Categories
পুজোর খাতা ২০২৪ |

তাতানের কৈলাসভ্রমণ

122 |
Share
| ৫ অক্টোবর, ২০২৪
সৈকত মিত্র

চিত্রবিন্যাস/ কমলাকান্ত পাকড়াশী

ছোট্ট তাতান দাদুর মুখে রূপকথার গল্প শুনেছে, এমনকি কৈলাসে মা দুর্গা, শিব ঠাকুর থাকেন তাও সে দাদুর কাছ থেকেই জেনেছে। প্রতিদিন দাদু অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যার টিফিন সেরেই বসে পড়েন গল্পের আসরে তাতান আর ওর ছোট বন্ধুদের নিয়ে। সেদিন অফিস থেকে ফিরতেই তাতান দাদুকে জিজ্ঞাসা করে, ‘আচ্ছা দাদু কৈলাস পর্বতটা কোথায়? কীভাবে যেতে হয় ওখানে? তুমি কখনো গেছো ওখানে?’
দাদু বলেন, ‘সে অনেক দূর আমি কখনো যাইনি। শুনেছি একমাত্র পক্ষীরাজ ঘোড়ার পিঠে চেপেই ওখানে যাওয়া যায়!’
তাতান বলে, ‘আচ্ছা দাদু, এই পক্ষীরাজকে কোথায় পাবো?’
দাদু বলেন, ‘যারা অন্যের উপকার করে, খুব ভালো মানুষ, কখনো কোনো মিথ্যা কথা বলে না, বড়দের সম্মান করে, চুরি করে না— একমাত্র তারাই পক্ষীরাজের দেখা পায়।’
তাতান মনে মনে ভাবে, ‘তাহলে দাদু নিশ্চয়ই খুব দুষ্টু ছিল, তাই কখনো পক্ষীরাজকে দেখতে পায়নি।’

পরদিন তাতান স্কুল থেকে ফিরে খেলতে যাবার জন্য বাড়ির বাইরে বেরিয়ে দেখল ময়লা কাপড়পরা একজন মহিলা আর তার সঙ্গে দুটো ছেলে আর দুটো মেয়ে ওদের বাড়ির বাইরে বসে আছে।
ওদের দেখেই মনে হয় ওরা ভীষণ গরিব, হয়তো সকাল থেকে কিছু খাওয়াও হয়নি ওদের।
ভদ্রমহিলা ওকে বললেন, ‘বাবা আমাদের একটু জল খাওয়াতে পারবে?’
তাতান বলল, ‘নিশ্চয়ই তোমরা ভিতরে এসে বসো!’
উনি বললেন, ‘না বাবা, আমরা এখানেই দাঁড়াচ্ছি তুমি এখানেই নিয়ে এসো।’
তাতানের খুব মায়া হল ওদের দেখে। তাই ও জলের সাথে ফ্রিজে রাখা লাড্ডুর বাক্সটাও নিয়ে এল!
লাড্ডু দেখে ভদ্র মহিলার নাদুসনুদুস ছেলেটার চোখগুলো উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
ছেলেটা হাসিমুখে বলল, ‘তুমি আমাদের জন্য লাড্ডু এনেছ। জানো আমি লাড্ডু খেতে খুব ভালোবাসি’—বলে হাত পাতল! ছেলেটার মা ওর হ্যাংলামো দেখে রেগে চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘খালি খাইখাই করিস কেন?’ তারপর তাতানকে বললেন, ‘না বাবা, তুমি শুধু জল দাও আর কিছু দিতে হবে না। তোমার ভাগের মিষ্টি সব আমাদের দিয়ে দিলে তুমি খাবে কি?’
তাতান বলল, ‘তা কেন! আমি পরেও খেতে পারব কিন্তু তোমরা হয়তো সারাদিন না খেয়েই আছ। তোমাদের দেখে আমার মনে হল, তাই নিয়ে এলাম। একটু কিছু না খেলে শরীর খারাপ করবে। জানো মা বলে, সময় মতো খাওয়াদাওয়া না করলে কঠিন অসুখ হয়।’
ওরা সবাই তাতানের কথায় খুশি হয়ে লাড্ডু খেয়ে জল খেল।
তারপর ভদ্রমহিলা ওর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে বললেন, ‘মা দুর্গা তোমার মঙ্গল করুন। তোমার সব ইচ্ছা পূরণ হবেই ওনার আশীর্বাদে। এখন বলো দেখি তুমি, কী উপহার চাও মায়ের কাছে? আমার সঙ্গে যখন দেখা হবে আমি বলে দেব!’
তাতান বলল, ‘আমার খুব ইচ্ছা পক্ষীরাজ ঘোড়ার পিঠে চড়ে একবার কৈলাসে গিয়ে মা দুর্গা, বাবা মহাদেব, গণেশ দাদা, কার্তিক দাদা, লক্ষ্মী-সরস্বতী দিদিদের সাথে দেখা করার। কিন্তু তুমি ওদের পাবে কোথায়? ওরা তো কৈলাসে থাকে!’
‘ও এই ব্যাপার’— বলে উনি ওনার ব্যাগ থেকে একটা সাদা রঙের মাটির ঘোড়া বের করে বললেন, ‘এই নাও তোমার পক্ষীরাজ, ওকে মাটিতে রেখে ওর কানের কাছে বলবে তুমি কোথায় যেতে চাও— দেখবে ও তোমায় নিয়ে যাবে!’
মাটির ঘোড়াটা হাতে নিয়ে তাতান নেড়েচেড়ে দেখছিল।
তারপর মুখ তুলে তাকাতেই দেখে ওরা কেউ কোথাও নেই। ও একা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।
তাতান মনে মনে ভাবল, ‘যা বাবা! ওরা সবাই এত তাড়াতাড়ি কোথায় গেল?’
মাটির ঘোড়াটাকে ঘরে রেখে এসে খেলতে চলে গেল মাঠে।

