Categories
ভাষাপুকুর |

নাথ-সাহিত্য

3021 |
Share
| ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০
বিজনবিহারী ভট্টাচার্য

বাংলা সাহিত্যের স্বনামধন্য অধ্যাপক। ১৯৬৬-৭১, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রতীকচিত্র: সৌভিক গুহসরকার; চিত্র সৌজন্য: এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা

আমাদের প্রাচীন সাহিত্যের সঙ্গে ধর্মের যোগ খুব ঘনিষ্ঠ। এক এক ধর্মসম্প্রদায় বা ধর্মবিশ্বাস নিয়ে এক এক জাতীয় সাহিত্য গড়ে উঠেছে; যেমন— বৈষ্ণব পদাবলি, শাক্ত পদাবলি, বাউল গান ইত্যাদি। এরকমই সাহিত্যের আর একটি শাখা নাথ সাহিত্য নামে পরিচিত। বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে শৈবধর্ম মিশে নিরীশ্বর যৌগিক ধর্মসাধনার একটা ধারা একসময় এদেশে বিশেষ প্রসার লাভ করেছিল। এই ধারার প্রথম প্রবর্তক মৎসেন্দ্রনাথ বা মীননাথ। এই ধর্মমতের সব আচার্যই নামের সঙ্গে নাথ শব্দ যোগ করতেন, যেমন— মীননাথ, গোরক্ষনাথ, চৌরঙ্গীনাথ। এই কারণেই এঁদের প্রবর্তিত এবং আচরিত সাধনপন্থা ‘নাথ-ধর্ম’ নামেই প্রচারিত হয়েছে। দশম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত নাথ ধর্মের বিশেষ প্রতিপত্তি ছিল। ‘নাথ-সাহিত্যের’ও উদ্ভব ওই সময়ই হয়েছিল।

নাথ-ধর্ম এখন বিলুপ্তপ্রায়। যুগী (যোগীর রূপান্তর) প্রভৃতি দুই-একটা জাতির সাথে প্রাচীন নাথ-সম্প্রদায়ের একটা ঐতিহাসিক যোগসূত্র পাওয়া যায়, তবে সে সূত্রও ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে এসেছে। নাথ-ধর্মের ইতিহাস এখন কেবল তার সাহিত্য আশ্রয় করেই বেঁচে আছে। সেই সাহিত্যকেই নাথ-সাহিত্য বলছি।

নাথ-সাহিত্যের প্রধান অবলম্বন দু’টি কাহিনি— (১) গোরক্ষবিজয়- কাহিনি এবং (২) ময়নামতী-গোবিন্দচন্দ্রের কাহিনি। এই দু’টি গল্পের মধ্যে দিয়ে নাথ-গুরু ও আচার্যদের অলৌকিক শক্তির পরিচয় পাওয়া যায় এবং তাঁদের ধর্মসাধনার মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে। প্রাচীন বাংলার সব সাহিত্যই ধর্ম-সাহিত্য এবং অধিকাংশ ধর্ম-সাহিত্যেরই প্রতিষ্ঠা কোনও না কোনও উপাখ্যানের উপর। নাথ-সাহিত্যও এর ব্যতিক্রম নয়।

নাথ সাহিত্যের পুঁথি যে-ক’টা পাওয়া গেছে, তার কোনওটাই খুব প্রাচীন নয়। আর ওই পুঁথির ভাষা দেখেও রচনার কাল নির্ণয় করা কঠিন। শুধু এইটুকু বলা যায় যে, রচনা যতই নতুন হোক না কেন কাহিনির বিষয়বস্তু নতুন নয়।

গোরক্ষবিজয়-কাহিনি

মীননাথ নাথ-সম্প্রদায়ের প্রধান গুরু। একদিন ক্ষিরোদসাগরে বসে গৌরী মহাদেবের থেকে মহাজ্ঞান তত্ত্ব শুনছিলেন। মহাজ্ঞান জানলে জন্মমৃত্যুর রহস্য জানা যায়, এমনকি মৃত্যুকেও এড়ানো যায়। হরগৌরীর তত্ত্বালোচনাকালে মীননাথ জলের মধ্যে বসে তপস্যা করছিলেন, তাই তিনিও মহাজ্ঞান শিখে ফেললেন। শিব সেটা জানতে পেরে রেগে গিয়ে অভিশাপ দিলেন— সন্ন্যাসী মীননাথ সন্ন্যাস-ধর্ম থেকে ভ্রষ্ট হয়ে গৃহস্থের মতো সংসারের ভোগসুখে মগ্ন হয়ে যাবেন। আর চুরি করে যে মহাজ্ঞান শিখলেন, তাও তিনি ভুলে যাবেন।

