Categories
ভাষাপুকুর |

পাঠশালার ছেলে স্কুলে

374 |
Share
| ২২ জানুয়ারী, ২০২২
গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য

দস্তুরমতো ইস্কুল। সে ইস্কুলে গুরুমশাই নেই, আছেন মাস্টারমশাইরা। পাঠশালার মতো চাটাই-এর ওপর বসতে হয় না, ইস্কুলের ছেলেরা বেঞ্চে বসে। আর মাস্টারমশাই বসেন চেয়ারে, তাঁর সামনে টেবিল। চাল্কী-বারাকপুর গাঁয়ের পাঠশালার গুরুমশাই তো মুদিখানার মাচাতে বসে তেল-নুন ওজন করেন। তাঁর হাতে কখনও দাঁড়িপাল্লা, কখনও প্রহারের দণ্ড। বনগ্রামের হাই স্কুলে এসব নেই— সেখানে এক-এক ঘরে এক-একটি শ্রেণি। প্রত্যেক শ্রেণিতে সব সময় একজন করে মাস্টারমশাই পড়ান। ঘন্টা বাজলেই একটা পিরিয়ড। . . . ছেলেটি চমকে উঠল। সে পথ চলতে চলতে আপন খেয়ালে নিজের সঙ্গে কথা কইছিল।
ওই যাঃ, ঘন্টা বাজল যেন! হ্যাঁ—ঢং—ঢং—ঢং। ইস্কুল বসে গেল! শীতের উত্তুরে বাতাস শন্-শন্ বইছে। সেই কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছে ছেলেটি মাকে প্রণাম করে। পথ আর ফুরোতেই চায় না। অবিশ্যি হাঁটছিল সে নিজের খেয়ালে। সময়ের হিসেব নিয়ে মাথা ঘামাবার মতো মনই তার নয়। গাঁয়ে ঘরে ঘড়ি নেই; আছে কেবল চারটি বেলা—সকাল, দুপুর, বিকেল আর রাত্তির। অবিশ্যি সময় সম্বন্ধে ছেলেটি একেবারে বেঁহুশ নয়। কেন, ঘড়ির অঙ্ক সে কষেছে বইকি।

কিন্তু ইস্কুল বসে গেল যে! এখনও খানিকটা রাস্তা বাকি রয়েছে। ওপরে আকাশের দিকে অসহায় ভাবে তাকাতে গিয়ে বিরাট একটা গাছের ডালে-পাতায় চোখ ঠেকে গেল তার। গাঁয়ে থাকলে না হয় বিশালাক্ষী দেবীকে মনে মনে ডাকত সে। বিশালাক্ষী বড় ভাল দেবী। তিনি ঠিক ছোটদের মনের কথা শুনতে পান। কতবার জ্যোৎস্নারাতে ঘুম ভেঙে গেলে ঝিঁঝি পোকার ডাক শুনতে শুনতে বিভূতি টের পেয়েছে— দেবী এসেছেন। তিনি গাঁয়ের বনে-বাগানে ঘুরে ঘুরে গাছে গাছে, ইছামতী নদীর জলে কচুরিপানার দলে ফুল ফুটিয়ে যাবেন সারা রাত ধরে। চোখ মেলে সে দু-হাত যুক্ত করে দেবীকে প্রণাম জানিয়েছে। তার সারা মনের একটি ইচ্ছা— বিশালাক্ষী দেবী যেন তাকে বনগাঁ শহরের বড় ইস্কুলে ভর্তির বন্দোবস্ত করেন। নিশুতি রাতে কিশোর মনের এই আকুতি, চোখের আড়ালে দাঁড়িয়ে নিশ্চয় শুনেছিলেন দেবী।

