এক যে ছিল রাজা, তাঁর ছিল চার মেয়ে। রাজা একদিন তাঁর মেয়েদের জিজ্ঞাসা করলেন— ‘তোমরা আমায় কেমন ভালবাস মা?’ বড় মেয়ে বলল বাবা, ‘আমি তোমায় ভালবাসি চিনির মতো।’ মেজ মেয়ে বলল, ‘বাবা, আমি তোমায় ভালবাসি মধুর মতো।’ সেজ মেয়ে বলল— ‘আমি তোমায় সরবতের মতো ভালবাসি, বাবা!’ আর সকলের ছোট্ট মেয়েটি দুষ্টু হাসি হেসে বলল— ‘সত্যি কথা বলছি বাবা, আমি তোমায় নুনের মতো ভালবাসি।’
ছোট মেয়ের কথা শুনে রাজা তো চটে গিয়ে বললেন— ‘আবার ভেবে চিন্তে বলো, তুমি আমায় কেমন ভালবাস!’ ছোট মেয়ের সেই এক কথা— ‘না বাবা, আমি ভেবে চিন্তেই বলছি— তোমাকে ঠিক নুনের মতোই ভালবাসি!’
রাজার হল ভয়ানক রাগ! চিনির মতো নয়, মধুর মতো নয়, সরবতের মতো নয়, একেবারে নুন! এমন দুষ্টু বেয়াদব মেয়েকে কক্ষনও রাজপুরীতে রাখতে নেই! রাজা দিলেন ছোট রাজকুমারীকে তাড়িয়ে একেবারে রাজধানীর বাইরের এক নিবিড় বনে।
ছোট রাজকুমারী এতে একটুকু বিচলিত হলেন না। তাঁর অন্তরে এই বিশ্বাস ছিল যে, সে তো আর মিথ্যা প্রবঞ্চনা করেনি— অন্তরে যা সত্য বলে মনে হয়েছে, সে-কথাই তো বলেছে।
নিবিড় বনপথ দিয়ে নির্ভীকভাবে ছোট রাজকন্যা যেতে লাগলেন। তখন সন্ধ্যা হয়-হয়, বেলা পড়ে এসেছে। ঘন বনের আড়াল দিয়ে সূর্যের শেষ আলো অতি ক্ষীণ রেখায় এসে বনের ভিতর পড়েছে! এমন সময় ঘোড়ার পায়ের শব্দ শোনা যেতে লাগল। রাজকন্যা ভয় পেলেন— কি জানি কোন দস্যু-ডাকাতের সঙ্গে দেখা হয়! না জানি হঠাৎ কোন বিপদ ঘটে! তাই ভয়ে ভয়ে একটা বড় গাছের কোটরের ভিতর রাজকন্যা লুকিয়ে রইলেন! আঁচল কিন্তু দুলতে লাগল বাইরে!
দস্যু নয়, ডাকাত নয়, সে পথ দিয়ে তখন শিকার করে ফিরে যাচ্ছিলেন সে দেশের তরুণ রাজা। হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ল, মস্ত বড় একটা গাছের কোটরের বাইরে সোনা-মানিকে ঝলমল— একখানি ময়ূরপঙ্খী আঁচল! রাজা ভাবলেন— এই গভীর বনের ভিতরে কার এ আঁচল দুলছে? দেখতে হচ্ছে! ঘোড়া থকে নেমে সেই গাছের কাছে এসে রাজা দেখলেন অপ্সরার মতো অপূর্ব্ব সুন্দরী এক মেয়ে! সারা বন, তার রূপে আলো হয়ে গেছে! রাজা রাজকন্যাকে সঙ্গে নিয়ে রাজধানীতে গেলেন, তারপর খুব ধূমধাম করে তাঁকে বিয়ে করলেন।
কতদিন পরে রাজকন্যার বাবা এলেন, এই রাজার দেশে বেড়াতে। এই দেশের রাজার বাবার সঙ্গে ছিল তাঁর বন্ধুত্ব! তিনি জানতেন না যে, তাঁরই ছোট মেয়ে এ রাজ্যের রানি।
রাজা খেতে বসেছেন। এ কী আশ্চর্য ব্যাপার। সব ব্যঞ্জনই রান্না হয়েছে চিনি মিশিয়ে আর মধু দিয়ে। রাজা এক একটি ব্যঞ্জনে মুখ দিচ্ছেন আর মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন— খেতে পারছেন না। মিষ্টি দিয়ে ব্যঞ্জন রাঁধে এ কী আজগুবি দেশ গো! মুখে কিছু বললেও পারছেন না লজ্জায়!— অথচ তাঁর ক্ষিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছে! কী জানি, যদি এ রাজ্যের এমন নিয়ম থাকে, তবে তো ভয়ানক অপমান হবে। কী যে করবেন ভেবে পাচ্ছেন না! এমন সময় এল এক থালা ভাত— আর ব্যঞ্জন— ব্যঞ্জন সবই নুন দিয়ে রান্না। রাজা এইবার মনের সুখে পেট ভরে খেলেন!— আরামের নিঃশ্বাস ফেললেন!
এইবার রাজকুমারী এসে দেখা দিল এবং পরিচয় দিয়ে বলল— বাবা আমি তোমার ছোট মেয়ে; আমি বলেছিলাম— তোমায় আমি ভালবাসি নুনের মত! বাবা! খাঁটি স্নেহ ও ভালবাসার মধ্যে বাইরের জাঁকজমক বা মিথ্যার ঠাঁই নেই— যা সত্য তা সহজ ভাবেই বেঁচে থাকে, মিথ্যা আসে অর্থহীন কথা নিয়ে! বাবা, পূর্বেও
যেমন বলেছি, এখনও তেমনই বলছি— আমি তোমাকে নুনেরই মতো ভালবাসি! চিনির মতোও নয়, মধুর মতোও নয়, সরবতেরও মতো নয়!
রাজা তাঁর ভুল বুঝতে পেরে নির্ব্বাক হয়ে রইলেন। মুখে তাঁর কথা নেই! বহুকাল পরে রাজা ও রাজকন্যার এই আশ্চর্য স্নেহময় মিলনে রাজবাড়ি উৎসব ও আনন্দে মেতে উঠল!— বল দেখি, তোমরা তোমাদের বাবা ও মাকে কেমন ভালবাস? মধু, চিনি, সরবতের মতো না নুনের মতো?
ঋণ: শিশুভারতী