Categories
ভাষাপুকুর |

দীনবন্ধু এণ্ড্রুজ

615 |
Share
| ১৮ এপ্রিল, ২০২১
শ্যামলী আচার্য

গল্পকার ও বেতার উপস্থাপক

চিত্র: (বাঁদিকে) রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সঙ্গে এণ্ড্রুজ; সৌজন্যে: Wikipedia; www.bu.edu; pinterest

বিংশ শতাব্দীর প্রথম প্রহরে বিশ্বপ্রকৃতির উদার প্রাঙ্গণে ছেলেদের মুক্তি দেবার জন্য রবীন্দ্রনাথ তৈরি করলেন শান্তিনিকেতন-বিদ্যালয়।

শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতী বয়ে নিয়ে চলেছে রবীন্দ্রনাথের সারা জীবনে কর্মসাধনার পরিচয়। এই সাধনা তাঁর মতে, মনুষ্যত্বসাধনা। এই সাধনায় যাঁরা স্থপতি, এই সহযোগীর দল, এঁরা আশ্রমের সৃষ্টিকার্যে নিজেদের সর্বতোভাবে উৎসর্গ করেছিলেন। এই সঙ্গী কর্মী এবং বন্ধুদের কথাই ধরা রয়েছে ‘শান্তিনিকেতনের গোড়ার কথা’য়।

আজ দীনবন্ধু এণ্ড্রুজের কথা।

‘আমার প্রাণ চায় যথার্থ স্বাধীন ভারতের মূর্তিটি দেখব। অথচ দেশের বর্তমান অবস্থায় সেটি কি সম্ভব? পরাধীনতার ও দুর্নীতির পাপচক্র কেবলই আবর্তিত হয়ে চলেছে শাসক ও শাসিতের মধ্যে।’

রবীন্দ্রনাথকে চিঠিতে লিখছেন চার্লস ফ্রিয়ার এণ্ড্রুজ।

কে এই এণ্ড্রুজ? ধার্মিক পিতামাতার সন্তান তিনি। তাঁর বাবা এডউইন এণ্ড্রুজ ছিলেন বার্মিংহামের ক্যাথলিক অ্যাপোস্টোলিক চার্চের বিশপ। সরল অনাড়ম্বর জীবন তাঁর। শৈশবে বাবার কাছ থেকেই তো তাঁর ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা আর নিরাসক্তির দীক্ষা। ‘মা ছিলেন আমাদের রানী— আর কাউকে আমরা মানিনি, জানিনি।’ এণ্ড্রুজ ছিলেন মায়ের খুব আদরের; দারিদ্র্যপীড়িত সংসারের কর্ত্রী তিনি, কাজেই সেই অসচ্ছল পরিবারে মা তাঁর সন্তানদের আগলে রাখেন বাড়তি মমতায়। ভারতবর্ষের কথা এণ্ড্রুজ প্রথম শুনেছেন তাঁর মায়ের কাছেই। কৃতজ্ঞ এণ্ড্রুজ তাঁর মায়ের স্মৃতিচারণ করেছেন বহুবার।

বার্মিংহামের কিংস এডওয়ার্ড স্কুলে তাঁর ছেলেবেলার পড়াশোনা। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র তিনি। পড়ার বই ছাড়াও ছবি আঁকা, অভিনয়, নৌকাবাইচ, ক্রিকেটে ছিল তাঁর সমান উৎসাহ। পরে তিনি ভর্তি হন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পেমব্রোক কলেজে। পাঁচ বছরের পড়াশোনা শেষ করে ট্রাইপোজ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন, ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে এণ্ড্রুজ পেমব্রোক কলেজ মিশনে যাজক হন। এরপরে তিনি কেমব্রিজের তাত্ত্বিক কলেজ ওয়েস্টকট হাউসের যাজক ও সহ অধ্যক্ষ হন।