কিন্তু ইস্কুলের ঘন্টা বেজে গেছে। বাতাসে ঢেউ তুলে ঢং—ঢং শব্দটা থেমে গেছে। সারা সকাল ধরে এই দীর্ঘ সাড়ে তিন মাইল রাস্তা একা-একা চলে আসা একেবারে ব্যর্থ হয় যাবে নাকি? আর কিছু ভেবে না পেয়ে বিভূতি ছুটতে শুরু করল। ছুটতে ছুটতে স্কুলের সামনে এসে থম্কে দাঁড়িয়ে পড়ল। ক্লাস বসে গেছে। একটা অস্ফুট গুঞ্জন ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। খোলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ক্লাসে ছেলেরা বসে আছে। এই ইস্কুল! এই ইস্কুলে ভর্তি হবার স্বপ্ন সে দেখেছে কতো দিন ধরে। কিন্তু ভেতরে ঢুকবে কী করে?

মায়ের মুখখানি মনে পড়ল। ছোটবেলায় যেদিন বিভূতিকে পাঠশালাতে পাঠানো হয়েছিল সেদিন পাঠশালাতে যেতে চায় নি বিভূতি। আর ধারণা ছিল, যে-সব ছেলে দুষ্টুমি করে, তাদেরই পাঠশালাতে পাঠানো হয়। তার সে ভয়-পাওয়া মনে সাহস জাগিয়ে মা হাসিমুখে বলেছিলেন— ভয় কী খোকা! লেখাপড়া শিখে বিদ্বান হও বাবা! কিন্তু সে মুখখানি আজ আর দেখতে পায়নি বিভূতি। আজও মা তাকে আশীর্বাদ করেছেন। আজ বিভূতি যখন সত্যিকার লেখাপড়া শিখবার সংকল্প নিয়ে স্কুলে ভর্তি হতে আসছে তখন মায়ের চোখে-মুখে কেমন যেন একটা অন্যমনস্কতা, তিনি যেন খুব ভাবনায় পড়েছেন। তা ভাবনা তো হবেই। বিভূতি এখন বড় হয়েছে। সংসারের অনেক কথাই সে বুঝতে শিখেছে। সে গরীবের ছেলে। তার বাবা টাকা রোজগারের ধান্দায় বাইরে-বাইরে ঘোরেন—ন-মাসে ছ-মাসে একবার বাড়ি আসেন। বাবাকে সে খুব ভালোবাসে। মাঝে-মাঝে মায়ের কথায় বাবার মুখখানা কেমন দুঃখী-দুঃখী দেখায়। বাবার জন্যে বিভূতির মনে খুব কষ্ট হয়। মা অমন করে বলেন কেন!— আজ সে যখন মায়ের পায়ের ধুলো নিয়ে উঠল, আসবার আগে মাকে দেখবার জন্য মায়ের দিকে তাকাল তখন যেন মনে হ’ল বাবার সে দুঃখী-দুঃখী মুখখানার ছায়া পড়েছে মায়ের মুখেও। কেন? . . . এখন, স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে মায়ের চিন্তায় বিষণ্ণ মুখখানি মনে পড়ছে কেবলই। ভয় পেয়েছে বিভূতি। স্কুলের ভেতরে ঢুকতে সাহস হচ্ছে না। যদি কেউ কিছু বলে! যদি হেডমাস্টারমশাই জিগ্যেস করেন— কী জন্যে তোমার দেরি হ’ল?
কথাটা কল্পনা করেই বুকের ভেতরে ভয়ের হাতুড়ি দমাদ্দম ঘা মারতে লাগল—ধড়াস-ধড়াস, ধড়াস-ধড়াস। তিনি তো আর গুরুমশাই-এর মত দাঁত খিঁচিয়ে বলবেন না—‘এটা নাট্যশালা নয়!’ হাই স্কুলের হেডমাস্টার থমথমে গম্ভীরমুখে গমগমে গলায় ইংরেজিতেই কথা বলবেন।
জবাব দিতে পারবে কি বিভূতি? না!
তাহলে?
তাহলে— আজকের মতো বাড়ি ফিরে যাওয়াই ভাল।
কিন্তু এতদিন ধরে এই স্বপ্ন দেখার পর, শেষে স্কুলের দরজায় এসে ভর্তি না হয়ে বাড়ি চলে যাবে?

