Categories
অদ্ভুতপুর |

পুরনো কেল্লায় ঘুঙুরের শব্দ

1112 |
Share
| ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০
কেকা অধিকারী ব্যানার্জী

কিউরেটর, এশিয়াটিক সোসাইটি

পুরানা কিলা, চিত্র সৌজন্য: লেখিকা; গ্রাফিক্স: কমলাকান্ত পাকড়াশী

প্রত্যেক মানুষের জীবনেই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের একটা দোলাচল থাকে। হয়তো বিশ্বাস করতে মন চায় না, কিন্তু অবিশ্বাসও করা যায় না। অনুভব করা যায়, কিন্তু তা সত্য বলে মেনে নিতেও ইচ্ছা করে না। এইরকম কিছু অপ্রাকৃত ঘটনা কখনও কখনও প্রবল বিজ্ঞান-বিশ্বাসী মানুষকেও নাড়িয়ে দেয়, অন্যরকম কিছু ভাবতে বাধ্য করে।

মেঘমুলুক পত্রিকার বন্ধুদের জন্য আমার অভিজ্ঞতার খাতা থেকে একটা গা-ছমছমে গল্প এনেছি আজ। প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে পড়াশোনা করার সুবাদে দেশের বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার সুযোগ ঘটেছে বহুবার। সেবার দিল্লি গিয়েছিলাম গবেষণার কিছু কাজে। ১৯৯৭-এর গোড়ার দিকে, বোধহয় ফেব্রুয়ারি মাস হবে, তখনও হালকা শীতের আমেজ রয়েছে দিল্লিতে। সেই সময়ে, কোথাও থাকার ব্যবস্থা করাটা ছিল এক কঠিন কাজ, কারণ তখন সবে আমি দৈনিক মজুরিতে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (Archaeological Survey of India), কলকাতা মণ্ডলে কাজে ঢুকেছি। প্রকৃত অর্থে ছাত্রাবস্থা কাটেনি তখনও। স্বল্প ব্যয়ে দিল্লিতে থাকার বন্দোবস্ত অগত্যা পুরনো কেল্লাতেই হল।

বন্ধুরা নিশ্চয়ই জানো যে, পুরানা কিলা বা পুরনো কেল্লার আগের নাম শোরগড় অথবা শের দূর্গ৷ এই জায়গা মহাভারতে বর্ণিত পাণ্ডবদের রাজধানী ইন্দ্রপ্রস্থ হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছে। দীর্ঘ ২৫০০ বছর ধরে এই জায়গায় বসতির প্রমাণ থাকলেও বর্তমান দূর্গের যে অবশেষ দেখা যায় তা আসলে মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের সময়কালে শুরু হয়ে শেরশাহ সুরির সময় পর্যন্ত নির্মিত হয়েছিল— খ্রিস্টিয় ষোড়শো শতকে। দূর্গের পরিখার পরে যমুনা প্রবাহিত। আছে কিলা-ই কুনা মসজিদ (১৫৮১ এ শের শাহের তৈরি), আছে শের-মণ্ডল (হুমায়ুনের ব্যক্তিগত পুস্তকালয়, হামাম, কাইরুল মঞ্জিল যা মাদ্রাসা হিসেবে ব্যবহৃত হত)। কাইরুল মঞ্জিলের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে মথুরা রোড পার হয়ে পুরানা কিলার বিপরীতে রয়েছে লাল-দরওয়াজা বা শেরশাহসুরি-গেট। প্রধান প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার গিয়ে বাঁদিকে রয়েছে প্রত্নতত্ত্ব সর্বেক্ষণের অতিথি নিবাস। দুটি মাত্র ঘর— সঙ্গে একটি বড় স্নানঘর। অন্যটা খাবার ও বসার ঘর। যথারীতি ওই বড় ঘরটায় আমার থাকার বন্দোবস্ত হয়। সামনেই সবুজ ঘাসের লন— যত্নে পরিচর্যায় তৈরি। মালির হাতে সাজানো বাগান। অতিথি নিবাস থেকে দৃশ্যমান কিন্তু অনেকখানি দূরে ডানদিক ঘেঁসে হুমায়ুনের লাইব্রেরি এবং বর্তমানে রক্ষিত প্রদর্শশালা ও বীথিকা— যেখানে পুরনো কেল্লায় খননের ফলে পাওয়া বহু প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী, অস্ত্রভাণ্ডার ইত্যাদি রক্ষিত রয়েছে।

