Categories
অদ্ভুতপুর |

পুতুল দ্বীপের ইতিকথা

390 |
Share
| ১৬ মার্চ, ২০২৩
শ্রমণা বসু

রেডিও উপস্থাপক ও বিজ্ঞাপনকর্মী

চিত্রঋণ: Wikipedia

ছোটবেলায় বোধহয় সকলেরই একটা স্বপ্ন থাকে যে ঘরভর্তি পুতুল থাকবে, খেলনা থাকবে, সারাদিন ধরে কত্ত খেলব, কতই না মজা হবে! কখনও খেলতে খেলতে পুতুল ভেঙে যায়। তাও এমন মায়া পড়ে যায় যে ওই ভাঙা পুতুলকেই কত আপন মনে হয়! কিন্তু যদি এমন হয়, একটা গোটা এলাকা জুড়ে চারিদিকে শুধু পুতুল ঝুলছে আর সব পুতুলই ভাঙা ও ভয়ঙ্কর দেখতে! ভাবতে পারা যায়? ব্যাপারটা শুধু অদ্ভুতই নয়, বেশ গা-ছমছমেও বটে! তবে এটা নিছকই ভাবনা নয়, এই রহস্যময় পৃথিবীর বুকে এমন এক দ্বীপ সত্যিই আছে, যেখানে শ’য়ে শ’য়ে ভাঙা পুতুল ঝুলছে, ভয়ঙ্কর-দর্শন পুতুল সব! কোনওটার হাত ভাঙা, কোনওটার চোখ খোবলানো, কোনওটার চুল নেই, কোনও পুতুলের সারা শরীর যেন কেউ ছিঁড়ে নিয়েছে! কোনও পুতুলের মুখে মাটি মাখা, কোনও পুতুলের গা থেকে গজিয়ে উঠেছে মাকড়সার জাল, নানারকমের পোকামাকড় ঘুরে বেড়াচ্ছে তার মধ্যে দিয়ে। হাওয়া দিলে পুতুলগুলো নড়ছে, কোনওটার চোখ পিটপিট করছে, আবার পুতুলে-পুতুলে ঘষা লেগে নানারকম শব্দ তৈরি হচ্ছে। সারাদিন ধরে পুতুলগুলোর নানা আকৃতির ছায়া যেন দূর থেকে অদ্ভুত এক আবেশের সৃষ্টি করে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে শ’য়ে শ’য়ে বাচ্চা যেন পাখির মতো আকাশে ওড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এরকম এক দ্বীপ আছে সুদূর মেক্সিকোর রাজধানী মেক্সিকো সিটির সোচিমিল্কো ক্যানালে। বলা যায়, এটি পৃথিবীর অন্যতম গা-ছমছমে স্থান। আশেপাশের বাসিন্দারা বলেন ওটা নাকি ভূতের আস্তানা! কিন্তু শোনা যায় আরও এক রহস্যময় গল্প। সে ৫০ শতকের গোড়ার কথা।

তথ্যসূত্র অনুযায়ী, জুলিয়ান সান্টানা বারেরা নামে একজন সবজিবিক্রেতা এই দ্বীপে ছোটোখাটো একটা ঘর বানিয়ে থাকতে শুরু করে। শোনা যায়, জুলিয়ান সান্টানা নাকি মানসিকভাবে সুস্থ ছিল না। হঠাৎই নিজের পরিবার ছেড়ে সে এই দ্বীপে চলে আসে। একদিন তার ঘরের কাছেই এই সোচিমিল্কো ক্যানালে একটি বাচ্চা মেয়ের মৃতদেহ ভাসতে দেখে সে। ভাবে, জলজ উদ্ভিদে পা আটকে মেয়েটি ডুবে মারা গেছে। এরপর সে ওই জায়গায় একটা পুতুলও পায়। জুলিয়ান সান্টানার বক্তব্য অনুযায়ী এই ঘটনার কয়েকদিন পরে সে একটি বাচ্চা মেয়ের কান্না শুনতে পায়, মেয়েটি যেন বলছে— ‘আমি আমার পুতুলটা চাই’। জুলিয়ান সান্টানা ভয় পায়, ভাবে মেয়েটির আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে আশেপাশে। তাই সেই আত্মাকে সন্তুষ্ট করার জন্য সে বাড়ির সামনে পুতুলটিকে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখে। এভাবেই চলে বেশ কিছুদিন। মাঝে মাঝে নাকি সান্টানা বাচ্চা মেয়ের কান্নার আওয়াজ, গলার আওয়াজ পেত। এরপর একদিন সে দেখে যে তার জমির সব শস্য কে যেন নষ্ট করে দিয়েছে! জুলিয়ান সান্টানা ভাবে, এ নিশ্চয়ই ওই বাচ্চা মেয়েটির আত্মার কাজ। যাতে সেই আত্মা তার আর কোনও ক্ষতি না করতে পারে, সেইজন্য সে আরও পুতুল খুঁজে নিজের ঘরে ও বাড়ির আশেপাশে ঝুলিয়ে রাখতে শুরু করে। ক্যানালে অনেক সময় ভাঙাচোরা পুতুল ভেসে উঠত, সেগুলো সে তুলে নিয়ে ওই অবস্থাতেই ঝোলাত। এমনকী ময়লার গাদা ঘেঁটেও সে অনেক সময় ভাঙা পুতুল তুলে আনত। এমনও হয়েছে যে সে অনেকসময় লোকালয়ে এসে ফসলের বিনিময়ে ভাঙা পুতুল নিয়ে গেছে। আসলে জুলিয়ান সান্টানা বিশ্বাস করত যে ওই পুতুলগুলো পেলেই ওই আত্মা আর ওর কোনও ক্ষতি করবে না।

এইভাবে প্রায় ৫০ বছর জুলিয়ান সান্টানা ওই দ্বীপে ছিল। টানা ৫০ বছর ধরে হাজার হাজার পুতুল জমেছে সান্টানার ঘরে ও আশেপাশে। এরপর একদিন ঘটে আরও এক রহস্যময় ঘটনা। জুলিয়ান সান্টানার ভাইপো সান্টানাকে চাষবাসের কাজে সাহায্য করবে বলে তার বাড়ি আসে, এসে দেখে ক্যানালে কার যেন মৃতদেহ ভাসছে। জুলিয়ান সান্টানার মৃতদেহ ছিল সেটা। কেউ কেউ বলে, ওই বাচ্চা মেয়েটির আত্মাই মেরে ফেলেছে সান্টানাকে, কেউ আবার বলে ওসব কিছু নয়, স্বাভাবিকভাবেই মৃত্যু হয়েছে তার। কিন্তু জুলিয়ান সান্টানার মৃত্যু ঘিরে রহস্য আজও অটুট।

এখন এই পুতুল দ্বীপ রীতিমতো এক দর্শনীয় স্থান। রংবেরঙের বোটে চেপে অনেকেই গাছপালা ঘেরা এই রহস্যময় দ্বীপে ঘুরতে যান। কিন্তু রাতে থাকার কোনওরকম বন্দোবস্ত এখনও নেই এই দ্বীপে। সেই সাহস এখনও কেউ দেখায়নি। পৃথিবীর অন্যতম গা-ছমছমে জায়গা এই পুতুল দ্বীপে একবার ঘুরতে গেলে সারাজীবন তা এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা হয়ে মনের কোণে থেকে যাবেই।

তথ্যসূত্র: wikipedia.org, Unexplained Studio