স্কুলের সামনে পাকা রাস্তা। ও-পাশে একটা কাঁঠালগাছ দেখে সেদিকেই কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল বিভূতি। বাড়ি ফিরে যেতে মন সরছে না। অথচ সে ছেলেমানুষ, হেডমাস্টারমশাইকে তো বুঝিয়ে বলতে পারবে না— অনেকদূরের গাঁয়ে তাদের বাড়ি। পথের পাশে যেখানেই ঘন বন সেখানেই একা-একা চলতে তার ভয় করছিল। তাই যেখানে ভয় পেয়েছে সেখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকেছে— পথে কোনও লোক দেখলে তখন সেই লোকের পিছু পিছু এগিয়েছে। এইভাবে আসতে আসতে দেরি হয়ে গেল। . . . মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে ভাবলেও, সেটা হেডমাস্টারের মতো বড়লোকের সামনে দাঁড়িয়ে বলবার সাহস নেই যে!—
অতএব? আবার এই এতখানি পথ একা-একা যেতে হবে। অনেক লম্বা পথ। এমনিতে পথ চলতে বিভূতির ভালই লাগে। কিন্তু এখন যেন তার পা দুটো ব্যথা করছে। স্কুলের পাশে দু-চার বার ঘোরাফেরা করে শেষে সে একটা সবুজ ঘাসে ঢাকা জায়গায় বসল। খানিকক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে তারপর আবার যাত্রা করবে।
বসে-বসে মনে হ’ল, আজ যদি তার বাবা সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন তা’হলে এসব কোনও হাঙ্গামাই হ’ত না। কিন্তু বাবা যে কবে আসবেন তার কোনও ঠিক নেই। হয়তো দশ-বারো দিনের ভেতরে হঠাৎ এসে পড়বেন। বিভূতির জন্যে একখানা বই নিশ্চয় আনবেন। . . . আবার এমনও হতে পারে যে, দু’মাসের মধ্যেও বাবা এলেনই না! অনেক ভেবে চিন্তেই বিভূতি একা-একা স্কুলে এসেছে। তা ছাড়া, কেন যেন তার বিশ্বাস জন্মেছে—বাবা ইংরেজি স্কুলে পড়াটা ঠিক পছন্দ করেন না। মনে মনে একটু ভয়ও ছিল, হয়তো তিনি বলে বসবেন—ওসব ইংরিজি-টিংরিজি শিখে কি হবে! খোকা, বাংলাটা শেখো, গণিত শেখো, সংস্কৃত শিখে পণ্ডিত হও। ব্রাহ্মণের যজন-যাজনই তো আসল বৃত্তি।. . . বাবা যখন গল্পগুজব করেন তখন তিনি বেশ সহজ কথা বলেন। কিন্তু লেখাপড়া, শিক্ষা-দীক্ষার কথা উঠলেই তিনি কেমন যেন বই-এর শক্ত-শক্ত ভাষাতে কথা বলেন। এদিক দিয়ে বিভূতি বাবাকে একটু ভয় করে।

বঙ্গবাসী পত্রিকাতে ‘বিলাতযাত্রীর চিঠি’র মধ্যে যেসব অপূর্ব বিচিত্র কাহিনির বর্ণনা রয়েছে সেই সব ঘটনা কল্পনায় মনশ্চক্ষে দেখতে দেখতে তার কতবার বড় হওয়ার সাধ জেগেছে। আজও স্কুলের ভেতরে ঢোকবার সাহস হারিয়ে বিভূতি নিজের মনে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখতে দেখতে কিছুক্ষণের মধ্যে ব্যর্থতার কথা একেবারে ভুলে গেল। মনে মনে দেখল সে—স্কুল থেকে পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছে— কলকাতার কলেজ। অনেক বড় বড় বই পড়ে সে বিদ্বান হয়েছে। তারপর? তারপর বিদ্বান হয়ে বনগ্রাম হাই ইংলিশ স্কুলের হেডমাস্টার!— একেবারে হেডমাস্টার? . . . কথাটা কল্পনাতেও ভাবতে ভরসা হয় না যেন। যে হেডমাস্টারের সামনে যেতে এই কিশোর বালকের সাহস ফুরিয়ে যায়, সেই হেডমাস্টারির মতো কঠিন কাজ কি কখনও করতে পারবে বিভূতি?