এই সময় তাঁর মনোজগতে চলছে টানাপোড়েন। তিনি বিশপ ওয়েস্টকট পরিচালিত ক্রিশ্চান সোস্যাল ইউনিয়নে যোগ দিয়েছেন। ইংল্যাণ্ডের কলকারখানার নিপীড়িত অসহায় শ্রমিকশ্রেণীর সঙ্গে ক্রমশ পরিচিত হচ্ছেন তিনি। তাঁর মনের মধ্যে জাগ্রত হয়ে উঠছে সেই বাণী . . . নয়ন মেলে দেখ দেখি তুই চেয়ে, দেবতা নাই ঘরে। ধূলামন্দিরে ‘শুচি বসন ছাড়ি’ ঈশ্বরের প্রকৃত রূপ খুঁজে পেয়েছেন এণ্ড্রুজ। আর সেইজন্যেই খ্রিস্ট ধর্মের একান্ত বিশ্বাসী হয়ে আনুষ্ঠানিক খ্রিষ্টধর্মের প্রচলিত বিধিগুলি তাঁর পক্ষে একসময় অনুসরণ করা অসম্ভব হয়ে ওঠে।

এণ্ড্রুজ রবীন্দ্র-সান্নিধ্যে প্রথম এলেন ১৯১২ সালের ৩০ জুন। সেদিন ব্রিটিশ চিত্রশিল্পী উইলিয়াম রোদেনস্টাইনের হ্যামস্টেডের বাড়িতে বসেছে সাহিত্যের আড্ডা। তখন ‘গীতাঞ্জলি’র কবিতাগুলোর ইংরেজি অনুবাদ হয়ে গেছে। বইটি ছাপা হয়নি। বইয়ের কবিতাগুলির অনুবাদ পাঠ হবে। পাঠ করবেন আইরিশ কবি উইলিয়াম ইয়েটস। রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে সেই আবৃত্তি শুনবেন ইংল্যাণ্ডের বিশিষ্ট সব বিদ্বজ্জন। রয়েছেন অনেকেই; কবি রবার্ট ব্রিজেস, সাংবাদিক হেনরি নেভিনশন, এজরা পাউণ্ড, সাহিত্যিক এইচ জি ওয়েলস, কেমব্রিজ মিশনের ধর্মযাজক-অধ্যাপক-সাহিত্যিক চার্লস ফ্রিয়ার এন্ড্রুজ।

কবিতাপাঠ শেষ হলে ভারতীয় কবির হাত ধরলেন এক ইংরেজ, ‘তাঁর মুখে আনন্দের আভা, চোখে যেন পূজার প্রদীপ জ্বলছে’। এণ্ড্রুজ সেই সাক্ষাতের স্মৃতি বর্ণনা করেছেন তাঁর স্বকীয় ভঙ্গিতে। ‘সেদিন কবিকে আমি প্রথম দেখলাম, তাঁর কাব্যসুধা পান করলাম। ভারতের অন্তর-গভীরে যে মহান বিশ্ব সংস্কৃতি নিহিত সেই সংস্কৃতির সূক্ষ্ম নিবিড় মাধুর্যের পরিচয় আমি আমার স্তব্ধ অন্তরের মধ্যে অনুভব করলাম। সেদিন রাত্রে হ্যাম্পস্টেড হীথে আমি ঘন্টার পর ঘন্টা ঘুরে বেড়ালাম, শুধু ভাবতে লাগলাম— আজ সন্ধ্যায় এ কী আমি দেখলাম, কী আমি শুনলাম— এই অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমার জীবনের সম্পর্ক কী? বাহিরে রাত্রি অন্ধকার কিন্তু আমার অন্তর আকাশ যে এক আশ্চর্য আলোকচ্ছটায় উদ্ভাসিত হয়ে গেল।’

রবীন্দ্রনাথের কাছেও এ এক পরম পাওয়া। তিনিও লিখেছেন সেই প্রথম সাক্ষাতের দিনটির কথা। ‘হ্যাম্পস্টেড হীথের ঢালু মাঠ পেরিয়ে চলেছিলাম ধীরে ধীরে। সে রাত্রি ছিল জ্যোৎস্নায় প্লাবিত। এণ্ড্রুজ আমার সঙ্গ নিয়েছিলেন। নিস্তব্ধ রাত্রে তাঁর মন পূর্ণ ছিল গীতাঞ্জলির ভাবে। ঈশ্বর প্রেমের পথে তাঁর মন এগিয়ে এসেছিল আমার প্রতি প্রেমে।’ রবীন্দ্রনাথের প্রতি এণ্ড্রুজের এই আস্থা বজায় ছিল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।

