কাগজে পড়লুম ভারত তথা পৃথিবীর অন্যতম সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রিকেট অলরাউণ্ডার কপিল দেবের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। মনে পড়ে গেল ১৯৮৩ সালে সারা পৃথিবীর ক্রিকেট বিশ্বে হার্ট অ্যাটাক ঘটিয়ে ছিলেন এই মানুষটি। আমি তখন ইংল্যান্ডে। একদিনের ক্রিকেট বিশ্বকাপ তখন সেখানে হচ্ছে।
এর আগে দু’বার বিশ্বকাপ হয়েছিল ইংল্যান্ডে— ১৯৭৫ আর ১৯৭৯ সালে। আর দু’বারই জিতেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এবারেও তারাই ফেভারিট আর তাদের গ্রুপেই পড়ল ভারত। তখন ছিল ৬০ ওভারের খেলা, এখনকার মতো ৫০ ওভার নয়। ভারত এর আগে বিশ্বকাপে মাত্র একটা ম্যাচ জিতেছিল। হারিয়েছিল ইস্ট আফ্রিকাকে। তাই এবারের বিশ্বকাপে ভারতকে সবাই এলেবেলে ভেবেছিল। আর সেই ভেবেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ গ্রুপ ম্যাচের প্রথম খেলায় ভারতের কাছে হেরে গেল। ভারত এরপর জিম্বাবোয়ে আর অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দিল কিন্তু ফিরতি ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভারতকে সহজেই হারিয়ে প্রতিশোধ নিল। তারপরে সেই অলৌকিক খেলা। জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে ফিরতি ম্যাচে ভারত প্রথমে ব্যাট করতে নেমে সুনীল গাভাসকার সহ চারজন ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে স্কোর করল ৯ রানে ৪ উইকেট। একটু পরে হল ১৭ রানে ৫ উইকেট। অধিনায়ক কপিল দেব মাঠে নামলেন। মাঠের দর্শকরা তখন ভাবছেন লাঞ্চবক্সটা হয়তো বাড়ি গিয়েই খুলতে হবে। কিছু পরে রান হল ৭ উইকেটে ৭৮। তারপরে শুরু হল সেই বিধ্বংসী খেলা। ১৬টা বাউন্ডারি আর ৬টা ওভার-বাউন্ডারি মেরে কপিলদেব করলেন ১৭৫ নট আউট। ভারতের রান হল আট উইকেটে ২৬৬। জিম্বাবোয়ে হারল ৩১ রানে। অধিনায়কের এইরকম খেলায় অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতীয় দলের সবাই দুর্দান্ত খেলে আবার একটা চমক দিল সেমিফাইনালে শক্তিশালী ইংল্যান্ডকে হারিয়ে। ইংল্যান্ডের মুখ চুন। ইংল্যান্ডের ক্যাপ্টেন বব উইলিস আর ভাইস ক্যাপ্টেন ডেভিড গাওয়ার প্রশংসা করলেও ইংল্যান্ডের খবরের কাগজ ভারতকে মোটেও প্রশংসা করেনি। বলেছিল ফাইনালটা খুবই সাধারণ হয়ে গেল কারণ ভারত তো গোহারান হারবে।
ফাইনালের দিন আমাদের নেমন্তন্ন ছিল আমার মামার বাড়িতে। সেখানে একটা ছোট টিভিতে খেলা দেখছিলুম। লর্ডসের মাঠে খেলা। টসে জিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভারতকে ব্যাট করতে পাঠাল। ভারতীয় দলে খেলেছিলেন গাভাসকার, শ্রীকান্ত, অমরনাথ, যশপাল শর্মা, সন্দীপ পাতিল, কপিল দেব (অধিনায়ক), কীর্তি আজাদ, রজার বিনি, মদনলাল, সৈয়দ কিরমানি (উইকেটকিপার), বলবিন্দার সিং সান্ধু। ওদের দলের সাংঘাতিক সব পেস বোলার যেমন— মাইকেল হোলডিং, ছ’ফুট সাত ইঞ্চি লম্বা দৈত্যের মত জোয়েল গার্নার, অ্যান্ডি রবার্টস— আগুনের গোলার মত বল করতে লাগল। ভারত প্রথমে ব্যাট করে মাত্র ১৮৩ রানে আউট হয়ে গেল। একমাত্র উল্লেখযোগ্য কৃষ্ণমাচারী শ্রীকান্তের ৩৮ রান আর মোহিন্দর অমরনাথের ২৬ রান আর সন্দীপ পাতিলের ২৭ রান। সবাই ধরেই নিল যে ওয়েস্ট ইন্ডিজ খুব সহজেই জিতে যাবে। বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যান ওদের দলে। গর্ডন গ্রিনিজ, ডেসমন্ড হেইনস, ভিভ রিচার্ডস, ক্লাইভ লয়েড প্রমুখ।
ভারতের ইনিংসের পরে অধিনায়ক কপিলদেব বললেন— হ্যাঁ, আমরা বেশি রান করতে পারিনি বটে কিন্তু আমরা লড়ে যাব। সাংবাদিকরা একটু মুচকি হাসলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্যালিপসো বাজনা তখন পুরো দমে বাজছে। কিন্তু সুয়িং বল করে সান্ধু প্রথমেই গ্রিনিজকে বোল্ড আউট করে দিলেন। এরপর চুয়িং গাম চিবোতে চিবোতে ভিভ রিচার্ডস মাঠে নামলেন। সবাই বলতো কিং রিচার্ডস। ভিভ নেমেই মারতে লাগলেন। ওদের রান হল ৫০ আর তারপরেই মদনলাল আউট করলেন হেইনসকে। তখনও সবাই বলছে এবার ক্লাইভ লয়েড আর ভিভ খেলা শেষ করে দেবে। তখন আবার সেই কপিল দেবের কেরামতি। মদনলালের ডেলিভারি, ভিভ শট মেরে বল আকাশে তুললেন। কপিলদেব অবিশ্বাস্য ভাবে ২৫ গজ পেছন দিকে দৌড়ে সেই ক্যাচ ধরলেন। ভিভ ২৮ বলে ৩৩ রান করলেন। ভারতের মিডিয়ম পেস সুইং বোলিং ওয়েস্ট ইন্ডিজ খেলতেই পারল না। ৫২ ওভারে মাত্র ১৪০ রানে আউট হয়ে গেল। মাঠে ক্যালিপসো মিউজিক বন্ধ হয়ে গেল। ‘ভারত জিন্দাবাদ’ শোনা যাচ্ছে তখন। মোহিন্দর অমরনাথ সাত ওভারে মাত্র ১২ রান দিয়ে তিন উইকেট নিয়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হলেন। মদনলালও তিন উইকেট নিয়েছিলেন। এছাড়া কীর্তি আজাদ আর সান্ধুও ভাল বল করেছিলেন।
বিশ্বকাপ জিতে আমাদের আনন্দ তখন দ্যাখে কে! সব জায়গায় হৈচৈ পড়ে গেল। এমন একটা বিস্ময়কর ঘটনা ঘটল যে আমার দশ বছর বয়সী ছেলের স্কুলের ইংরেজ বন্ধুরাও এই নিয়ে কথা বলেছে। কপিলদেবের নেতৃত্বে আর অসামান্য দক্ষতায় অনুপ্রাণিত হয়ে দলের সবাই দুর্দান্ত খেলে ভারতকে এনে দিলেন প্রথম বিশ্বকাপ।