আমি প্রায় দুপুরের দিকে সেখানে পৌঁছে দারোয়ানের কাছে আমার থাকার প্রমাণপত্র দেখিয়ে ঘরে ঢুকলাম। তারপর জিনিসপত্র রেখে একটু চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম পুরনো কেল্লা ঘুরে দেখতে। সেই প্রথম আমার ওই কেল্লা একা-একা ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা। অতঃপর সন্ধ্যা নামল; লোকজন আর ছাত্রছাত্রীদের যাতায়াত শেষ হয়ে গেল। সন্ধ্যা ৫টায় প্রবেশপথ বন্ধ হয়ে যায়, সকলকেই বের করে দেওয়া হয়। সবাই যখন বেরিয়ে যাচ্ছিল, আমার তখন মনে মনে খুব আনন্দ হচ্ছিল। কারণ এই বিষয়ে পড়াশোনা-করা এবং এইরকম কেল্লায় অতিথি নিবাসে থাকতে পারা সৌভাগ্যের ব্যাপার। আমাকে সময়ের নিয়মে বাইরে চলে যেতে হচ্ছে না। যতক্ষণ ইচ্ছা ঘুরে ঘুরে দেখতে পারব, কেউ বারণ করার নেই। কিন্তু সে আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। একজন প্রহরী এসে আমাকে বলল যমুনার পারের পরিখার ধার থেকে চলে আসতে। কারণ সন্ধ্যার পর ওখানে আর বসা যাবে না। অনেক কথাবার্তাতেও কাজ হল না। অগত্যা ফিরে এলাম প্রবেশ পথের কাছাকাছি, যেখানে কাঠের গ্যালারি করা আছে।

সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ এখানে দুটো ‘শো’ হয়। আলো ও শব্দের মায়াজালে পুরনো ইতিহাসের গল্প বাঁধা পড়ে। মনে অনুরণন ঘটায় সেই সব ইতিহাসের দিনগুলোর। বাংলা ও হিন্দির তর্জমায় সেসব গল্প সবাইকেই যেন নিয়ে যায় পুরনো দিনে, যেখানে মানসচক্ষে দেখা যায় হুমায়ুন কীভাবে বই পড়তে পড়তে লাইব্রেরির সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ে গিয়ে মারা যান কিংবা রঙিন ঝাড়বাতির আলোয় বাইজি নৃত্যের দৃশ্যাবলি ইত্যাদি। সবার মতো আমিও বিহ্বল হয়ে শুনছিলাম ও মানসপটে ভেসে ওঠা ছবির দৃশ্যগুলো অবলোকন করছিলাম। ‘শো’ শেষ হল রাত আটটা। একে একে সবাই চলে গেল। আমার অতিথি আবাসের দেখভালের দায়িত্বে থাকা ব্যাক্তি ও তার পরিবার আমাকে জিজ্ঞাসা করে গেল যে কখন খাবার দেবে। রাত সাড়ে আটটা নাগাদ তারা ডাল-ভাত এনে হাজির করল। রাত ৯টা নাগাদ খাওয়ার পর্ব মিটিয়ে ঘরে ঢুকলাম। ঘরে একটা একশো পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছিল। জানলার পর্দা ছিল না, ছোট জানলা— শুধু একটা নেট লাগানো। জানলার পাশে পরিখা আর তার পরেই যমুনা প্রবহমানা; চারদিকে গাঢ় অন্ধকার— ঝিঁঝিঁ পোকার মতো পোকার ডাকও শোনা যায় না। চারদিক নিস্তব্ধ। আমি ভাবলাম ভালই পড়া হবে। একটা বই নিয়ে বসলাম। মন বসল না; ঘুরে ফিরে সন্ধ্যাবেলা শোনা শব্দ আর আলোর জাদুতে নির্মিত ইতিহাসের গল্পগুলোই মাথায় ঘুরতে লাগল। আমার কী হয় জানো তো বন্ধুরা— যত কথা, যত পড়া, যত ঘোরার কথা সব রাতেই মনে ভিড় করে আসে। যেমন কবি শঙ্খ ঘোষের কথায় বলা যায়—

