Categories
খেলার মাঠ |

ফুটবলের রাজপুত্র মারাদোনা

814 |
Share
| ২২ ডিসেম্বর, ২০২০
বিশ্বজিৎ দে

রেডিও উপস্থাপক ও ক্রীড়া-উৎসাহী

চিত্র: (বাঁদিকে) ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে মারাদোনা; (পাশে) ১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপ জয়ের মুহূর্তে। চিত্র সৌজন্য: Wikipedia

আমাদের পঞ্চান্ন জনের পরিবারে তখন তিনটে মাত্র টিভি। দুটো সাদাকালো আর একটা রঙিন। বাড়ির ওই তিনটে টিভির সামনেই আমাদের তখন বিশ্বদর্শন। তবুও বাবার আফসোস ছিল ১৯৮৩-র কপিলের বিশ্বজয় দেখা হয়নি। তাই ১৯৮৪-র অলিম্পিকের সময় বাবা টিভি কেনেন। রঙিন, একুশ ইঞ্চি, বিদেশি কোম্পানি এবং বাড়ির প্রথম রঙিন টিভি। বাবার সাথেই রাত জেগে ফুটবল বিশ্বকাপ দেখা শুরু আর ১৯৮৬-র বিস্ময়কর প্রতিভা মেক্সিকোর মাঠে মারাদোনাকে চেনা। যার খেলা দেখে বাবার আফসোস অনেকটাই মিটে গিয়েছিল। আমাদের টিভির স্ক্রিন তখন মেক্সিকোর মাঠ আর আমরা সবাই যেন গ্যালারিতে বসে। জ্যাঠা-কাকারা তখন মারাত্মক মারাদোনাকে দেখে উন্মাদনায় টিভির দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। মাঝরাতে আমাদের বসার ঘরে তখন দিওয়ালির আলো, কালীপুজোর আতস বাজি। বারবার বাবা চিনিয়ে দিচ্ছেন মারাদোনাকে। বিস্ময়ের চোখে দেখছি জীবনের প্রথম বিশ্বকাপ ফুটবল। পরিচিত হচ্ছি নীল-সাদা দশ নম্বর জার্সির সাথে আর ঘরে বসেই চিনে নিচ্ছি একটা দেশ। যে দেশের মুখ হয়ে ওঠে একটা মানুষ। মারাদোনা আর আর্জেন্টিনা তখন সমার্থক। আমাদের বসার ঘর আর বুয়েনোস আইরেসের মাঝে সেতু এই ৫ ফুট ৫ ইঞ্চির বিদ্যুৎ গতির— মারাদোনা।

বিস্ময়ের সেই শুরু, সাথে প্রেমে পড়ারও। মারাদোনার শুরুটাও যে বিস্ময়কর তা আর নতুন করে বলার নয়। মারাদোনার জন্ম ৩০ অক্টোবর, ১৯৬০ সালে। তাঁর বড় হওয়া ভিল্লা ফিয়োরিতো নামক বুয়েনোস আইরেসের এক দরিদ্রতম অঞ্চলে।

মাত্র তিন বছর বয়সে মারাদোনা তাঁর কাকা সিরিলোর কাছ থেকে একটি ফুটবল উপহার পান। ওটার সঙ্গেই তাঁর সময় কাটতে থাকে। তাঁর যখন মাত্র ৮ বছর বয়স, তাঁকে একটি ধূলিধুসর মাঠে খেলতে দেখেন ফ্রান্সিস কর্নেইও (Francis Cornejo)। তিনি ছোট্ট মারাদোনার খেলা দেখে তাঁকে কাছে ডেকে নেন এবং তাঁর ট্রেনিং-এ থাকার পরে ১৯৭০ সালে মাত্র ১০ বছর বয়সে মারাদোনা আর্জেন্টিনস জুনিওরস ক্লাব বা লস সেবোলিতাসে (Los Cebollitas—Little Onions) জায়গা করে নেয়। সেবোলিতাসকে ১৩৬ টি ম্যাচে অপরাজিত রেখেছিলেন মারাদোনা। তখন থেকেই তাঁকে বলা হত ‘গোল্ডেন বয়’। বড়দের ফার্স্ট ডিভিশন ম্যাচের ফাঁকে, হাফ-টাইমের সময় ১২ বছরের মারাদোনা মাঠের দর্শকদের আনন্দ দিত ফুটবল নিয়ে নানারকমের খেলা দেখিয়ে। সেই সময় থেকেই তাঁর ফুটবলের ওপর কন্ট্রোল দেখে বিস্মিত হত দর্শকরা।