এই অভিশাপে ভয় না পেয়ে মীননাথ দেশে দেশে ধর্মপ্রচার করে বেড়াতে লাগলেন। তাঁর অনেক ভক্ত হল, অনেকে আবার তাঁর শিষ্য হয়ে তাঁর কাছে মহাজ্ঞান শিখলেন। শিবের অভিশাপ সফল হল না দেখে পার্বতী একদিন ছলনা করে তাঁর মহাজ্ঞান চুরি করে নিলেন এবং তাঁকে কদলীপত্তনে পাঠিয়ে দিলেন। কদলীপত্তন নারীরাজ্য। সেই রাজ্যের রানির সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়ে গেল, আর সব শক্তি হারিয়ে মীননাথ সেখানে সংসারী হয়ে রয়ে গেলেন।

গোরক্ষনাথ মীননাথের প্রধান শিষ্য, মহাজ্ঞান শিখে তিনিও অলৌকিক শক্তির অধিকারী হয়েছেন। গুরুর থেকেও তাঁর শক্তি ছিল বেশি। তাই পার্বতী ছলনা করে গুরুকে ভোলাতে পেরেছিলেন, কিন্তু শিষ্যের কাছে তাঁকেই হার মানতে হয়েছিল। গুরুর দুর্দশার কথা গোরক্ষনাথের কানে এসে পৌঁছলে কদলীপত্তনে গিয়ে তাঁকে উদ্ধার করে আনবার জন্য তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কদলীপত্তনে আবার পুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ; তাই তিনি নর্তকীর বেশ ধারণ করে সেখানে প্রবেশ করলেন।

নর্তকী দেখে সেখানে নৃত্যগীতের আয়োজন হল। রাজারানি সভায় এসে বসলে গোরক্ষনাথ—

ডিমিকি ডিমিকি করি মাদলে দিল হাত।

মাদলের সেই আওয়াজ শুনে—

লোমাঞ্চিত হৈয়া বৈসে রাজা মীননাথ।।
নাচন্ত গোর্খনাথ তালে করি ভর।
মাটিতে না লাগে আলগ উপর।।
নাচন্ত যে গোর্খনাথ ঘাগরের রোলে।
কায়া সাধো কায়া সাধো মাদলে হেন বলে।।

‘কায়া সাধো’ মানে দেহ পরিশুদ্ধ কর এবং সেই শুদ্ধিপ্রাপ্ত দেহ দ্বারা ধর্ম সাধনা কর।

নাচয়ে গোরক্ষনাথ নুপুর রুনুঝুনু।
শুনিয়া যে মীননাথ পুলকিত তনু।।

শিষ্যের মাদলের বোলে, নুপুরের রোলে মায়াচ্ছন্ন গুরুর মোহমুক্তি হল। শাপগ্রস্ত মীননাথ শিষ্যের ভক্তি ও শক্তিবলে পুনরায় চৈতন্যলাভ করলেন। তাই গোরক্ষবিজয়ের আর এক নাম মীনচেতন।

ময়নামতী-গোবিন্দচন্দ্র কাহিনি

রাজা গোবিন্দচন্দ্র বা গোপীচাঁদ এবং তাঁর মহাজ্ঞানসিদ্ধা জননী ময়নামতীর কাহিনি অবলম্বনে রচিত যে ক’টা পুঁথি পাওয়া গেছে সেগুলো ‘মাণিকচন্দ্রের গান’ অথবা ‘ময়নামতীর গান’ অথবা ‘গোপীচন্দ্রের গান’ নামে পরিচিত। কাহিনিটি এইরকম—

প্রায় ন’শো বছর আগে বিক্রমপুরের রাজা ছিলেন মাণিকচাঁদ, তাঁর স্ত্রীর নাম ময়নামতী। ময়নামতী গুরু গোরক্ষনাথের শিষ্য হয়ে তাঁর কাছে মহাজ্ঞান শিখে ফেললেন। জরা, মৃত্যু, ব্যাধি তখন তাঁর হাতের মুঠোয়। স্বয়ং যমরাজ খত লিখে দিলেন, তাঁর শরীর আগুনে দগ্ধ হবে না, জলে ডুববে না, অস্ত্রে বিদ্ধ হবে না। একদিন ময়নামতী ধ্যানে বসে জানতে পারলেন তাঁর স্বামীর আয়ু শেষ হয়ে আসছে। তখন তিনি মাণিকচাঁদকে আড়ালে ডেকে মহাজ্ঞান শিক্ষা নিতে অনুরোধ করলেন। মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে হলে আর কোনও উপায় নেই। এই শুনে মাণিকচাঁদের পৌরুষে আঘাত লাগল—প্রাণ যায় যাক, তবু স্ত্রীর শিষ্য তিনি কোনও মতেই হবেন না। হিমালয়ের মতো অটল মানিকচাঁদ দৃঢ়কণ্ঠে উত্তর দিলেন,