কল্পনার দৌড় বড় লম্বা দৌড়। মনে মনে ভীরু বলে নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বিভূতি আবার স্বপ্ন দেখতে লাগল। খুব পারব! সে-রকম ভাবে বরাবর ফার্স্ট হয়ে হয়ে এগিয়ে যেতে পারলে হয়তো— হাঁ, হয়তো হেডমাস্টারের চেয়েও বড় কিছু হয়ে যেতে পারে। বলা তো যায় না। তবে হ্যাঁ, সে বড় হয়ে মাকে, দিদিকে, বাবাকে, ছোট্ট ভাইটিকে সুখে রাখবে। মা আর বিশালাক্ষী দেবী যদি ইচ্ছে করেন তাহলে বিভূতির বড় হওয়া কেউ আটকাতেই পারবে না।

বাড়ি ফেরার আগে কিশোর বালকটি বারবার স্কুল-বাড়িটার দিকে সতৃষ্ণ চোখে দেখতে লাগল। ঢং-ঢং-ঢং ঘন্টা বাজল। একটা পিরিয়ড শেষ হ’ল। আজ আর নয়, আবার কাল আসতে হবে। কাল সে কিছুতেই দেরি করবে না। ঠিক সময়ে, স্কুল বসবার আগেই সোজা হেডমাস্টারমশাইএর সামনে হাজির হয়ে বলবে—‘আমি ভর্তি হতে চাই।’ টাকার জন্যে ভাবতে হবে না, টাকা সে সঙ্গে করেই এনেছে। টাকার জন্যেই তো এতদিন আটকে ছিল। হয়তো আরও পিছিয়ে পড়ত। শেষ পর্যন্ত মা লক্ষ্মীর কৌটো থেকে সিঁদুরমাখা টাকাটিও বার করে দিয়েছেন। একটু রাগ করেছিলেন মা। অপ্রসন্ন মুখে বলেছিলেন— তুইও এমন অবুঝ হ’লি! ইস্কুল-ইস্কুল করে মাথা খারাপ করে দিলি খোকা! . . . অবশ্য তারপর নিজে থেকে বলেছিলেন— তা তোদেরই কল্যাণের জন্যে লক্ষ্মীর সেবা! কতকালই বা মুখ্যু হয়ে ঘরে বসে থাকবি! যা, নিয়ে যা। তারপর, কপালে লেখা যা আছে তা হবেই!

মোট তিনটি টাকা, একসঙ্গে জোগাড় করতে মায়ের অভাবের সংসারে খুবই কষ্ট হয়েছে, বিভূতি জানে বইকি। কিন্তু, বড় হওয়ার, মানুষ হওয়ার যে এ ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। সে কী করবে? কী করতে পারে সে?
প্রথম দিনের অভিযান ব্যর্থ হ’ল। বাড়িতে পা দিয়েই বিভূতি মায়ের কাছে মুখ ভার করে বলল— তোমার জন্যেই ত আজ সব মাটি হ’ল। লেট্—
মা অতশত বোঝেন না। সাত সকালে উঠে ফ্যানে-ভাতে ফুটিয়ে দিয়েছেন, ছেলেটা এতখানি পথ হেঁটে যাবে। বেলা গেলে সন্ধ্যের সময় বাড়ি ফিরবে— সারাটা দিনমান চিঁড়ে-মুড়ি খেয়ে তো আর চলে না। হঠাৎ এই ভরদুপুরে অসময়ে বিভূতিকে বাড়ি ফিরতে দেখে তিনি খুব অবাক হয়ে গেছেন। কী হ’ল আবার!
ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন— হ্যাঁ রে কী হ’ল? তোকে ইস্কুলে নিলে না বুঝি!
—নেবে কি, আজ তো লেট্ হয়ে গেল— আবার কাল যেতে হবে।
—লেট্ আবার কী কথা—
মায়ের সরল চোখের এই না-বোঝা চাহনি দেখতে বিভূতির খুব মজা লাগে। সে মুচ্কি হেসে বলল— এল-এ-টি-ই, লেট্! লেট্ মানে দেরি। আজ যেতে দেরি হয়ে গেল কি না, সেই জন্যে কাল একেবারে ঠিক টাইমে হাজির হতে হবে। বুঝলে?
মাকে ব্যাপারখানা বুঝিয়ে দিয়ে বিভূতি নিশ্চিন্ত হ’ল।