‘আমার কিন্তু মন খুলে যায় রাতে
দেখি তখন কতই দুয়ার খোলা
এই হয়তো চলছি মথুরাতে
এই হয়তো সেই লছমনঝুলা।’
-রঙবেরঙ, শারদীয়া, ১৪২৫

সন্ধ্যা নেমে আসার সাথে সাথে, দিবাকরের অস্তরাগের মায়াবী আলোয় সব সৌধগুলো কেমন যেন জীবন্ত হয়ে উঠছিল। সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পরে আমি একটা উঁচু ঢিপির ওপর বসে বসে চিন্তা করছিলাম মুঘল শাসকদের কথা। মুঘল সম্রাট হুমায়ুন— যিনি এই পুরানা কিলা তৈরি করেছিলেন। তিনি ১৫৩০ সালে সিংহাসনে বসে ১৫৩৮ সাল পর্যন্ত প্রাদেশিক আধিকারিকদের সাথে যুদ্ধেই ব্যস্ত ছিলেন। আবার ১৫৫৫ সালে সিকন্দর শাহকে পরাস্ত করে সিংহাসনে ফিরে আসেন। কিন্তু ১৫৫৬ সালে তিনি মারা যান। তাই তেমন কোনও স্থাপত্য, সাহিত্য-শিল্প কিছুই তাঁর সময়ে তৈরি হয়নি। শুধুমাত্র ‘পুরানা কিলা’ তাঁর সময়ের একমাত্র স্থাপত্যের নজির।

ভাবলাম শুয়ে পড়ি। যেমন ভাবা তেমন কাজ। একশো পাওয়ারের বাল্বের আলোয় আমার তো মোটেই ঘুম আসবে না, তাই আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। জানলায় পর্দা নেই, তাই বারবার চোখ চলে যেতে লাগল জানলার দিকে, যেখানে গাঢ় অন্ধকার গ্রাস করে রেখেছে চারিধার। শুধু যমুনার জলের কুলকুল শব্দ মঝে মাঝে কানে ভেসে আসছিল। ডান দিকে দরজার অবস্থাও ওইরকম— কাঠের ফ্রেমে নেট-লাগানো মশা আটকানোর জন্য। আব্রু বলতে একটা পাতলা পর্দা আছে বটে, কিন্তু হালকা হাওয়ায় তাও দুলছে। বাইরের দৃশ্য অর্থাৎ বেশ খানিক দূরে হুমায়ুনের লাইব্রেরিটা দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার। ঘুম আসছিল না— নানা ঘটনা জট পাকিয়ে আসছিল মাথার মধ্যে।