সন্ধ্যেবেলায় এসে পড়তে বসে তাতানের মনে পড়ল গরিব মহিলার বলা কথাগুলো।
তখন সে ঘোড়াটাকে মাটিতে রেখে ঘোড়ার কানের কাছে মুখ এনে বলল, ‘পক্ষীরাজ আমায় নিয়ে মা দুর্গার কাছে কৈলাসে চলো তো!’
বলতেই ঘোড়াটা জ্যান্ত হয়ে মানুষের মতো গলায় বলে উঠল, ‘উঠে এসো আমার পিঠে এখনই নিয়ে যাচ্ছি!’
তাতান চমকে যাওয়ায় পক্ষীরাজ বলল, ‘কই বন্ধু উঠে এসো!’
তাতানকে নিয়ে পক্ষীরাজ কৈলাসে উড়ে গেল।
তারপর যেখানে এসে নামল সেখানে চারিদিক শুধু বরফে ঢাকা!
পক্ষীরাজ বলল, ‘ওই যে সোনার বিরাট উঁচু দরজা দেখছ যেখানে বল্লম হাতে নিয়ে দুজন পাহারা দিচ্ছে ওটাই কৈলাসে ঢোকার প্রধান দরজা। ওদের গিয়ে বল যে তুমি মা দুর্গাকে দেখতে এসেছ। একথা বললেই ওরা তোমায় ভেতরে নিয়ে যাবে। আমি এই বাইরেই তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। যাও মায়ের সাথে দেখা করে এসো!’