রাত নিঝুম। দু-চোখে ঘুম নেই। আর সবাই তো বেশ ঘুমোচ্ছে। বিভূতির ঘুম কোথায় পালিয়েছে। কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে প্রথমে খুব শীত লাগছিল। এখন গায়ের গরমে কাঁথাটা বেশ গরম-গরম লাগছে। ভারী আরাম! আর একটু জেগে থাকলেই দ্বিতীয় প্রহরের শিবারব উঠবে। শেয়াল ডাকা থেমে গেলে আবার ঝিঁঝির নূপুর বাজবে— তারপর বিশালাক্ষী দেবী আসবেন। তখন চুপিচুপি বিভূতি তাঁর কাছে বলবে— কালকে যেন ইস্কুলে ভর্তি করিয়ে নেওয়া হয়। কাল যেন আর ফিরে আসতে না হয়। সে যে ছেলেমানুষ। তার বাবা বিদেশে গিয়েছেন, কথকতা করে টাকা আনবার জন্যে। বাবা সঙ্গে না থাকায় ছেলেমানুষ বিভূতির হেডমাস্টারকে ভয় লাগে— এ কথা দেবী কি আর বোঝেন না! গাঁয়ের অন্য কোনও বড়সড় পুরুষ মানুষকে বললে ঠাট্টা করবে, বলবে— হ্যাঁ, গরীবের ঘোড়া রোগ। পেটে ভাত নেই, লাখ টাকার স্বপ্ন দ্যাখে ছোঁড়া! ওরা যে বড্ড গরীব! তাই বলে কি মূর্খ হয়ে থাকবে সে! কেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও তো বড়লোকের ছেলে ছিলেন না— কই তাতে তো তাঁর বড় হওয়া আটকায়নি। বিভূতিও দেখিয়ে দেবে যে গরীব বলে হেলাফেলার বস্তু সে নয়। . . . স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ল, আবার জেগে উঠে পরদিন স্কুলে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে লাগল। দিদি তো তাকে পাগল বলে ঠাট্টা করে কোথায় যেন চলে গেল। দিদি বললে— ইস্কুল-ইস্কুল করে তুই একেবারে পাগল হয়ে উঠলি!

দ্বিতীয় দিন স্কুলে পৌঁছতে দেরি হয় নি। দু-একটি ছেলেকে তার পথ চলতি দেখল সে। ওরা সবাই স্কুলে যাচ্ছে।
স্কুলের কাছাকাছি পৌঁছে বিভূতির পা যেন হঠাৎ বেধে-বেধে যেতে লাগল। সঙ্গের ছেলেরা এগিয়ে গেল। পিছনের ছেলেগুলিও এক-দুই করে তার চোখের সামনে দিয়ে স্কুলে গিয়ে ঢুকল। পথের ধারে দাঁড়িয়ে বিভূতি ভাবছে, এইবার সে ভেতরে ঢুকে পড়বে। হ্যাঁ, এইবার—! এমনি করে ভাবতে ভাবতে ঘণ্টা বেজে স্কুল বসে গেল। ছেলেদের গোলমাল হট্টগোল এক নিমেষে থেমে গেল— কে যেন যাদুমন্ত্র-বলে সবগুলি ছেলের গলার স্বর থামিয়ে দিয়েছে! কী রকম আশ্চর্য লাগে ভাবতে।— কিন্তু এ কী করছে বিভূতি পথের ওপর দাঁড়িয়ে? সে কি ভেতরে ঢুকবে না? কই বিশালাক্ষী দেবী তাকে সাহস দিচ্ছেন না কেন! এমন সাহস তিনি দিয়ে দিন যাতে সোজাসুজি হেডমাস্টারমশাইএর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারে বিভূতি।