এর অনেক আগেই, ১৯০৪ সালের ৩০ মার্চ এণ্ড্রুজ এসেছিলেন ভারতবর্ষে। বলেছিলেন, এই দিনটি তাঁর দ্বিতীয় জন্মদিন। তখন মাত্র তেত্রিশ বছর বয়স তাঁর। দিল্লিতে কেম্ব্রিজ মিশনের কলেজ সেন্ট স্টিফেন্স কলেজের ইংরেজি ও ইতিহাসের অধ্যাপক তিনি। কলেজে এসেই জানতে পারলেন, অধ্যক্ষের পদ খালি হওয়ায় কর্তৃপক্ষ তুলনামূলকভাবে যোগ্য প্রার্থী সুশীল রুদ্রকে বঞ্চিত করে এণ্ড্রুজকে অধ্যক্ষ নির্বাচন করেছেন। সুশীল খ্রিস্টান হওয়া সত্ত্বেও তাঁর অপরাধ তিনি ভারতীয়, ‘কালা আদমি’। চরম প্রতিবাদ করেছিলেন এণ্ড্রুজ। সুশীলকে অধ্যক্ষ পদে সম্মানিত করে তিনি প্রমাণ করেছিলেন, একজন ইংরেজ হিসেবে নয়, তিনি মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে এসেছেন।

ভারতে ইংরেজ-শাসনের স্বরূপ প্রত্যক্ষ করে তিনি বিদ্রোহী হয়ে উঠেছেন বারে বারে। সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা, বিদেশি মিশনের কর্মপদ্ধতির বিরুদ্ধে বারবার সোচ্চার হয়েছেন তিনি। স্বজাতির ঔদ্ধত্য, শোষণ তাঁকে পীড়িত করেছে। খ্রিস্টভক্ত এই মানুষটি উপলব্ধি করলেন যে, ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষ যে পথ ধরে চলছে সে পথ সঠিক পথ নয়। খ্রিস্টানদের প্রদর্শিত পথে ভারতীয় জীবনধারার সঙ্গে নিজেকে ওতপ্রোতভাবে মেলাতে চেয়েছেন। সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ‘ভারতবাসীর সঙ্গে একপ্রাণ একাত্মা আমাকে হতে হবে— বিদেশি বলে দূরে থাকলে চলবে না’।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচিত হয়ে দুজনেই দুজনের মধ্যে আবিষ্কার করলেন সেই মানবধর্ম। কবিকে আপন করে নিলেন এণ্ড্রুজ। রোদেনস্টাইনের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথকে দেখে তিনি লিখছেন, ‘সেইদিনই রাত্রে শয্যা গ্রহণের আগে একটি বিষয়ে আমি স্থিরনিশ্চয় হলাম, কবি যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি তাঁর শান্তিনিকেতন আশ্রমে স্থান নেব। শান্তিনিকেতনের পটভূমিকায় ভারত মহাদেশের বৈচিত্র্য আমার কাছে ধরা দেবে।’

১৯১৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি এণ্ড্রুজ যখন শান্তিনিকেতনে এসেছেন, রবীন্দ্রনাথ তখন বিদেশে। রাত্রে রবীন্দ্রনাথকে একটি চিঠিতে লিখছেন, ‘আপনার পিতৃদেবের এবং আপনার সাধনসত্তার চেতনা আমাকে ব্যাকুল করে তুলেছিল। আপনার জীবন্ত উপস্থিতি আমি প্রতিদিনই আশ্রমে অনুভব করেছি . . .।’ দিল্লি থেকে ৮ মার্চ তিনি আবার কবিকে লিখছেন, ‘আপনার বন্ধুত্বে আমার দাবি আছে। তাই আপনার সাহায্য আমার চাই। শুধু আপনার সঙ্গে এমনকী আশ্রমে— যেখানে আপনার প্রাণ ছড়ানো রয়েছে— সেখানেও যদি থাকতে পাই, তবে তাই হবে আমার প্রকৃত শিক্ষার সহায়। বুঝতেই পারছেন আপানাকে আমার যথার্থ গুরু বলে আমি বরণ করেছি, যত অযোগ্যই হই না কেন— তবু আমি আপনারই একজন শিষ্য।’