এরপর ১৯৭৬ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে আর্জেনটাইন প্রিমেরা ডিভিশনে তাঁর খেলা শুরু ১৬ নম্বর জার্সি গায়ে। তাঁর প্রথম ক্লাব—আর্জেন্টিনোস জুনিওরস (Argentinos Juniors)। আর্জেনটাইন প্রিমেরা ডিভিশন (Argentine Primera División) আর্জেন্টিনার প্রোফেশনাল ফুটবল লিগ। সেইখানে ওই বয়সে খেলতে পারাটা সহজ কথা ছিল না। প্রিমেরা ডিভিশনের ইতিহাসে মারাদোনা ছিলেন কনিষ্ঠতম খেলোয়াড়। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তিনি আর্জেন্টিনোস জুনিওরস-এর হয়েই খেলেন। ১৬৭টি ম্যাচে ১১৫টি গোল করেন।

১৯৭৭ সালে তিনি আর্জেন্টিনার জাতীয় দলে নির্বাচিত হন এবং ভেনেজুয়েলাতে অনুষ্ঠিত সাউথ আমেরিকান ইউথ চ্যাম্পিয়ানশিপে অংশগ্রহণ করে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াপ্রেমীদের নজর কাড়েন। মজার কথা হল, সেই টুর্নামেন্টে মারাদোনা ৯ নম্বর জার্সি পরে খেলেছিলেন। এর পরের বছর, ১৯৭৮-এ, ফিফা ওয়ার্ল্ডকাপের জন্যে যখন জাতীয় দলের নির্বাচন করা হয়, সেই নির্বাচন থেকে বাদ পড়ে যান মারাদোনা। পরে মারাদোনা বলেছেন, ‘আমি যখন নির্বাচিত হলাম না, তখন ভীষণ কেঁদেছিলাম’। কিন্তু মারাদোনা ভেঙে পড়েন নি।

১৯৭৮ থেকে ১৯৮০-র মধ্যে মারাদোনা দু’বার আর্জেন্টিনার দুটো চ্যাম্পিয়নশিপ— মেট্রোপলিটান ও ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপে পাঁচবার পরপর টপ স্কোরার হন।

১৯৭৯ সালে জাপানে অনুষ্ঠিত ফিফা ওয়ার্ল্ড ইউথ চ্যাম্পিয়নশিপে মারাদোনা শ্রেষ্ঠ প্লেয়ার হিসেবে পান ‘গোল্ডেন বল’ এবং আর্জেন্টিনার হয়ে জিতে আসেন ফিফা জুনিয়র বিশ্বকাপ।

এরপর ১৯৮১ সালে তিনি আর্জেন্টিনোস জুনিওরস ছেড়ে যোগদান করেন আরেকটি দলে— তাঁর বাবার প্রিয় দল বকা জুনিওরস।

১৯৮২ সালে তিনি আর্জেন্টিনার জাতীয় দলে নির্বাচিত হন এবং ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপে অংশগ্রহণ করার জন্যে স্পেনে যান। আর্জেন্টিনা সেবার বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডেই পরাজিত হয়ে ফিরে আসে। কিন্তু মারাদোনা থেকে যান। তিনি স্পেনে বার্সেলোনা ক্লাবে যোগদান করেন। তিনি বার্সেলোনা ক্লাবকে পাইয়ে দিয়েছেন কপা ডেল রে আর স্প্যানিশ সুপার কাপ।

১৯৮৪ সালে বার্সেলোনা ক্লাবে একটি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে, সেই ক্লাব ছেড়ে তিনি যোগ দেন ইতালির নাপোলি ক্লাবে। ইতালির এই ক্লাব নাপোলিতে তিনি তাঁর জীবনের সেরা ফুটবলটি উপহার দেন। ১৯৮৭ এবং ১৯৯০-তে নাপোলি ইতালি লিগে চ্যাম্পিয়নও করেন, ১৯৮৯ জেতান উয়েফা কাপ। যে বছর প্রথমবার নাপোলি ইতালিও লিগ জেতে, সেই বছর বিজয়োৎসব চলেছিল টানা পাঁচ দিন ধরে। ততদিনে বিশ্ব চিনে নিয়েছে তাঁর বল ধরা, বুদ্ধিদীপ্ত পাস আর ‘nutmeg’ অর্থাৎ বলটাকে তাঁর বিপক্ষ খেলোয়াড়ের পায়ের ফাঁক দিয়ে বের করে তাকে বোকা বানানোর কৌশল।