তাতান দেখতে পেল— সামনে বিশাল উঁচু পর্বত।
‘আরে ওই তো একটা নীল ঝিল দেখা যাচ্ছে, এ আমি কোথায় এসে পড়লাম’—মনে মনে ভাবতে ভাবতে তাতান এগিয়ে গেল।
সামনে দেখল, ইয়া বড় গোঁফওয়ালা লোক দুজনে হাতে দুটো বল্লম নিয়ে একটা সোনালী দরজার বাইরে পাহারা দিচ্ছে। দিনের আলো পড়ে দরজাগুলো খুব চকচকে লাগছে। ও এগিয়ে গিয়ে প্রহরীকে সবকিছু বলতেই ওরা ওকে মায়ের কাছে নিয়ে এল।
ভেতরে ঢুকে তাতান দেখল, একজন জটাধারী সাধুবাবা চোখ বুজে ধ্যান করছেন, তার গলায় সাপ ফণা তুলে আছে। ওনার পাশে একজন ভদ্রমহিলা লাল পেড়ে শাড়ি পড়ে সেজেগুজে বসে আছেন। সারা গায়ে ওনার অনেক গয়না। প্রহরী তাতানকে বলল, ‘এই হচ্ছে আমাদের বাবা মহাদেব আর উনি মা দুর্গা’—এই বলে সে চলে গেল!
মা দুর্গাকে প্রণাম করে তাঁর মুখের দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে গেল তাতান। সে হাঁ করে ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল—আরে উনিই তো ক’দিন আগে এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে ওঁর ছেলেমেয়েদের নিয়ে। ওঁকেই তো আমি জল আর লাড্ডু খেতে দিয়েছিলাম।
মা দুর্গা হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ তুমি ঠিকই ধরেছ। আমিই সেদিন গিয়েছিলাম তোমাদের বাড়ি ওদের নিয়ে। ওরা কে জানো?’
মা দুর্গা তারপর তাঁর ছেলেমেয়েদের ডাকলেন। ওঁদের আসল রূপ দেখে তাতান অবাক হয়ে গেল। মা দুর্গা তারপর গণেশদাদা, কার্তিকদাদা, লক্ষ্মী-সরস্বতী দিদির সঙ্গে তাতানের পরিচয় করিয়ে দিলেন। বাবা মহাদেবও চোখ খুলে তাতানকে দেখে খুব খুশি হলেন!

ওদের সঙ্গে খেলাধুলো ও হাসি-মজায় বেশ কয়েকদিন কেটে গেল তাতানের!
একদিন সকালে মা দুর্গা তাতানকে বললেন, ‘এবারে যে বাড়ি ফিরতে হবে তোমায়, মা না হলে খুব চিন্তা করবে।’ বাড়িতে মায়ের জন্যেও তাতানের খুব কষ্ট হচ্ছিল আবার ওদের সবাইকে ছেড়ে চলে যাবে এই কথা ভেবেও খারাপ লাগছিল! তখন মা দুর্গা ওকে বললেন, ‘পাগল আমি তো কদিন বাদেই সবাইকে নিয়ে যাচ্ছি তোদের ওখানে, দুঃখ করছিস কেন? চোখের জল মোছো লক্ষ্মীটি, কাঁদে না!’ এই বলে তাতানকে কোলে করে পক্ষীরাজের পিঠে চাপিয়ে দিলেন! সবাই হাত নেড়ে তাতানকে বিদায় জানাল। পক্ষীরাজ তাতানকে নিয়ে ডানা মেলে আকাশে উড়ে গেল।

মা ঠেলা দিতেই তাতানের ঘুম ভেঙে গেল।
তারপর সে মনে মনে ভাবল, ‘তাহলে কি আমি এতক্ষণ ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলাম!’
তাতানের মা বলল, ‘কী রে! পড়তে বসে তো ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিলি! রাত হয়েছে। এখন তাড়াতাড়ি খাবি আয়!’

খাওয়াদাওয়া করে এসে খাটে শুয়ে টেবিলের ওপর রাখা মাটির ঘোড়াটাকে তাতান দেখছিল আর ভাবছিল, ‘ইস! যদি এই স্বপ্নটা সত্যি হত, কী ভালোই যে হত!’
তখন ওর মনে পড়ল সেদিন মা দুর্গা বলেছিলেন, ‘পক্ষীরাজের কানের কাছে মুখ নিয়ে যেখানে যেতে চাও সেখানকার নাম বললেই নাকি ও জ্যান্ত হয়ে উঠবে!’
তাতান ভাবল— দেখি তো একবার পরীক্ষা করে।

তারপর তাতান উঠে ঘোড়াটাকে মেঝেতে রেখে ঘোড়ার কানের কাছে বলল, ‘পক্ষীরাজ চলো দেখি আমায় নিয়ে কৈলাসে’— বলতেই তাতান দেখল খুব সুন্দর সাদা রংয়ের ডানাওয়ালা একটা ঘোড়া ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে!
সেই ঘোড়াটা মানুষের গলায় বলে উঠল, ‘তাহলে আর দেরি কেন? উঠে এসো আমার পিঠে।’