Categories
প্রকৃতির ডাকঘর |

ঠকাঠক কাঠঠোকরা

1004 |
Share
| ১০ ডিসেম্বর, ২০২০
সুপ্রিয়া সরকার

প্রকৃতি সংসদের সদস্যা

চিত্র: সৌভিক গুহসরকার

সকাল থেকেই মেঘলা আকাশ আর ঝিরঝিরে বৃষ্টি। সামনের গাছগুলিতে পাখির আনাগোনা খুবই কম, হঠাৎ একটি ধাতব চাকতি গড়িয়ে পড়ার মতো একটানা আওয়াজ চারপাশ সচকিত করে তোলে ‘কি কি কি কি কি কি র র র র’। সামনের করঞ্জ গাছের গুঁড়ির উপর ঝপ্ করে উড়ে এসে বসে একটি ছোট সোনালি কাঠঠোকরা, Lesser Golden back Woodpecker (২৯ সেমি)— মাথায় লাল ঝুঁটি। বৈজ্ঞানিক নাম Dinopium benghalense। বসেই এদিক ওদিক তাকিয়ে লম্বা ঠোঁট দিয়ে গাছের গায়ে ঠোকরাতে থাকে। পর মুহূর্তেই আর‌ও একটি কাঠঠোকরা ওর পাশে এসে বসে। দুটি পাখিই গাছের গুঁড়ি আঁকড়ে ধরে আর গাছের চারপাশে ঘুরে ঘুরে ওপর দিকে উঠতে থাকে। লম্বা ঠোঁট দিয়ে ঠুকে ঠুকে কী জানি কী সব বার করে খায়, হয়তো বা পোকামাকড়। এর‌ই মধ্যে খুব জোরে ডাকতে ডাকতে আরও দুটি কাঠঠোকরা এসে গাছের গায়ে বসে এবং এক‌ই রকম ভাবে ঘুরে ঘুরে ওপরে ওঠে, আবার কখনও বা হঠাৎ পিছু হটে নিচের দিকে নেমে আসে।

আকার: ছোট সোনালি কাঠঠোকরা পাখির পিঠ ও ডানা উজ্জ্বল সোনালি হলুদ ও কালোয় মেশানো। পুরুষ পাখির মাথার ওপর এবং ঝুঁটি টুকটুকে লাল। দেহের নিচের অংশে ঘিয়ে সাদার ওপর কালো টানা টানা দাগ আছে। কালো টানা দাগগুলি চিবুক থেকে শুরু হয়ে একেবারে তলপেট অবধি চলে গেছে। বুকের কাছের দাগগুলি অপেক্ষাকৃত ঘন। চিবুক ও গলার কালো দাগগুলির ওপর সাদা সাদা ছিট আছে। মাথা ও ঘাড়ের দু’পাশ সাদা, তবে মাথার দু’পাশে চোখের ওপর কালো পট্টি আছে— পট্টিগুলি সাদা সাদা ছিটে ভরা। কালো রঙের ঠোঁটটি বেশ লম্বা। পায়ে চারটি করে আঙুল আছে— দুটি সামনে আর দুটি পিছনে। স্ত্রী পাখিটি পুরুষ পাখির মত‌ই দেখতে, কেবল মাথার চাঁদি কালো ও তার ওপর সাদা সাদা ছিট আছে। চাঁদির পেছনেই ছোট্ট লাল ঝুঁটি। অপরিণত পাখিটি প্রায় স্ত্রী পাখির মতোই দেখতে, তবে গায়ের রঙ অপেক্ষাকৃত হালকা এবং তাতে খানিক বাদামি ভাব আছে। মাথার চাঁদি কালো, তাতে সাদা সাদা ছিটগুলি নেই।

আবাসস্থল: কাঠঠোকরাদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত এই ছোট সোনালি কাঠঠোকরা পাখিটি। এই পাখিটি এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্রই এদের দেখা যায়।