নাপোলিতে যোগ দেবার পর দু’বছরের মাথায় আসে বিশ্বকাপ।

১৯৮৬-র বিশ্বকাপকে বলা হয় মারাদোনার বিশ্বকাপ। একা একটা দলকে কীভাবে চ্যাম্পিয়ন করতে হয় তা মারাদোনা ছাড়া আর কেউ জানতেন না। এই বিস্ময়কর প্রতিভা ইংল্যান্ডের সাথে কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচে দুটো গোল করেন মাত্র চার মিনিটের ব্যবধানে। মাত্র ২৪০ সেকেন্ডের মধ্যে মারাদোনা ঠিক করে দেন ম্যাচের ভাগ্য। এই ম্যাচে নামবার আগে ইংল্যান্ড এবং আর্জেন্টিনার মধ্যে ফকল্যান্ড যুদ্ধ শেষ হয় ঠিকই, কিন্তু সম্পর্ক তখনও উত্তপ্ত। এইখানে একটু এই যুদ্ধের ইতিহাসটা জেনে নেওয়া যাক।

১৮৪১ সাল থেকেই দক্ষিণ অ্যাটলান্টিক সাগরের ফকল্যান্ড দ্বীপমালা ব্রিটেনের দখলে। ১৯৮২ সালের ২রা এপ্রিল আর্জেন্টিনা ঢুকে পড়ল ওই দ্বীপমালা দখল করতে। আর্জেন্টিনার এই আগ্রাসনকে ব্রিটিশ সেনারা রুখে দেয় এবং ওই বছরের ১৪ জুন আর্জেন্টিনার সৈন্যদের আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে। এই যুদ্ধে হেরে যাওয়ার প্রতিশোধ যে মারাদোনার দল তুলবে সেই স্বপ্নই দেখছিল গোটা দেশবাসী। সেটাই আন্দাজ করতে পেরে ইংল্যান্ড দলের কোচ ববি রবসন বলেছিলেন ‘মারাদোনাকে আমরা মার্কিং করব না। কিন্তু ও বল পেলেই ঘিরে ধরতে হবে। এই ছেলেটা চার মিনিটে খেলার ভাগ্য গড়ে দিতে পারে’। কী আশ্চর্য! রবসনের এই ভবিষ্যৎবাণী মিলে গেল অক্ষরে অক্ষরে। মাত্র ওই চার মিনিটের ব্যবধানে বিশ্ব দেখল একটি ফুটবলারের মধ্যে একই সাথে শয়তান এবং দেবতার দুই রূপ।

চৌত্রিশ বছর আগেকার সেই গোল এখনও জীবন্ত। নিজের অর্ধে বল ধরলেন মারাদোনা, তারপর শিল্পীর নিপুণতায় বলটা রোল করে এগিয়ে চললেন ইংল্যান্ডের গোলের দিকে। পিটার বিয়াডারস্লে, টেরি বুচার, পিটার রিড, টেরি ফেনউয়িককে টপকে নিজের ক্ষিপ্রতায় ফুটবলের রাজপুত্র পৌঁছে গেলেন একেবারে ব্রিটিশ গোলরক্ষক পিটার শিলটনের কাছে। একটা শেষ চেষ্টা করেছিলেন টেরি বুচার, কিন্তু কোনও চেষ্টাই মারাদোনার পায়ের পোষমানা বলকে আর আটকাতে পারল না। ডান পা থেকে বাঁ পায়ে বল নিয়ে এগিয়ে আসা শিলটনকে কাটিয়ে বল জড়িয়ে দিলেন জালে। সেই গোল হয়ে রইল শতাব্দীর সেরা গোল— এখনও যে গোল ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বারবার দেখি আর আবার দেখার ইচ্ছে রাখি। যে গোল দেখে ম্যাচের ধারাভাষ্যকার বলে উঠেছিলেন ‘নিজেদের চোখে অলৌকিক দৃশ্য দেখলাম আমরা’। তবে এই অবিশ্বাস্য গোলের আগে মারাদোনা ঘটিয়ে ফেলেছিলেন ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত গোল। যে গোল ‘হ্যান্ড অফ গড’ বলে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। ম্যাচের ৫১ মিনিটের মাথায় ইংরেজ গোলকিপার পিটার শিলটনের মাথার ওপর দিয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত ব্যবহার করে গোল করেছিলেন মারাদোনা। যে গোলের পর ম্যাচ শেষের সাক্ষাৎকারে শিলটনের সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘কিছুটা মারাদোনার মাথা আর কিছুটা ঈশ্বরের হাত দিয়ে গোলটা হয়েছিল’। সেই গোল এরপরই হয়ে ওঠে ‘হ্যান্ড অফ গড’ গোল। এইসবের পরেও একার দক্ষতায় মারাদোনা চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন আর্জেন্টিনাকে আর আর শেষ হয়েছিল সে দেশের ৮৬-র বিশ্বকাপের এক স্বপ্নের সফর।

