Categories
গল্পগ্রাম |

ঝড়ের পূর্বাভাস

959 |
Share
| ২ জুন, ২০২১
শ্রমণা বসু

অলংকরণ: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

সকাল থেকে খবরের চ্যানেল চালিয়ে রেখেছে বাবা। ঋজু এই ঘর থেকে পড়তে পড়তেও শুনতে পাচ্ছে টুকরো টুকরো খবর। বিখ্যাত সাংবাদিক একটার পর একটা নিত্যনতুন তথ্য দিয়ে চলেছেন আসন্ন ঝড় ‘খুশবু’ নিয়ে। ঘন্টায় নাকি ১৬৫-১৭০ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে আসছে এই ঝড়। পশ্চিমবঙ্গ সহ ওড়িশাতেও নাকি তীব্র ক্ষয়-ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। সুন্দরবনসহ নানা উপকূলবর্তী এলাকাগুলোতে মানুষজনদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঋজু পড়তে পড়তে বাইরে তাকিয়ে দেখছে ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। আজ মাঝরাত থেকে নাকি ঝড়ের দাপট শুরু হবে। বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে ঋজু নানা বিষয়ে ভাবতে লাগল।

ঋজু ক্লাস ফাইভে পড়ে। বাবা-মা আর কাকাইয়ের সঙ্গে উত্তর কলকাতায় একটি বাগানঘেরা সুন্দর একতলা বাড়িতে থাকে। ওর খুব শখ ছিল একটা কুকুর পোষার, ঠিক যেমন পাশের বাড়ির পিকুদের আছে—সাইবেরিয়ান হাস্কি, নাম জ্যাক। কী যে মায়ায় ভরা জ্যাকের চোখ দুটো। ও গেট থেকে হাত বাড়িয়ে আদর করে, জ্যাক ওকে দেখলেই দৌড়ে এসে আদর খায়। জ্যাকটা খুব আদুরে! মাকে বলেছিল ঋজু ঐরকম একটা কুকুর পুষবে, কিন্তু মা সাফ বারণ করে দিয়েছে, বলেছে যে ওটা ঠান্ডার দেশের কুকুর। ওকে শুধু পুষলেই হবে না, অনেক যত্নে রাখতে হবে। চাকরি ও সংসার সামলে মায়ের সময় কোথায়! একটা প্রাণীকে নিয়ে এলেই তো হবে না, ওকে একটা বাচ্চার মতোই আগলে রাখতে হবে। শুধু শুধু নিয়ে এসে সময়ের অভাবে যদি অযত্ন হয়! ঋজু বোঝে, মনে মনে ভাবে বড় হলে সে যখন সব কাজ করতে পারবে, তখন সে একটা হাস্কি পুষবে, পুষবেই!

খবরের চ্যানেলের সাংবাদিকের হঠাৎ উত্তেজনার খবরে সম্বিৎ ফেরে ঋজুর। ‘খুশবু’ ঝড়টি নাকি তার গতিবেগ বাড়িয়েছে। এই মুহূর্তে আবহাওয়া দপ্তরের খবর ঘন্টায় প্রায় ২০০-২১০ কিলোমিটার বেগেও আছড়ে পড়তে পারে এই ঝড়। কাউকে বাড়ি থেকে বেরতে বারণ করা হচ্ছে। সুরক্ষিত জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অনেক মানুষজনকে। ঋজুর মনটা খারাপ হয়ে গেল রাস্তার মানুষগুলোর জন্য, যাদের ঘরবাড়ি নেই, বা বস্তিতে ছোট ছোট তাঁবুর মতো ঘর বানিয়ে যারা থাকে, তাদের আজ কী হবে! আরও ভাবনা হতে লাগল পশুপাখিদের নিয়ে। পাখির বাসাগুলো তো ঝড়ে উড়ে যাবে! ঝড়ের মুখে পাখির ডিমগুলো কি সামলে রাখতে পারবে মা পাখিরা? আগের বছর ঝড়ে ঋজু দেখেছিল ওদের বাগানের কাঁঠাল গাছ থেকে একটা পাখির বাসা ছিন্নভিন্ন হয়ে দূরে গিয়ে পড়েছিল! রাস্তার কুকুর-বিড়ালরা কী করবে? ওরা কোথায় যাবে? ঝড় হলে ভয়ে ঋজু ওর মাকে জড়িয়ে বসে থাকে, এই পশুপাখিগুলো কাকে জড়িয়ে থাকবে? এইসব ভাবতে ভাবতে গোটা দিন পেরিয়ে গেল।