এক-দুই-তিন মিনিট গেল। দশ-বিশ-ত্রিশ মিনিটও ভয়ে সংশয়ে কেটে গেল। একটা পিরিয়ড পার হওয়ার ঘণ্টা বাজল। বিভূতি দু-পা এগোয়, দশ-পা পিছিয়ে আসে। কী এক অজেয় ভয় তাকে ভীরু পায়রার মতো নরম করে ফেলেছে। বঙ্গবাসী পত্রিকায় পড়া ডুভাল, অথবা যাত্রায় দেখা প্রতাপসিংহ প্রভৃতি বীরেরা কেউ এগিয়ে এসে সাহস যোগাতে পারল না। মনে মনে নিজের এই ভীরুতায় লজ্জা পেয়ে খুব বেশিক্ষণ আর বিভূতি স্কুলের সামনে থাকতে পারল না— পালিয়ে গেল। দ্বিতীয় দিনও ভর্তি হওয়া হ’ল না। . . .

বার বার তিন বার। তৃতীয় দিন নিশ্চয় সে পরাজিত হয়ে ফিরে আসবে না। হ’লই বা গরীবের ছেলে, না-ই বা রইল তার পায়ে জুতো, গায়ের চাদর সেলাই-করা, তাতেই বা কি এসে যাবে! কিছু না, কিছু না—এ সবই পাড়াগাঁয়ের ছেলের মনের মিছে ভয়। এই তো কত ছেলে তারই মতো গরীব— স্কুলে যাচ্ছে। গরীব হলেও বিভূতি তো আর গরীবের মতো দেখতে নয়!

আজ তার স্কুলে ভর্তি হতে আসার তৃতীয় অভিযান। যেমন করে হোক আজ বিভূতিকে স্কুলের ভেতরে পৌঁছতেই হবে। আশ্চর্য, এই যে একটা ছেলে এখানে আসছে রোজ— কই কেউ তো একবার খোঁজও করে না, কেন সে আসে! যদি একটিবার তাকে জিগ্যেস করত কেউ তাহলে আর কোনও হাঙ্গামাই থাকত না।
অনেক চেষ্টা করে সে স্কুলের সামনের মাঠে গিয়ে দাঁড়াল। ভয় কেন? কিছুতেই বুঝতে পারে না— এত ভয় কিসের জন্য! তবু বুকের মধ্যে হাতুড়ি পেটার মতো ধাক্কা লাগছে, সেটুকু টের পাচ্ছে বিভূতি।
হঠাৎ একটি লোক তার সামনে এসে বলল— ওহে, শুনছ। তোমাকে হেডমাস্টারবাবু ডাকছেন।
—আমাকে!
—হ্যাঁ।
মনে মনে খুব খুশী হ’ল বিভূতি। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। হবেই তো, আজ যে তৃতীয় দিন— বিশালাক্ষী দেবী পরীক্ষা করে দেখছিলেন বিভূতির লেখাপড়ার চাড়টা সত্যি কি না!
লোকটি একটু চড়া গলায় বলল— কী, অমন হাঁ করে দাঁড়িয়ে কি ভাবছ! চলো—চলো—