সারাদিনের ক্লান্তিতে আমার দু’চোখে ঘুম নেমে আসতে দেরি হল না। জানি না ঠিক কতক্ষণ পরে আমার কানে আসতে লাগল ঘুঙুরের শব্দ। আমি শুনছিলাম আধো-আচ্ছন্ন কিংবা ঘুমের মধ্যে একজোড়া ঘুঙুরের শব্দ। প্রথমে ভালো লাগছিল। ক্রমশ শব্দের প্রাবল্য বাড়তে লাগল। যেন আওয়াজটা ক্রমশই আমার কাছে চলে আসছিল। আচমকা আমার ঘুমও ভেঙে যায়। একটা গা-ছমছমে ভাব ঘিরে ধরে আমায়। তবুও মনের জোরে ভাবতে থাকি যে মাথার ওপরে অ্যাসবেসটসের ছাদে বোধহয় বাদুড় ডানা ঝাপটাচ্ছে৷ কিন্তু চোখ চলে যায় জানলার দিকে— চারিদিকে নিকষ কালো অন্ধকার। আমি একা আর এতবড় দূর্গের ধ্বংসাবশেষ। একটা প্রচণ্ড ভয় ক্রমশই আমাকে গ্রাস করে ফেলল। আমি দু’হাত নিয়ে কান চাপা দিলাম যদি শব্দটা আর না শোনা যায়। কিন্তু কোনওরকমেই শব্দ বন্ধ হল না। জোরালো হয়ে আওয়াজটা যেন জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। আমি বুঝতে পারলাম যে আমি ভয় পাচ্ছি। ধীরে ধীরে আমার শরীরটা শক্ত হয়ে যাচ্ছিল। আমি হাত-পা নাড়াতে পারছিলাম না। মাঝে মাঝে ঘুঙুরের শব্দ আমাকে আরও ভয়ভীত করে তুলছিল। এইরকমভাবে কতক্ষণ কেটেছিল জানি না। হয়ত দশ মিনিটটাই দশ ঘণ্টা মনে হচ্ছিল। সাধারণত একা কোথাও গেলে আমার কাছে টর্চ, দড়ি ও ছুরি থাকেই। টর্চটা মাথার বালিশের তলাতে থাকা সত্ত্বেও সেটা নিতে পারছিলাম না। এমনকি হাত বালিশের তলাতেই যেন আটকে যাচ্ছিল। হঠাৎ করেই বুঝতে পারলাম যে এভাবে চুপ করে থাকলে আমি আরও খারাপ পরিস্থিতিতে চলে যাব। তাই এক ঝটকায় উঠে পড়ি বিছানা থেকে। কোথা থেকে শক্তি সঞ্চয় করলাম জানি না। বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে কোনওরকমে হাতড়ে সুইচ টিপে আলোটা জ্বাললাম। কোনও শব্দের অস্তিত্ব আর বুঝতে পারলাম না। অতিথি নিবাসের দেখভালের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিটি ও তার পরিবারের লোকজনদের কোনও সাড়াশব্দই নেই। অনেক ডাকাডাকি করেও কারোর সন্ধান পেলাম না। ঘর থেকে বেরনোরও সাহস নেই। আলো জ্বালিয়ে বসে রইলাম। অনেকক্ষণ পরে দেখি এক প্রহরী এসে দরজার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। তাকে কিছু বলব ভেবে উঠলাম, কিন্তু তার চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার সাহস জাগল না, তাঁর ধূসর চোখ যেন অনেক ভাষা বহন করছে। আমার সব কথাই যেন সে জানে।

