Categories
পুরাণপাড়া |

ট্রোজান হর্স

474 |
Share
| ২৫ জানুয়ারী, ২০২২
মানস শেঠ

চিত্র ঋণ: Trojan Horse: The New Evidence Documentary

ইতিহাসে এমন কিছু যুদ্ধ আছে, যাদের কথা চিরস্মরণীয়। সেরকমই এক যুদ্ধ হয়েছিল গ্রিস ও ট্রয় নগরীর মধ্যে। ভয়ংকর ছিল সেই যুদ্ধ। ট্রয়ের রাজপুত্র ছিল প্যারিস, তিনি তখনকার গ্রিসের স্পার্টা নগরীর রাজা মেনিলাসের স্ত্রী হেলেনকে লোভ দেখিয়ে নিয়ে এলেন ট্রয় নগরীতে। রেগে গেলেন মেনিলাস, ভাবলেন একটা উপযুক্ত জবাব দেওয়া উচিত ট্রয় নগরীর সম্রাটকে।

মেনিলাস তখন খবর পাঠালেন গ্রিসের আর্গস নগরের রাজা আগামেমননকে। সম্পর্কে সে ছিল মেনিলাসের ভাই। তিনি আদেশ দিলেন গ্রিসের সমস্ত নগরের রাজাকে নিয়ে যুদ্ধে যেতে। আগামেমনন সহ সবাই প্রায় হাজারটি জাহাজ নিয়ে ট্রয়ের বিরুদ্ধে হেলেনকে উদ্ধার করতে যুদ্ধে গেলেন। মোটামুটি তখন খ্রিস্টপূর্ব ১২৩০ অব্দ।

প্রায় দশ বছর ধরে চলেছিল এই যুদ্ধ। গ্রিসের থেকে ট্রয়রা ছিলেন অনেক শক্তিশালী। তারাই যুদ্ধ জিতছিল, এমন সময় ঘটল সেই ঘটনা। গ্রিসের মহাবীর অ্যাকিলিসের মৃত্যুর পর, গ্রিসরা আর পেরেই উঠছিল না। তখন একটা রাতই বদলে দিয়েছিল সমস্ত পরিকল্পনা। কীভাবে?

টানা দশ বছর যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত গ্রিক সৈন্যদল। ট্রয়ের বিরুদ্ধে তাদের সমস্ত রণকৌশল ব্যর্থ। প্রায় পরাজিত গ্রিকরা তখন গেল গণৎকার ক্যালক্যাসের কাছে। ক্যালক্যাস ছিলেন খুবই বিচক্ষণ। কারণ,এর আগে তিনি সফল হয়েছেন অ্যাকিলিসের মৃত্যু সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে। ক্যালক্যাস বুদ্ধি দিলেন, গায়ের জোরে না পারলে বুদ্ধির জোর প্রয়োগ করতে হয়। এইকথা শুনে গ্রিকবীর ওডেসিয়াস এক চমৎকার পরিকল্পনা করলেন। তার পরিকল্পনা অনুযায়ীই এক বিরাট বড় কাঠের ঘোড়া তৈরি করা হল। মাত্র তিনদিনের মধ্যে এপিয়াস নামের একজন দক্ষ কারিগর এই ঘোড়াটি তৈরি করলেন। ঘোড়ার গায়ে খোদাই করে লেখা হল, ‘For their return home, the Greeks dedicate this offering to Athena’। এই ঘোড়াই বিখ্যাত হয়ে আছে ‘ট্রোজান হর্স বা ট্রয়ের ঘোড়া’ হিসেবে।

বিরাট ঘোড়াটির ভেতর গ্রিকরা তাদের এক আক্রমণকারী বাহিনীকে ঢুকিয়ে দিল এবং ট্রয় নগরের দেয়ালের বাইরে তা ফেলে রাখল। এরপর তারা তাদের তাঁবুগুলোকে পুড়িয়ে ফেলে রাতের আঁধারে টেনিডোস নামক একটা দ্বীপে চলে গেল, যেটা ছিল ট্রয়ের খুব কাছে। শুধুমাত্র সাইনন নামের এক গ্রিক সৈন্যকে রেখে যাওয়া হল আলো জ্বালিয়ে তাদের সংকেত দেবার জন্য।

