বাড়ির সামনের ঝাঁকড়া গাছের ডালপালার আড়ালে বেশ অনেক্ষণ ধরে বসে আছে একটি ছোট পাখি। পাতার আড়ালে লুকিয়ে চুপচাপ বসে থাকে, ভালো করে দেখতে পাইনা। হঠাৎ এক উজ্জ্বল নীলের ঝলক, গাছের ডাল থেকে বিদ্যুৎ গতিতে মাটিতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে ঘাসের উপর থেকে ঠোঁটে করে কিছু একটা নিয়েই আবার গাছের ডালে গিয়ে বসে। এবার একটু খোলা মেলা জায়গায় একটা সরু ডালের উপর এসে বসে। পিঠ লেজ ও ডানা ধাতব উজ্জ্বল নীল তার ওপর সবুজের আভা। মাথা ঘাড় ও তলপেট গাঢ় বাদামী। গলা থেকে বুক অবধি ধবধবে সাদা, দেখে মনে হয় সাদা জামা পরে আছে। লাল রঙের ঠোঁটটি বেশ লম্বা এবং ছুঁচোলো, পায়ের রঙ লাল। এটি একটি সাদা-বুক মাছরাঙা। White Throated Kingfisher (২৭-২৮ সেমি)। বৈজ্ঞানিক নাম Halcyon smyrnensis। এটি পশ্চিমবাংলার রাজ্যপাখি। স্ত্রী এবং পুরুষ পাখি দুটি একই রকম দেখতে। সামনে তাকিয়ে দেখি পাখিটি গাছের ডালে বসে ঝুলন্ত লেজটিকে এদিক ওদিক দোলাচ্ছে আর সেই ছন্দে মাথাটাও ওপর নিচ, সামনে পেছন করে নাড়াচ্ছে। হঠাৎ স্থির হয়ে মাথা নিচু করে মাটির দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে আর তার পরই ঝপ্ করে মাটিতে নেমে ঠোঁটে করে একটা ফড়িং জাতীয় কিছু ধরেই আবার উড়ে গিয়ে গাছের ডালে বসে। ওড়বার সময় দুটি ডানার নিচে দুটি সাদা ছোপ দেখা যায়। মাছরাঙাটির পায়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় আঙুল অংশত জোড়া। আশেপাশে ডোবা বা পুকুর জাতীয় কোনো জলের জায়গা না থাকা সত্ত্বেও মাছরাঙাটি প্রায় সারাদিনই এখানে ঘোরাঘুরি করে আর মাটি থেকে ঝাঁপ দিয়ে বড়সড় ফড়িং জাতীয় পোকামাকড়, টিকটিকি, গিরগিটি, ব্যাঙ এইসব ধরে খায়।
আবাসস্থল: মাছরাঙাদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত অথবা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এই সাদা-বুক মাছরাঙাটিকে। এটি এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সর্বত্রই এদের দেখা যায়।
বিচরণ ক্ষেত্র: মানুষের বাসস্থানের কাছে অথবা অনেক দূরেও এই সাদা-বুক মাছরাঙাদের দেখা যায়। জলে ডোবা ধানক্ষেত, পুকুর, ডোবা বা কাঁচা কুয়োর আশেপাশে এছাড়া সমুদ্রের আশেপাশেও এদের দেখা মেলে। এই মাছরাঙাটি সর্বদা জলের উপর নির্ভরশীল নয় কারণ মাছই এদের একমাত্র খাদ্য নয়। তাই জলের থেকে অনেক দূরে, হালকা জঙ্গলের গা ঘেঁষে অথবা শহরের বড় বড় বাগানেও এরা থাকে।
স্বভাব: এরা সাধারণত একা অথবা জোড়ায় থাকে। প্রতিটি সাদা-বুক মাছরাঙার খাদ্য সংগ্ৰহের একটি নিজস্ব এলাকা থাকে যেখানে অপর কোনো মাছরাঙার প্রবেশাধিকার নেই। নিজস্ব এলাকা সম্বন্ধে এরা খুবই সচেতন। গাছের ডালে, টেলিগ্ৰাফের তারে অথবা উঁচু খুঁটির উপর বসে লেজটি দোলায়, সেই সঙ্গে মাথাটিও ওপর-নিচ করে। এই ভাবেই একদৃষ্টে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে শিকার ধরবার জন্য। কিছু পোকামাকড় ইত্যাদি পেলেই ঝাঁপ দিয়ে পড়ে সেটিকে তুলে নিয়েই আবার ওপরে গিয়ে বসে। এদের ডাকটি একটি উচ্চস্বরের কর্কশ হাসির মতন ক্যা-ক্যা-ক্যা-ক্যা-ক্যা। তবে ‘কিলিলিলিলি’ করে একটি মিষ্টি ডাকও রয়েছে। অনেক সময় গাছের উঁচু ডালে বসে শিস দেবার মতন করে অনেক্ষণ ধরে ডাকে।
খাদ্য: অন্যান্য মাছরাঙাদের মতো জলের ধারে থেকে এরা কেবল মাছ ধরেই খায় না, ঝিঁঝিঁ পোকা, ফড়িং, পিঁপড়ে উই, তেঁতুলেবিছে ইত্যাদি পোকামাকড় এছাড়া ব্যাঙ, ব্যাঙাচি, টিকটিকি, গিরগিটি, ইঁদুর, ছোটখাটো দুর্বল ও অসুস্থ ছানা পাখি ইত্যাদি সবই এদের খাদ্য। এমনকি উড়ন্ত অবস্থাতে কীটপতঙ্গও ধরে থাকে। তবে মাঝে মাঝে অন্যান্য মাছরাঙাদের মতন জল থেকে মাছ ধরেও খায়। জলের মধ্যে কাঁকড়া পেলেও ছাড়ে না, ডাঙায় এনে ঠুকে ঠুকে থেঁতো করে খায়।
বাসা ও ডিম: সাধারণত জানুয়ারি থেকে অগাস্ট মাসের মধ্যে এরা বাসা বানায় আর ডিম পাড়ে, তবে এপ্রিল থেকে জুলাই মাসই প্রশস্ত সময়। শুকনো নালার খাড়া পাড়ে, রাস্তা বানানোর জন্য খাড়া মাটির দেওয়ালের গায়ে, খানাখন্দের গায়ে, কাঁচা কুয়োর খাড়া দেওয়ালে এরা সুড়ঙ্গ কেটে বাসা বানায়। সুড়ঙ্গের মুখের ব্যাস প্রায় ৩ ইঞ্চি, লম্বায় ৬-৭ ফুট। বাসায় ঢোকবার মুখ থেকে সুড়ঙ্গটি সামান্য ওপর দিয়ে উঠে শেষকালে একটি ডিম পাড়বার ঘর থাকে। ডিম ঘরে কোনও আস্তরণ নেই, কেবল দুর্গন্ধময় কাঁটা ও ছোটখাটো হাড়গোড়ে পরিপূর্ণ। এই ডিম ঘরে এরা ৪টি থেকে ৭টি ধবধবে সাদা প্রায় গোলাকার ও শক্ত খোলার ডিম পাড়ে। বাসা বানানো থেকে বাচ্চা প্রতিপালনের সব দায়িত্ব স্ত্রী ও পুরুষ পাখি সমানভাবে পালন করে।
ঋণ: The Book of Indian Birds, Salim Ali; চেনা অচেনা পাখি, অজয় হোম; অপূর্ব চক্রবর্তী (প্রকৃতিবিদ)