এমনি যদি আমার প্রাণ যায় ছাড়িয়া।
তবু তো মাইয়ার জ্ঞান না নিব শিখিয়া।।

ময়না বুঝলেন বিধাতার নির্দেশ খণ্ডিত হবার নয়। মাণিকচাঁদের মৃত্যু হল। পুত্র গোবিন্দচন্দ্র তখনও নিতান্ত বালক বলে রানি স্বহস্তে রাজ্যভার গ্রহণ করলেন। ইতিমধ্যে রাজকুমারের বিবাহ হল; এক এক করে চারজন বৌমা ঘরে আসল—অদুনা, পদুনা, রতনমালা, কাঞ্চাসোনা—সকলেই অপরূপ রূপলাবণ্যবতী। হাসিখেলার মধ্যে দিয়ে রাজকুমার কৈশোরে পা দিলেন।

এদিকে গোপীচাঁদের গ্রহ প্রতিকূল ছিল। ময়না জানতেন উনিশ বছরে পড়লেই তাঁর মৃত্যু হবে। তবে যদি তিনি বারো বছরের জন্য গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হন এবং সিদ্ধা হাড়িপাকে গুরু করে তাঁর কাছে মহাজ্ঞান শিক্ষা করেন, তবে তিনি মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাবেন। হাড়িপাও গোরক্ষনাথের শিষ্য, যে সম্পর্কে ময়নার গুরুভাই। গোপীচাঁদ মায়ের কাছে সব কথা শুনে খুশি হলেন না। হাড়িপা জাতিতে হাড়ি, তাঁর কাছে দীক্ষা নিতে গোপীচাঁদের আত্মসম্মানে লাগল। তাছাড়া বারো বছরের বনবাসেও তাঁর ঘোরতর আপত্তি, রাজবধূদের আপত্তি প্রবলতর। রানিদের মধ্যে যুক্তি-পরামর্শ চলতে লাগল। অবশেষে—

অদুনায় বলে বৈন গো পদুনা সুন্দর।
সাত কাইড়ের‌ বুদ্ধি আমার ধরের ভিতর।।

এই শুনে সকলে তার কথা মতো গোপীচাঁদের কাছে এসে অনেক করে বোঝাল। শাশুড়ি ঠাকুরানির উদ্দেশ্য সম্পর্কেও তারা দুই-চারটে ইঙ্গিত করতে ছাড়ল না। তারা বলল,

তোমার মায়ের কথা নির্ণয় না জানি।
হেঁটে গাছ কাটিয়া উপরে ঢালে পানি।।

বনবাসে প্রেরণ করাই যদি তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল তবে এতগুলো রাজকন্যার সঙ্গে বিবাহ দিলেন কেন? গোবিন্দ বললেন, বটে

না যাইব না যাইব প্রিয়া দেশ-দেশান্তর।
সুখে রাজ্যে করিব থাকিয়া নিজঘর।।

কিন্তু মায়ের কথাই শেষ পর্যন্ত মানতে হল। মা যে তাঁর কল্যাণের জন্য তাঁকে গৃহত্যাগী করছেন একথা বুঝতে পেরে হাড়িপার চরণে প্রণত হয়ে বললেন—

তোমার চরণে গুরু সেবা দিনু আমি।
এ তব তরিতে জ্ঞান মোরে দেহ তুমি।।

তারপর বারো বছর ধরে কঠিন সাধনা চলল। শিষ্যকে মহাজ্ঞানের উপযোগী করার জন্য তাঁকে নানাভাবে পরীক্ষা করতে লাগলেন। গোপীচাঁদ সমস্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গুরুর আশীর্বাদ নিয়ে বারো বছর পরে ঘরে ফিরে এসে মায়ের পদধূলি নিলেন। রাজ্যে সেদিন আনন্দ উৎসব শুরু হয়ে গেল।

ঋণ: শিশুসাথী, ১৯৫৮। চলিত করেছেন জয়তী ভট্টাচার্য।