Categories
ইতিহাসতলা |

প্রথম চিড়িয়াখানার গল্প

1308 |
Share
| ২২ নভেম্বর, ২০২০
কুবলয় বসু

কবি ও ইতিহাসের শিক্ষক

(বাঁদিক থেকে) ব্যারাকপুর চিড়িয়াখানার কচ্ছপ অদ্বৈত; (পাশের ছবি) চার্লস ডি অলির আঁকা ব্যারাকপুর চিড়িয়াখানা। চিত্র সৌজন্য: Wikipedia and British Library

চিড়িয়াখানায় যেতে আমাদের কার না ভাল লাগে! শীতকালে রোদের আরাম মেখে ঘুরে ঘুরে জন্তু-জানোয়ার, পাখি দেখা। তারপর খেয়েদেয়ে বাড়ি ফেরা। এই যে আলিপুরে বিশাল চিড়িয়াখানায় এখন আমরা যাই, এই চিড়িয়াখানা কিন্তু অনেক পরে তৈরি। তাহলে এর আগে কি কোনও চিড়িয়াখানা ছিল? অবশ্যই ছিল। আজ সেই গল্পই বলব।

কলকাতার কাছেই এক শহর ব্যারাকপুর। এর আগের নাম ছিল চাণক। এর সঙ্গে কিন্তু কোনওভাবেই কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা জোব চার্ণকের সম্পর্ক নেই। ট্রেনে শিয়ালদা থেকে ব্যারাকপুর মাত্র চল্লিশ মিনিট লাগে। এই ব্যারাকপুরেই তৈরি হয়েছিল ভারতের, বা বলা ভাল এশিয়ার প্রথম চিড়িয়াখানা। ব্যারাকপুর সে সময়, অর্থাৎ ব্রিটিশ আমলে বড়লাটদের, যাঁদের আমরা ইতিহাসে গভর্নর জেনারেল নামে চিনি, তাঁদের সপ্তাহের শেষে গঙ্গার ধারে ছুটি কাটানোর চমৎকার জায়গা। এই বড়লাটদের মধ্যে লর্ড ওয়েলেসলি (১৭৯৮ থেকে ১৮০৫ অবধি গভর্নর জেনারেল ছিলেন) প্রথম উদ্যোগ নেন ব্যারাকপুরে একটি পশুশালা তৈরি করতে। বিচিত্র সব প্রাণীর সমাহার ছিল এখানে। এদের দেখভালের জন্য ওয়েলেসলি ১৮০০ সাল থেকে ১৮০৪ সালের মধ্যে খরচ করেছিলেন প্রায় তিন হাজার টাকা। কী কী প্রাণী ছিল এই পশুশালায়? জানতে তো ইচ্ছা করবেই!

সমাচার দর্পণ নামে এক পত্রিকা থেকে আমরা জানতে পারছি যে, সেখানে ছিল বিভিন্ন প্রকারের হরিণ, বাঘ। তার মধ্যে ছিল একটি কালো রঙের চিতা। ছিল সিংহ-ও। তাছাড়া ছিল ক্যাঙারু, গণ্ডার, ভালুক, বানর ইত্যাদি। অর্থাৎ, আজ থেকে প্রায় দু’শো বছর আগে এক জমজমাট চিড়িয়াখানা গড়ে উঠেছিল ব্যারাকপুরে। এই শহরে ‘চিড়িয়ামোড়’ নামের জায়গাটি আজও সেই চিড়িয়াখানার সাক্ষ্য বয়ে নিয়ে চলেছে।