ইতিমধ্যেই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দলে যুক্ত হয়েছেন এণ্ড্রুজ। মাদ্রাজের তুলো-শ্রমিকদের ধর্মঘটের সমাধানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিলেন তিনি। শান্তিনিকেতন-বাসের ইচ্ছা প্রবল হলেও গোপালকৃষ্ণ গোখলের অনুরোধে ১৯১৪ সালের শুরুতেই তাঁকে যেতে হল ডারবান। দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসকারী ভারতীয়দের উপর নিপীড়নের প্রতিবাদে তখন শুরু হয়েছে সত্যাগ্রহ আন্দোলন। আর সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আর এক ভারতীয়। তিনি মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। এণ্ড্রুজের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটল আরেক অগ্নিস্ফুলিঙ্গের। তিনি মহাত্মা প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘ওই আকাশের তারকাকুল যেমন সত্য, ওই নিত্যস্থায়ী পর্বতমালা যেমন সত্য, তেমনি অবিনশ্বর চিরন্তন চির নূতন সত্যের মূর্ত প্রকাশ মহাত্মা গান্ধী।’

সত্যাগ্রহ সফল করার জন্য অসুস্থতার মাঝেও এণ্ড্রুজ অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। তাঁরই চেষ্টায় জেনারেল ইয়ান ক্রিশ্চিয়ান স্মুট এর সাথে গান্ধীজির চুক্তি সম্পন্ন সম্ভব হয়েছিল। আর ঠিক সেই সময় তাঁর মা মরণাপন্ন জেনেও গান্ধীজিকে একা ফেলে এণ্ড্রুজ ইংল্যান্ডে যান নি। ভগ্ন শরীর ও মায়ের মৃত্যুতে ব্যথিত হৃদয় নিয়ে ভারতে ফিরে এসে শুনলেন এদেশের অনেকে তাঁকে ‘বৃটিশের চর’ বলতে কুন্ঠাবোধ করেনি। তা সত্ত্বেও ভারতবর্ষের প্রতিটি আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর যোগ ছিল অসীম। দেশটিকে আর দেশবাসীকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছিলেন ‘ভারতবন্ধু’ এণ্ড্রুজ।

দিল্লির অধ্যাপনা ছেড়ে শান্তিনিকেতনে এসে এণ্ড্রুজ পেলেন তাঁর প্রাণের আরাম, আত্মার শান্তি। তাঁর আশ্রমিক জীবন নিয়ে সেই সময়কার এক আশ্রমবাসী লিখছেন, ‘খালি পা, পরনে খাটো খদ্দরের ধুতি, গায়ে হাতকাটা পাঞ্জাবি, সাদা দাড়িগোঁফ, মুখে সরল হাসি— তিনি হনহন করে চলেছেন কাঁকরঢালা রঙা রাস্তায়’। ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রতি তাঁর অবিচল নিষ্ঠা দেখে পণ্ডিত বিধুশেখর শাস্ত্রী স্বয়ং এণ্ড্রুজকে ‘ব্রাহ্মণ’ বলে অভিহিত করেছেন।

বর্ণবৈষম্য জাতিভেদ সম্প্রদায়গত অনৈক্যের বিরুদ্ধে তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন। শক্তিমান ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, পক্ষ নিয়েছেন দীনদরিদ্রের। শুধু ভারতে নয় বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয়ের সাহায্যে ছুটে গিয়েছেন। সবরমতি, সেবাগ্রাম, হংকং, মালয়, মরিশাস, ফিজি— সব জায়গায় তাঁর ডাক পড়েছে। ফিজিতে প্রবাসী ভারতীয় শ্রমিকরাই ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম এন্ড্রুজকে ‘দ্য ফ্রেন্ড অব দ্য পুওর’ বা ‘দীনবন্ধু’ আখ্যায় সম্মানিত করেন।