যা হোক, অনেক সাহস করে বললাম যে, আর কেউ আছে? সে গম্ভীর গলায় কাটা কাটা হিন্দিতে বলল— না নেই। আর আপনি ঘরের বাইরে বেরবেন না। তার গলার আওয়াজে এত দৃঢ়তা ছিল যে আমি আর কথা বলার মতো জায়গায় রইলাম না। সারারাত ওই আলো জ্বালিয়ে বসে রইলাম। অনেক চেষ্টা করেও, মনসংযোগ বাড়িয়েও আর ওই শব্দ শুনতে পেলাম না। তবে জানলাটা আমাকে স্বস্তি দিচ্ছিল না। একটা গা-ছমছমে পরিস্থিতির মধ্যে দিয়েই কোনওরকমে কেটে গেল সারাটা রাত। মনে হল কারোর অস্তিত্ব রয়েছে জানলার কাছে। থমথমে নীরব অস্তিত্ব৷ কেউ একটা আমাকে পর্যবেক্ষণ করছে। আমার মাথা ঝিমঝিম করছিল, বুকের মধ্যে দুরুদুরু ভাব আর আশা কখন ভোর হবে। যখন ভোরের আলো ফুটল ভাবলাম এবার শোওয়া যাক। চোখে মুখে জল দিয়ে শুয়ে পড়লাম—ভাবলাম একটু ঘুমিয়ে নেওয়া যাক। যেই চোখ বুজলাম আবার কানে বাজল সেই ঘুঙুরের শব্দ— মনে হল যেন দূর-দূরান্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। ঘুম আর হল না; উঠে পড়লাম সেই অতিথি পরিচর্যার ভার যে মানুষটার ওপরে ছিল, তার ডাকে। চা এনেছে। ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বললাম, বোসো, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি। সে বলল— বলুন ম্যাডাম। বললাম, এখানে তোমরা কোনও আওয়াজ শুনতে পেয়েছ কখনও? সে তার দেহাতি হিন্দিতে যা যা বলল, বাংলায় তার অর্থ হল এইরকম— হ্যাঁ, ওরকম কত আওয়াজই আসে; চিৎকার, ঘুঙুরের আওয়াজ ইত্যাদি। একসময় অনেক বাইজি নাচ হত, তাদের কাউকে কাউকে যমুনার জলে ফেলে দিয়ে মারা হয়েছে। তাই এগুলো মাঝেমধ্যে শোনা যায়। তবে কারও কোনও ক্ষতি হয় না। আমি বললাম, ও তাই বুঝি! আর কিন্তু কিছু বললাম না। শুধু বললাম, কাল ওই জানলাটা একটা কাগজ দিয়ে আটকে দিতে। আর পর্দাটা একটু ভারী হলে ভালো হয় বা পর্দাটা দরজার সাথে আটকে দিতে। সে বলল, সারাদিনে সে ওই কাজটা করে রাখবে। পরদিনও সারাদিন নিজের পড়াশুনার কাজকর্ম করে যখন ফিরলাম আমার ওই অতিথি আবাসে, তখন সময় বিকাল ৪টে। কিন্তু ওই ঘরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে আবার মনে পড়ে গেল গত রাতের কথা। মনে হল রাত ৮টা পর্যন্ত তো সব ঠিক আছে, কিন্তু যেইমাত্র সবাই চলে যাবে আবার তো একা হয়ে যাব আমি। একটা ভয় আমার মাথায় চেপে বসল। তবে ঠিক করলাম আজ রাতে আলো জ্বালিয়েই শোব। প্রতিদিনের মতো ‘শো’ চলল; শব্দ ও আলোর খেলায় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটল আবার।

বন্ধুরা, বললে তোমরা হয়তো বিশ্বাস করবে না, আমি আরও চারদিন ওই অতিথি নিবাসে ছিলাম, কিন্তু ওইরকম কোনওকিছুই আর শুনিনি। ছোটবেলা থেকেই ভূত-প্রেত-এ আমার তেমন বিশ্বাস নেই, কিন্তু সেদিন রাতের ওই অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা আমি কোনওদিনই ভুলতে পারিনি। পরে ভেবেছি হয়তো আমার মনের ভুল। কিংবা সারাদিনে ইতিহাসের গল্প শুনে কিংবা মানসপটে সেগুলোর দৃশ্যায়ন করতে করতেই আমার অমন ধারণা বা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল।

তবে যাই হোক, সে রাতের কথা আজও ভাবলে আমার শরীর শিহরিত হয়। সে রাতের সেই অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতের জন্য মানসিকভাবে আমার দৃঢ়তা আরও বাড়িয়েছিল। আর ওই দূর্গাবশেষে রাতে না থাকলে বোধহয় ওই রোমাঞ্চকর অনুভূতি আমি কখনই অর্জন করতে পারতাম না। পরে কতবার শোনবার চেষ্টা করেছি সেই ঘুঙুরের শব্দ, কিন্তু না, আর পেলাম না। জানলাটা কাগজ মেরে বন্ধ করা ছিল। পরের কয়েকদিন ঘুম ভেঙে যখন চোখ খুলতাম, দেখতাম ভোরের আলো আর শুনতাম পাখির ডাক।