ওয়েলেসলি কার্যকালের মেয়াদ শেষ করে দেশে ফিরে গেলে চিড়িয়াখানা কার্যত তার গুরুত্ব হারাতে শুরু করে, যদিও সে চিড়িয়াখানা টিকে ছিল বহাল তবিয়তেই। বিভিন্ন তথ্য থেকে সে প্রমাণ আমরা পাই। ১৮০৯-১০ সাল নাগাদ এই চিড়িয়াখানায় ছিল পেলিক্যান, ফ্লেমিংগো ইত্যাদি। লর্ড হেস্টিংস গড়ে তুলেছিলেন দু’টি পক্ষীশালা। পরবর্তীকালের আরেক বড়লাট লর্ড আমহার্স্টের সময়েও ছিল তিব্বতের বাইসন, দক্ষিণ আফ্রিকার গাধা এইসব পশু। কিন্তু দেখভালের অভাবে কিছু কিছু পশু দান করে দেওয়া হতে থাকে দেশের বিভিন্ন রাজাদের। পরের এক বড়লাট উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক চিড়িয়াখানার ব্যাপারে একেবারেই উৎসাহিত ছিলেন না। তিনি সব রকমের খরচ বাঁচিয়ে চলতে চাইছিলেন। তাই তিনিও কিছু কিছু জন্তু-জানোয়ার বিলিয়ে দিতে শুরু করেন।

ব্যারাকপুরের চিড়িয়াখানার সুদিন কিছুটা হলেও আবার ফিরে আসে লর্ড অকল্যাণ্ডের আমলে (১৮৩৬-৪২)। বিশেষত অকল্যাণ্ডের দুই বোন রীতিমতো উৎসাহের সঙ্গে চিড়িয়াখানাকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে শুরু করেন। চীন দেশ থেকে কিছু পাখি আনানোর ব্যবস্থা করেন তাঁরা। অকল্যাণ্ডের বোন এমিলি ইডেনের লেখা থেকে জানা যায়, সেই চিড়িয়াখানায় ছিল বেবুন, জিরাফ, গণ্ডার, ভাল্লুক-সহ আরো অনেক পশুপাখি। ছিল বিশালাকৃতির এক কচ্ছপ। যার নাম অদ্বৈত। সেই কচ্ছপকে পরে আনা হয় আলিপুর চিড়িয়াখানাতেও। সেটির মৃত্যু হয় ২০০৬ সালে। কেউ বলেন তার বয়েস ২৫০ বছর, কেউ বা বলেন ৩০০ বছর!

লর্ড ওয়েলেসলির চিড়িয়াখানার মেয়াদ ক্রমশ ফুরিয়ে আসতে থাকে। ১৮৫৭ সালে সিপাই বিদ্রোহের সময়েও অস্তিত্ব ছিল এই চিড়িয়াখানার। কিন্তু ব্যারাকপুরে এতো রকমের জীবজন্তু রাখার জন্য ক্রমশ স্থান সঙ্কুলান হওয়ায় আলিপুরে খুঁজে পাওয়া গেল নতুন জায়গা। ১৮৭৬ সালে চিড়িয়াখানা সরে গেল সেখানে, লর্ড লিটনের আমলে (১৮৭৬-১৮৮০)।

পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে ব্যারাকপুরের চিড়িয়াখানার বিভিন্ন অংশ। সেসব জায়গা ক্রমশ চাপা পড়ে যায় জঙ্গলে। এখন সেখানে আর ঢোকা যায় না। ঢুকতে গেলে লাগে সরকারি অনুমতি। যদিও চিড়িয়াখানার বিভিন্ন স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ ছাড়া আর কিছুই দেখার নেই। কিছু কিছু অংশ ভেঙে তৈরি হয়েছে সরকারি অফিস। বেশির ভাগটাই চাপা পড়ে আছে ঘন জঙ্গলে। এইভাবেই হারিয়ে গেছে সেদিনের হইহট্টগোলে ভরা এশিয়ার প্রথম তথা বিশ্বের চতুর্থ চিড়িয়াখানার সমস্ত অস্তিত্ব।

ঋণ: ১। কলকাতা- শ্রীপান্থ ২। ইতিহাসের শহর বারাকপুর- কানাইপদ রায় ৩। আনন্দবাজার পত্রিকা ৪। উইকিপিডিয়া