Categories
প্রকৃতির ডাকঘর |

নীলকন্ঠ পাখির কথা

367 |
Share
| ১৮ জানুয়ারী, ২০২৩
সুপ্রিয়া সরকার

প্রকৃতি সংসদের সদস্যা

চিত্রঋণ: Clement Francis

কৈলাসে পার্বতীর আগমনী বার্তা বয়ে নিয়ে যাওয়া পাখিটির নাম নীলকন্ঠ। একে দেবাদিদেব মহাদেবের দোসর বলে মনে করা হয়। বিজয়া দশমীর দিন নীলকন্ঠ পাখি ওড়ানোর প্রথা বহু প্রাচীন। মহাদেবের বিষ পান করবার মতন কৃষি জমির পক্ষে ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ অজস্র পরিমাণে খেয়ে কৃষকদের পরম উপকার করে এই নীলকন্ঠ পাখি।

পাখিটি আকারে পায়রার মতন। উজ্জ্বল নীল আর মরচে বাদামি মেশানো গায়ের রঙ, বড়সড় মাথা এবং ভারী ঠোঁট। মাথার চাঁদি নীলচে সবুজ, ঘাড় গাঢ় খয়েরী। শরীরের উপরের পালক ফ‍্যাকাসে, সবজেটে পাটকিলে। বুক হালকা গোলাপি আভাযুক্ত খয়েরী রঙ তার ওপর সাদা সাদা ছিট আছে । পেটের কাছ থেকে লেজের গোড়া ফিকে নীল।

মাথার দুপাশ ও গলা বেগুনি আভাযুক্ত খয়েরী তার ওপর সাদার ছিট আছে। ডানা নীল আর সবুজে মেশানো। ডানার পালক আর লেজে গাঢ় নীলচে বেগুনি আর তুঁতে নীলের পটি আছে ওড়বার সময় লেজ ও ডানার নীলের এই পটি দুটি উজ্জ্বল এবং অপূর্ব লাগে ।

ঠোঁট কালচে পাটকিলে , পা পাটকিলে হলুদ । পায়ের প্রথম তিনটি আঙুল গোড়ার প্রান্তে একে অপরের সাথে জোড়া । চোখের চারপাশের গোলাকার স্থানটি সবজেটে হলুদ।

স্ত্রী এবং পুরুষ পাখি দুটি একই রকম দেখতে। অপরিণত পাখিটির রঙ অপেক্ষাকৃত ফ‍্যাকাসে এবং পিঠের ওপরের রঙ হালকা বাদামী, ঘাড় ও গলার ছিটগুলি অনেক ঘন।

আবাসস্থল: নীলকন্ঠ পাখি এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সর্বত্রই এদের দেখা যায়। মোটামুটি ভাবে ১৫০০ মি. উচ্চতার মধ্যে এদের পাওয়া যায়।

বিচরণক্ষেত্র: নীলকন্ঠ পাখি বেশিরভাগ খোলামেলা জায়গা, চাষের জমি ও ধানক্ষেতের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে। এছাড়া আমবাগান, গ্ৰামের খোলামেলা জায়গার গাছপালায় অথবা হালকা জঙ্গলেও এদের দেখা যায়। ঘন জঙ্গল অথবা লোকালয় এদের পছন্দ নয়।

স্বভাব: এরা সাধারণত একা অথবা জোড়ায় থাকে। টেলিগ্ৰাফের তার, লম্বা বাঁশের উঁচু খুঁটি, শুকনো গাছের উঁচু ডাল, চষা ক্ষেতের ভেতর জমে থাকা মাটির স্তূপ অথবা কাঁটা গাছের ঝোপের উপর চুপচাপ বসে লেজটা প্রায় খঞ্জন অথবা বাঁশপাতির মতন ওপর নীচ করে নাড়াতে থাকে আর বড় বড় চোখে শিকারের খোঁজে চারপাশে নজর রাখে। মাটিতে কোনো পোকামাকড় দেখতে পেলেই বিদ‍্যুৎ গতিতে উড়ে গিয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে তারপর ছোঁ মেরে সেটিকে মুখে তুলে নিয়েই আবার সেই উঁচু জায়গাতে গিয়েই বসে তারপর পোকাটিকে থেঁতলে মেরে খেয়ে ফেলে। খাওয়া সেরে নিয়ে আবার একদৃষ্টে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে, ঠিক যেমন করে মাছরাঙা তাকিয়ে থাকে জলের দিকে।

নীলকন্ঠ পাখির ডাকটি বেশ কর্কশ এবং জোরালো ‘চেক চেক চেক চেক’। তীব্র কর্কশ ডাকের সাথে হঠাৎ করে বাতাসে ভর দিয়ে, মুখটি নীল আকাশের দিকে তুলে সোজা ওপরে উড়ে গিয়ে আকাশে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন দোল খেতে খেতে ডিগবাজি খায়। কয়েকবার ডিগবাজি খেয়েই মাটির দিকে ঘুরে ঘুরে নামতে থাকে। এই সময় লেজ ও ডানার পটি দুটি সূর্যের আলোয় ঝকঝক করতে থাকে, সে এক অপরূপ দৃশ্য ।

খাদ্য: নানারকম ছোটবড় কৃষির অপকারী কীটপতঙ্গ, ফড়িং, উচ্চিংড়ে, ঝিঁঝিঁপোকা, গুবরে ও শুঁয়োপোকা এবং এদের শূককীট। সময় বিশেষে টিকটিকি, গিরগিটি, ব‍্যাঙ, মেঠো ইঁদুর, বিছে ও ছোট সাপ। এছাড়া শূন্য থেকে ঝাঁপ দিয়ে মথ, ডানা ওঠা পিঁপড়ে অথবা মৌমাছিও ধরে খায়।

বাসা ও ডিম: মার্চ থেকে জুলাই মাস এদের বাসা বানানোর আর ডিম পাড়বার সময়। প্রাকৃতিক কারণে হওয়া কোনও মরা গাছের গর্তে, কাঠঠোকরার পরিত্যক্ত কোটরে অথবা নেড়া খেজুর নারকেল বা তালগাছের মাথায় এরা বাসা বানায়। এদের বাসা সাধারণত এলোমেলো আর অগোছালো ধরনের হয়। নানারকমের আবর্জনা, ঘাস, খড়, পালক, ছেঁড়া ন‍্যাকড়া এই সব দিয়ে বাসা বানানো হয়। ভাঙা বাড়ির কার্নিশের তলায় অথবা দেওয়ালের গায়ের গর্তেও এদের বাসা বানাতে দেখা যায়। কোনোরকমে উপকরণগুলি গর্তের মধ্যে রাখে আর তার উপর ডিম পাড়ে। এদের সাধারণত তিনটি থেকে চারটি অথবা কখনো কখনও পাঁচটি ডিমও পাড়তে দেখা যায়। ডিমগুলি শক্ত খোলার, চকচকে ও ধবধবে সাদা হয়। ডিমের গড় মাপ লম্বায় ১.৩০ ইঞ্চি ও চওড়ায় ১.০৫ ইঞ্চি। ডিম ফুটে ছানা বার হতে ১৭ থেকে ১৯ দিন সময় লাগে। স্ত্রী ও পুরুষ দুজনেই ডিমে তা দেয় এবং বাসা তৈরি ও বাচ্চা প্রতিপালনের কাজে দুজনেই পরস্পরকে সাহায্য করে।