বিচরণক্ষেত্র: হালকা জঙ্গল, চাষের ক্ষেতের ধারে বড় গাছ, আম ও তাল-নারকেলের বাগান, এছাড়া গ্ৰাম থেকে শহর যেখানেই যত বড় বড় গাছ আছে সব জায়গাতেই এদের দেখা যায়। রাস্তার দু’ধারে ও শহরের মাঝখানে প্রায় সব গাছেই এদের আনাগোনা। তবে ঘন জঙ্গল এরা পছন্দ করে না।

স্বভাব: সাধারণত দুটি পাখি একসাথে থাকে তবে কখনও কখনও দু’জোড়া অর্থাৎ চারটি পাখিকেও একসাথে এ-গাছ থেকে ও-গাছে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। অন‍্যান‍্য পাখিরা যেভাবে গাছের ডালে বসে সেভাবে এরা কখন‌ওই বসে না। নখ দিয়ে গাছের গুঁড়ি আঁকড়ে ধরে লেজের ওপর ভর দিয়ে লম্বালম্বিভাবে বসে আর গাছের গুঁড়ি আঁকড়ে ঝাঁকুনি দিয়ে দিয়ে গাছের চারদিকে ঘুরে ঘুরে ওপরে ওঠে, আবার কখনও বা হঠাৎ পিছু হঠে নিচের দিকে নেমে আসে। এইভাবেই লম্বা ঠোঁট দিয়ে ঠোকরাতে থাকে। ঠুকে ঠুকে গাছের ছালের নিচে লুকিয়ে থাকা পোকামাকড় বের করে খায়। কাঠঠোকরাকে মাঝে মাঝে মাটিতে নেমেও লাফিয়ে লাফিয়ে খাদ্য সংগ্ৰহ করতে দেখা যায়, বিশেষ করে কাঠপিঁপড়ে, লাল ডেঁও পিঁপড়ে অথবা শুঁয়োপোকা-জাতীয় পোকার সন্ধানে। এদের ওড়বার কায়দাতেও বিশেষত্ব আছে। পাখা জোড়া খুব জোরে চালিয়েই বন্ধ করে ফেলে, সেই গতিবেগে খানিকটা সোজা গিয়েই শূন্য পথে ডুব দেয় আবার দ্রুত পাখা চালিয়ে ওপর দিকে উঠে খানিকটা গিয়েই আবার ডুব। এইভাবেই উড়ে উড়ে এ-গাছ থেকে ও-গাছে ঘুরে বেড়ায়, সঙ্গে সেই বিচিত্র ডাক ‘কি কি কি কি কি’।

খাদ‍্য: গাছের গায়ে এবং ছালের নিচে লুকিয়ে থাকা ছোট বড় পোকামাকড়, শূককীট, উই, পিঁপড়ে, পোকামাকড়ের ডিম, এছাড়া পাকা ফলের শাঁস এবং ফুলের মধু।

বাসা ও ডিম: মার্চ থেকে আগস্ট মাস এদের বাসা বানানোর আর ডিম পাড়বার সময়। মাটি থেকে 3-10 মিটারের মধ‍্যে গাছের কাণ্ডে বা ডালে ঠোঁট দিয়ে কুড়ুলের মতো ঠুকে ঠুকে অতি পরিপাটি করে সুন্দর গোল মুখের গর্ত খোঁড়ে। গর্তের মুখ থেকে সোজা কিছুটা গিয়ে নিচের দিকে নেমে গোল করে ডিম পাড়বার ঘর তৈরি করে। এই গর্তর মধ্যে তিনটি খুব চকচকে ও ধবধবে সাদা রঙের ডিম পাড়ে। এরা বছরে দুবার‌ও ডিম পাড়ে। বাসা তৈরি ও বাচ্চা প্রতিপালনের কাজে স্ত্রী-পুরুষ দুজনেই পরস্পরকে সাহায্য করে।

ঋণ: The Book of Indian Birds, Salim Ali; চেনা অচেনা পাখি, অজয় হোম; অপূর্ব চক্রবর্তী (প্রকৃতিবিদ)