রাত হল। প্রায় এগারোটার মধ্যে সবাই ডিনার সেরে শুয়ে পড়ল তাড়াতাড়ি। বাড়ির সব জানলা-দরজা ভাল করে বন্ধ করে, সুইচবোর্ড থেকে সব প্লাগ খুলে মা শুতে এল সবশেষে। ঘর অন্ধকার, হালকা নাইট ল্যাম্প জ্বলছে! ঋজুর ঘুম কিছুতেই আসছে না। বারবার কান পেতে শুনছে ঝড় উঠল কিনা। মনে মনে সে ভাবল কাল ঝড়ের একটা ছবি আঁকবে। বৃষ্টির পর যেমন নদীর জলের মতো জল জমে সেইরকম কোনও সিনারি ও আঁকেনি কখনও। এইসব নানা কথা ভাবতে ভাবতে একটু তন্দ্রা এল ঋজুর। হঠাৎ ওর পায়ে ঠান্ডা লাগতে শুরু করল! তাও চুপচাপ শুয়ে ছিল। কারণ একবার চোখ খুললে যদি ঘুম কেটে যায়! হঠাৎ সারা গায়ে ঠান্ডা লাগতে শুরু করল, এক সময় মনে হল ও যেন ভাসছে কিছুর ওপর! ভয়ে চোখ খুলল ঋজু, দেখল সকাল হয়ে গেছে, চারিদিকে আলো! ও ঘরভর্তি জলের ওপর শুয়ে আছে। বুঝতে পারল তাই জন্যই ওর ঠান্ডা লাগছিল।

চোখ পড়ল হঠাৎ জানলার দিকে। তাকিয়ে দেখে জালনার কাঁচ ভেঙে হুড়হুড় করে জল ঢুকছে আর পাগলের মতো হাওয়া দিচ্ছে। বাইরের গাছগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে শাস্তি পেয়ে কান ধরে ওঠ-বোস করছে যেন! হঠাৎ ওর মনে হল ও তো সাঁতার জানে! মনে পড়তেই সাঁতার কাটতে কাটতে বেডরুম থেকে বসবার ঘরে এল। এসে দেখে এ কী কাণ্ড! কাকাইয়ের পিয়ানোর ওপর এ কারা বসে আছে? এক মা কুকুর তার তিনটে বাচ্চাকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে পিয়ানোর বনেটের ওপর। পিয়ানোটা অনেক পুরনো, ঋজুর বাবার দাদুর আমলের, তাই অনেক বড় আর উঁচু। চারিদিকে জল থিকথিক করছে, জলের স্তর আস্তে আস্তে বাড়ছে ক্রমশ। পিয়ানোটাকে একটা আইল্যান্ডের মতো দেখতে লাগছে। ভিজে চুপচুপে হয়ে ওরা চারজন আইল্যান্ডে বসে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছে ঋজুর দিকে। বসার ঘরের তিনটে জানলা দিয়েও যেভাবে হুড়হুড় করে জল ঢুকছে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই জলে আবার ভাসবে এরা।