ওডিসিউস সাইননকে তার আগেই সমস্ত কিছু শিখিয়ে রেখে গেছেন। যখন ট্রয়ের রাজা তাকে দেখতে পেয়ে ধরে নিয়ে যাবে, তখন কীভাবে কোন গল্প বানাতে হবে। ট্রয়ের রাজা প্রায়াম যখন সাইননকে ধরে নিয়ে এলেন, সে ওডিসিউসের শেখানো গল্প গড়গড় করে বলে গেল। আরও বলল, ‘আমাকে বলি দেওয়ার সমস্ত ব্যবস্থাই পাকা হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ঐ রাত্রে আমি শিবির থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হই আর জঙ্গলের ভেতর গিয়ে লুকিয়ে থাকি। গ্রিকরা চলে যাবার পর আমি বেরিয়ে আসি।’

সাইননের বানানো কাহিনি সকলে অকপটে বিশ্বাস করল। রাজাও তাকে অভয় দিলেন। কৃতজ্ঞতার ভান করে সাইনন গল্পের দ্বিতীয় অংশটি জানাল। সে বলল, ‘এই কাঠের ঘোড়াটিকে গ্রিকরা রেখে গেছে দেবী এথিনার প্রতি নৈবেদ্য হিসেবে। তবে এর পেছনে তাদের একটা অসৎ উদ্দেশ্য আছে। তারা চায় ট্রয়বাসীরা এটিকে ধ্বংস করুক যাতে দেবী এথিনা ট্রয়ের উপর ক্রুদ্ধ হন। কিন্তু আপনি ভেবে দেখুন, নগরীর অভ্যন্তরে এথিনার যে মন্দির আছে, সেখানে ঘোড়াটি নিয়ে গেলে দেবী তো গ্রিকদের বদলে ট্রয়বাসীদের প্রতিই অনুগ্রহ দেখাবেন, তাই না?’

এই চতুর গল্পের চরম ফল ফলল সঙ্গে সঙ্গে, আর এভাবেই সফল হল ওডিসিউসের ধূর্ত কৌশল। দশ বছরের যুদ্ধে যা সম্ভব হয়নি, সেই দুঃসাধ্য সাধন হল একটি বানানো গল্পের মাধ্যমেই।

ট্রয়বাসী আনন্দ-উল্লাস করতে করতে ঘোড়াটিকে নগর-দেয়ালের অভ্যন্তরে নিয়ে এল। নিয়ে গেল এথিনার মন্দিরের চত্বর পর্যন্ত। তারা বুঝতেই পারেনি যে, ঘোড়াটি গ্রিক সৈন্য দ্বারা পরিপূর্ণ।

ঘোড়াটি এত বড় করে বানানো হয়েছিল যেন শহরের মূল ফটক ভেঙে এটিকে শহরের ভিতরে প্রবেশ করাতে হয়। মধ্যরাতে অন্ধকার মন্দির চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা কাঠের ঘোড়ার পেটের দিকে খুলে গেল একটি দরজা। বেরিয়ে এল পঞ্চাশজন দুর্ধর্ষ গ্রিকযোদ্ধা, আর তাদের নেতা মহাবীর ওডিসিউস। তারা পা টিপে টিপে নগরীর মূল ফটকের দ্বার খুলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে বাইরে অপেক্ষমান গ্রিকবাহিনী ঢুকে পড়ল ঘুমন্ত নগরীতে।

সামনে যাকে পেল, তাকেই হত্যা করল তারা। বিভিন্ন ভবনে একসাথে লাগিয়ে দিল আগুন। পরাজিত হল ট্রয়বাসীরা। একসময় ইউরোপ মহাদেশের সবচেয়ে সম্পদশালী নগরী ট্রয় একরাতের মধ্যে জ্বলে পুড়ে পরিণত হল ধ্বংসস্তুপে। অনাদিকাল ধরে মানুষ স্মরণ করবে ট্রয়ের সেই ভয়াল কালো রাত্রের কথা এবং কাঠের ঘোড়া ‘ট্রোজান হর্স’ জীবন্ত হয়ে থাকবে এক ঐতিহাসিক যুদ্ধের মাধ্যম হিসেবে।