ভারতে বৃটিশ শাসনের সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায় ছিল ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ এপ্রিলের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড। সেসময় তিনি শান্তিনিকেতনে ছিলেন। নিপীড়িত, দুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বৃটিশ সরকার তাঁকে অনুমতি দেয়নি। পরে সামরিক শাসন তুলে নেওয়ার পরই ছুটে গিয়েছেন সেখানে। কংগ্রেসের অনুসন্ধান কমিটির পক্ষে পাঞ্জাবের শহরে গ্রামে দিনরাত ঘুরে সংগ্রহ করেছেন সাক্ষ্যপ্রমাণ। ইংরেজের এই অপকর্মের জন্য সকল ভারতবাসীর কাছে তিনি ক্ষমা ভিক্ষা করেছিলেন। অথচ একদিকে স্বজাতি ইংরেজদের কাছ থেকে পেয়েছেন অবজ্ঞা আর অপমান, আবার কিছু ভারতবাসী ফিরিয়ে দিয়েছেন সংশয় আর সন্দেহ। রবীন্দ্রনাথ ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে লেখেন, ‘তাঁর মধ্যে যথার্থ ইংরেজকে যথার্থ খ্রীষ্টানকে যথার্থ মানবকে বন্ধুভাবে অত্যন্ত নিকটে দেখবার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।’

কবিগুরুর শান্তিনিকেতন ছিল তাঁর আপনগৃহ, মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসে ছিলেন শান্তিনিকেতনকে। অভিনয়ের প্রতি তাঁর ছিল বরাবরের দুর্বলতা। শান্তিনিকেতনে তিনিই প্রথম শেক্সপীয়ারের নাটক ‘ওপেন স্পেস থিয়েটার’-এর আঙ্গিকে অভিনয় করান। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠাকালে এন্ড্রুজ হয়েছিলেন প্রথম উপাচার্য। বিশ্বভারতীতে হিন্দি ভবনটি তাঁর সাহায্যেই খোলা হয়।

সে এক শ্রাবণদিন। কবিকে এণ্ড্রুজ শোনাচ্ছেন একটি গ্রিক কবিতা। তার ছন্দ-মাধুর্যে আপ্লুত কবি লিখে দিলেন ‘গীতালি’ কাব্যগ্রন্থের এই কবিতাটি . . .

‘দুঃখের বরষায় চক্ষের জল যেই নামল
বক্ষের দরজায় বন্ধুর রথ সেই থামল . . .’

বন্ধু এণ্ড্রুজ, রবীন্দ্র-সুহৃদ ১৯১৪ সালের এপ্রিলে যোগ দিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে।  ১৫ এপ্রিল নববর্ষের দিন কবি আম্রকুঞ্জের সংবর্ধনাসভায় সদ্য প্রকাশিত ‘উৎসর্গ’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করলেন এণ্ড্রুজকে। বিদেশি সখাকে অভিবাদন করে কাব্যছন্দে যা বলেছিলেন, সেটিই এই ভারত-পথিকের জন্য ভারতবাসীর শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধার্ঘ্য।

‘প্রতীচীর তীর্থ হতে প্রাণরসধার
হে বন্ধু এনেছ তুমি, করি নমস্কার।
প্রাচী দিল কণ্ঠে তব বরমাল্য তার
হে বন্ধু গ্রহণ করো, করি নমস্কার।
খুলেছে তোমার প্রেমে আমাদের দ্বার
হে বন্ধু প্রবেশ করো, করি নমস্কার।
তোমারে পেয়েছি মোরা দান রূপে যাঁর
হে বন্ধু চরণে তাঁর করি নমস্কার।’

দীনবন্ধু এণ্ড্রুজ (১৮৭১-১৯৪০)