হঠাৎ ওর মনে হল আহা বাচ্চাগুলো এভাবে ভিজছে, যাই রান্নাঘরের তাক থেকে বিস্কুটের কৌটোটা নিয়ে আসি, ওদের একটু খেতে দিই। ওভাবেই সাঁতার কাটতে কাটতে ঋজু পৌঁছল রান্নাঘরে। গিয়ে দেখে একী! মাইক্রোওয়েভ ওভেনের ওপর যে উঁচু তাকটা আছে তার ওপর একটা মা বেড়াল তার কচি দুটো ছানাকে নিয়ে বসে আছে। ঋজুকে দেখে বলল— ‘মিয়াঁও’, ঋজুও পাল্টা ‘ম্যাঁও’ উত্তর দিল। ঋজু বেড়াল, কুকুর আর কোকিলের ডাক খুব ভাল ডাকতে পারে। সাঁতার কেটে ওদের পাশ দিয়ে গিয়েই হাত বাড়িয়ে বিস্কুটের কৌটোটা পাড়ল ও। আবার সাঁতরে বসার ঘরে ফিরে আসতেই হঠাৎ ওর চোখ পড়ল সিলিংয়ে। এ কী! সিলিং ফ্যানের তিনটে ব্লেড জুড়ে বসে আছে সাত-আটটা পাখি! ছোট-বড় সব মিলিয়ে সার দিয়ে বসে বসে কাঁপছে তারা! ঋজু মুখে শিসের আওয়াজ করতেই ওরা নড়েচড়ে বসল। একজন আরেকজনের গায়ের কাছে সরে এল। দু’-একজন হালকা উত্তর দিল। বেশ ভাল লাগল ঋজুর!

সাঁতরে পিয়ানোর কাছে গিয়ে দু’-তিনটে বিস্কুট টুকরো করে সে কুকুরছানাগুলোর পায়ের কাছে রাখল। প্রথমে ঋজুকে এগিয়ে আসতে দেখে একটু ভয় পেলেও একটু একটু করে বিস্কুট খেতে লাগল ছানাগুলো। ওদের মা ঋজুর দিকে তাকিয়ে একটু কুঁই কুঁই শব্দ করে একটা টুকরো মুখে পুড়ল। ভাবটা এমন যেন ‘থ্যাংক ইউ’ বলল। ঋজু আরও বিস্কুট বার করে টুকরো করে হাতে রাখছিল, হঠাৎ একটা পাখি উড়ে এসে বসল ওর কাঁধে! আর ওর হাতের তালু থেকে এক টুকরো বিস্কুট নিয়ে উড়ে চলে গেল। ফ্যানের ব্লেডে বসে সব পাখিরা মিলে আনন্দে খেতে লাগল বিস্কুট। ভারি মজা পেল ঋজু! আর একটা টুকরো নিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল পাখিগুলোর দিকে! অমনি আরেকটা পাখি উড়ে এসে বিস্কুটটা নিয়ে গেল। এইভাবে কিছুক্ষণ চলতে চলতে হঠাৎ রান্নাঘর থেকে বেড়ালটা ‘ম্যাঁও ম্যাঁও’ করে লাগাতার ডাকতে লাগল, যেন বলতে চাইছে যে— ওদের খাওয়াচ্ছ আর আমরা বাদ পড়ে যাচ্ছি কেন?’ ঋজু মনে মনে ভাবল— বেড়াল মাছ আর দুধ খায় তো জানি, বিস্কুটও খায়? যাই হোক সে আবার সাঁতরে রান্নাঘরে গিয়ে এই বেড়াল ও তার বাচ্চাদুটোকেও বিস্কুট দিল। আহা রে খিদে পেয়েছে বেচারাদের!

রান্নাঘরের জানলা দিয়ে ঋজু দেখল যে বাইরে সব জলের স্রোতে ভেসে চলেছে রাস্তার দিকে। গাছের পাতা, ছোট ডালপালা, তিরপলের টুকরো, প্লাস্টিক ব্যাগে মোড়া ময়লা, জলের বোতল, বালতি, মগ, জুতো ইত্যাদি। হঠাৎ ঋজু দেখল নীল রঙের বাথটাবকে আঁকড়ে ধরে পিকুদের হাস্কি জ্যাক স্রোতের টানে ভেসে যাচ্ছে। রান্নাঘরের জানলা দিয়ে হাত বাড়াল ঋজু। জ্যাক ওকে দেখতে পেয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করে জানলার কাছটায় চলে এল। এমনিতেও জানলার পাল্লা ভাঙাই ছিল, তাই জ্যাকের ঢুকে আসতে কোনও অসুবিধে হল না।

