তখন একান্তমনে মীমাংসা করেছ জটিল সমস্যার ভূর্জপত্রে। আমি লক্ষ্য করেছি— কঠোর সংযম, কঠোর ব্রহ্মচর্য্য, কঠোর জীবন যাপনের মধ্যে তুমি নিজেকে গড়ে তুলেছ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকলে যখন সমাজ-উৎসবে যোগ দেবার জন্যে রাজগৃহে চলে গেছে, তুমি তখনও একান্ত মনে প্রকৃতির মধ্যে নিজেকে মগ্ন রেখে দেখেছ প্রকৃতির সৌন্দর্য, আহরণ করেছ প্রকৃতিদত্ত জ্ঞান’।
‘আমি ধন্য যে গুরুদেবকে সন্তুষ্ট করেছি আমার সাধনায়’।
‘তুমি ঠিক বলেছ। সাধনা না হলে সিদ্ধি আসে না। জ্ঞানের সাধনা শ্রেষ্ঠ সাধনা। সাধককে জ্ঞানার্জন মানসে সর্বরিক্ত রেখে চেষ্টা করতে হয়। অসংযম, বিলাস, চিত্তচাঞ্চল্য জ্ঞানের অন্তরায়। তাবে এবার প্রস্তুত হও, সুগত। আমার জ্ঞানভাণ্ডার আজ তোমাকে সর্বস্ব অর্পণ করে যাচ্ছি। তুমি সমস্ত দিন উপবাস করে আছ— তোমার দেহ ও মন পবিত্রময়— এই তো জ্ঞান-প্রদীপ জ্বালার উপযুক্ত সুযোগ। অমাবস্যার অন্ধকার চলে যাচ্ছে— প্রতিপদের আলোর রেখা ভেসে আসছে— প্রস্তুত হও সুগত, প্রস্তুত হও’।
ধীরে ধীরে সুগত যেন আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। আচার্যদেব বলেন, ‘শোনো সুগত, আমার গুরুদেবও আমাকে এমনি ভাবেই সমস্ত ভার দিয়েছিলেন একদিন প্রতিপদের সূচনায়। সেদিন তিনি আমাকে বলেছিলেন, “তুমি যখন বুঝবে বার্ধক্যের ভারে অবনত, তখন তুমিও দিয়ে যাবে এ ভার উপযুক্ত পাত্র”। আমিও আজ তাই মুক্ত হতে চাচ্ছি— তোমাকেও সেই মুক্তির পথ বলে দিচ্ছি। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবে জ্ঞান আহরণ করতে সমগ্র পৃথিবী থেকে— সকলের উপর যেন তোমার থাকে সমদৃষ্টি। আশীর্বাদ করি, আশীর্বাদ করি— এই তোমাকে স্পর্শ করছি। গ্রহণ কর, সুগত গ্রহণ কর! তোমার হাতে যে প্রদীপ দিয়ে গেলাম এর আলো জ্বালিয়ে রাখবে— একে অবিকম্পিত রাখবে— গ্রহণ কর, গ্রহণ কর সুগত— না, না, তুমি আর সুগত নও, তুমি এখন হতে হলে— শীলভদ্র, নালন্দার নব-আচার্য্য’।
সুগত ধ্যানমগ্ন। মহাকাল কি তার সাক্ষী নয়?

শীলভদ্র: মহাস্থবির শীলভদ্র ৫২৯ খ্রিস্টাব্দে সমতট রাজ্যভুক্ত বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্গত কুমিল্লা জেলার চান্দিনার কৈলাইন গ্রামে এক ব্রাহ্মণ রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। হিউয়েন সাঙের মতে, তিনি যে ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তা ছিল সমতটের ভদ্র রাজবংশ। বাল্যকাল থেকেই তিনি অধ্যয়নপ্রিয় ছিলেন। জ্ঞান-অন্বেষণে ধর্মীয় গুরুর সন্ধানে তিনি তৎকালীন ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্য ও স্থান পরিভ্রমণ করেন। একসময় তিনি মগধের নালন্দা মহাবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমন করেন। এখানে তিনি মহাবিহারের অধ্যক্ষ আচার্য ধর্মপালের অধীনে শিক্ষালাভ করেন। তার কাছেই তিনি বৌদ্ধধর্মের সাথে পরিচিতি লাভ করেন। এভাবে তিনি বৌদ্ধধর্মের শাস্ত্রীয় বিষয়ে অনেক জ্ঞান লাভ করেন। মৃত্যু আনুমানিক ৬৫৪ খ্রিস্টাব্দ। [কৃতজ্ঞতা: বার্ষিক শিশুসাথী, ১৯৫৮]