বনগ্রাম হাই স্কুলের হেডমাস্টার চারুলাল মুখোপাধ্যায় রাশভারী মানুষ। তাঁর ঘরে বিভূতি ঢুকতেই তিনি চোখ তুলে তাকালেন— কী চাই?
তারপর একটু তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ছেলেটিকে ভাল করে দেখে নিয়ে বললেন— তুমি দু’দিন ধরে স্কুলের সামনে ঘোরাঘুরি করছ কেন খোকা?
প্রথমে কথা বলতে গিয়ে গলা শুকাল। কোনও রকমে গোটা দুই ঢোক গিলে নিয়ে বিভূতি বাধো-বাধো সুরে জবাব দিল— এখানে ভর্তি হতে চাই স্যার!
—ভর্তি হবে? তা রাস্তায় এসে বসে থাকো কেন? বাড়িতে বাবা-দাদা কেউ নেই? একা-একা কেন এলে?
—বাবা বিদেশে। বাড়িতে মা আছেন।
—হুঁ! তা স্কুলে ভর্তি হবে যে, তোমার বাড়ির লোকেরা জানেন?
ঘাড় হেলিয়ে বিভূতি জানালে—জানেন।
দু-চারটি প্রশ্ন করে হেডমাস্টারমশাই নিশ্চিন্ত হলেন।
তারপর বললেন—টাকা এনেছ?
—আজ্ঞে হাঁ স্যার!
বলে, বিভূতি কোঁচার খুঁট থেকে টাকা বার করে টেবিলের ওপর রাখল। হেডমাস্টারমশাই বললেন— কত?
—তিন টাকা।
—তিন টাকায় ভর্তি হওয়া যায় না। আরও দু’টাকা লাগবে।
—আর তো আনিনি।
—তাহলে কাল নিয়ে এসো।
বিরস মুখে মাথা হেঁট করে বিভূতি চুপ করে দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবতে লাগল। চারুবাবু হেডমাস্টার ছেলেটির আপাদমস্তক দেখে নিলেন।
মাথা না তুলেই বিভূতি অস্ফুটস্বরে বলল— মা’র কাছে আর কিছু নেই। লক্ষ্মীর ঝাঁপির টাকা ছিল, তাই দিয়ে এই তিন টাকা হয়েছে।
চারুবাবুর কানে কথাগুলো প্রবেশ করল। কিন্তু তিনি কোনও সাড়া দিলেন না। বিভূতি আস্তে আস্তে টেবিল থেকে টাকা তুলে নিয়ে কোঁচার খুঁটে শক্ত করে বেঁধে নিল। অভিমানে, অপমানে তার মাথাটা মাটিতে মিশে যেতে চাচ্ছে। হতাশার চেয়ে অপমানবোধটাই যেন প্রবল হয়ে উঠেছে। এত সাধ স্কুলে পড়বার, অথচ পয়সা নেই বলে সে স্কুলে লেখাপড়া শিখতে পারবে না— এ কেমন বিধান!
মুখ চুন করে ছেলেটি হেডমাস্টারমশাই-এর ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে এমন সময় চারুবাবু ডাকলেন— শোনো!
ঘুরে দাঁড়াল বিভূতি ।
হেডমাস্টারমশাই বললেন—চলে যাচ্ছ যে, ভর্তি হবে না?
চুপ করে রইল বিভূতি। কী উত্তর দেবে সে?
—এস, ভেতরে এস। তোমাকে আমি ভর্তি করিয়ে নিচ্ছি। কী নাম তোমার?
—আজ্ঞে, আমার নাম শ্রীমান বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
—বিভূতি বাঁড়ুয্যে! বামুনের ছেলে, বেশ বেশ। তা বাপু মন দিয়ে লেখাপড়া করবে তো!
—আজ্ঞে হ্যাঁ।
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে কিশোর বালক চোখের জল মুছল। তার এত আনন্দ হয়েছে যে চোখে জল এসে পড়েছে ।

ঋণ: বার্ষিক শিশুসাথী, ১৯৫৮; বানান পরিবর্তিত