জ্যাককে আগলে সাঁতার কাটতে কাটতে দুজনেই আবার বসবার ঘরে এল। ঋজুর মনটা এখন খুব ভাল লাগছে। ওর ঘরে এখন পাঁচটা কুকুর, তিনটে বেড়াল, সাত-আটটা পাখি মিলে একেবারে জমজমাট পরিবার! কী ভাল যে লাগছে! কিন্তু এদের সকলের সঙ্গে যদি মা, বাবা আর কাকাইয়ের দেখা করাতে পারতো! কিন্তু . . . খেয়াল হয় ঋজুর সত্যিই তো বাড়িতে তো সবাই ছিল! রাতে তো একসঙ্গেই শোওয়া হল! কিন্তু সকলে গেল কোথায়? কাকাইয়ের ঘরে গিয়ে দেখল সেখানে কেউ নেই, বাবার পড়ার ঘরে গিয়ে দেখল সেখানে কেউ নেই। ঋজু বাড়িতে একা আর সঙ্গে এই প্রাণীরূপী বন্ধুগুলো। মা-বাবার কথা ভেবে খুব ভয় লাগতে শুরু করল এবার ঋজুর! ওরা জলে ভেসে কোথাও চলে যায়নি তো জানলা দিয়ে? ও সাঁতার কেটে বেডরুমে এল, ওর ফোনটাও খুঁজতে লাগল, যদি কারুর কাছে ফোন করে সাহায্য চাওয়া যায়! কিন্তু ফোন জলে ভিজে গেলে তো চালু হবে না! কোথাও খুঁজে পেল না ঋজু ফোন। এবার চিৎকার করে সে মাকে ডাকতে লাগল ভয়ে। কোথাও মা নেই। এক নাগাড়ে ডাকতে লাগল ঋজু! আরও জোরে জোরে! জ্যাক কিন্তু ওকে ছেড়ে কোথাও যায়নি, ওর পাশেই পাশেই সাঁতার কাটছে! এমন সময় একটু দূর থেকে পেল মায়ের গলা! ‘কীরে চিৎকার করছিস কেন? রান্নাঘরে ছিলাম তো! ভয় পেলি নাকি? স্বপ্ন দেখলি?’ চোখ খোলে ঋজু! মাথার ওপর জোরে ফ্যান ঘুরছে, গায়ের চাদর সরে গেছে তাই খুব ঠান্ডা লাগছে। চারিদিকে তাকিয়ে এক নাগাড়ে বলে যায়— ‘কোথায় জ্যাক? ওই বেড়ালগুলো? পাখিগুলো? আর ঐ কুকুরছানাগুলো? তোমরা কোথায় ছিলে মা? এত যে জল ছিল, ঝড় হচ্ছিল যে!’

‘ও ঝড়? তুই ঝড়ের স্বপ্ন দেখেছিস বুঝি? ঝড় তো কাল রাতে অন্যদিকে বেঁকে ওড়িশার উপকূলের ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেছে। এদিকে খুব একটা ক্ষয়ক্ষতি হয়নি রে! সব ঠিক আছে! ঐ যে দেখ রোদ উঠছে আস্তে আস্তে!’

ঋজু বাইরে তাকিয়ে দেখে কি সুন্দর নরম একটা রোদ উঠছে। স্বপ্ন? এতক্ষণ তাহলে স্বপ্ন দেখছিল ঋজু? কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না ওর! এখনও মনে হচ্ছে ওই কুকুর, বেড়াল আর পাখিগুলো ওর দিকে পুটপুট করে তাকিয়ে আছে! কিছুক্ষণ পর স্বপ্নের ঘোর কাটতেই তড়াক করে খাট থেকে নেমে দু’মিনিটে ব্রাশ করে আঁকার খাতা আর রং-পেনসিল নিয়ে দৌড়ে ছাদে চলে যায় ঋজু। পশুপাখিতে ভরা কালকের ঐ সুন্দর স্বপ্নটা এঁকে ফেলতে হবে তো!