এর ঠিক চার বছর পর আবার মারাদোনা বিশ্বকাপের মঞ্চে। এবার আসর বসেছে ইতালিতে— ‘ইতালিয়া ৯০’। আমি ও আমার ভাইবোনেরা আরও কিছুটা বড় হয়েছি আর বাড়িতে বেড়েছে আরও কিছু টিভির সংখ্যা। কিন্তু ফুটবল বিশ্বকাপ মানে একটা টিভি, অনেক দর্শক। নব্বইয়ের দশকে এটাই ছিল রীতি আর খেলা দেখার আনন্দ। বিশ্বকাপ শুরুর অনেক আগেই হাতে এসে গেছে ম্যাচের ফিক্সচার। পেন্সিল কালার দিয়ে গোল এঁকে নিয়েছি আর্জেন্টিনার ম্যাচগুলো আর সাজিয়ে নিয়েছি আর্জেন্টিনার ম্যাচের দিন কতক্ষণ পড়ব আর কতটা রাত জাগব। কারণ একটাই— মারাদোনা। ফুটবলের রাজপুত্র একটা বিশ্বকাপ জিতে আরও একটা বিশ্বজয় করতে এবার দা ভিঞ্চির দেশে। ফুটবলের শৈল্পিক চর্চা তখন ভেনিস আর রোম ছাড়িয়ে প্রবেশ করেছে আমাদের পাড়ায়, আমাদের হেঁসেলে।

প্রথম ম্যাচ থেকেই মারাদোনা একেবারে টার্গেট। ক্যামারনের বিরুদ্ধে ওই ম্যাচে মনে হচ্ছিল মারাদোনা খেলছে একেবারে চক্রব্যূহের মধ্যে। রজার মিলার এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা এক ইঞ্চিও জায়গা ছাড়ছে না মারাদোনাকে। এই ম্যাচে ক্যামারন ১-০ গোলে জিতেছিল। কথায় আছে ‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’! ঠিক তাই হয়েছিল ওই বিশ্বকাপ জুড়ে। একটু ভারি হয়ে যাওয়া চেহারা, ম্যান মার্কিং আর ট্যাকেলের মাঝে মারাত্মক মারাদোনাকে আমরা ঠিক খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাও সেমিফাইনালে ইতালিকে ট্রাইব্রেকারে হারিয়ে আর্জেন্টিনা এবার ফাইনালে ক্লিন্সম্যান আর লোথার ম্যাথাউসের ওয়েস্ট জার্মানির মুখোমুখি। ওই ম্যাচে মারাদোনার দল হারে ০-১ গোলে। হাতছাড়া হয় পরপর বিশ্বকাপ জয়ের সোনার মুহূর্ত। টিভির ক্যামেরার সামনে মারাদোনার ওই কান্না ভেজা চোখ জানান দিয়েছিল হারের যন্ত্রনা কী! কান্না এতটাই ছোঁয়াচে যে সেই রাতে আমাদেরও চোখ ভিজে গিয়েছিল।

এই বিশ্বকাপের পরপরই নায়কের জীবন যেন একটু একটু করে অন্য দিকে মোড় নিতে শুরু করল। তিনি ডোপ পরীক্ষায় ধরা পড়ে পনেরো মাসের জন্য নির্বাসিত হলেন। ১৯৯৪-তে আমেরিকায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে আবার এলেন মারাদোনা তাঁর দল নিয়ে। কিন্তু এবারে সেই চমক, ড্রিবল আর ক্ষিপ্রতার ভীষণ অভাব নায়কের পায়ে। ক্যামেরার সামনে আসে তাঁর এফিদ্রন ড্রাগ নিয়ে ডোপ পরীক্ষায় তৃতীয়বার নিষিদ্ধ হওয়া। সব মিলিয়ে ফুটবল মাঠ জুড়ে দাপিয়ে বেড়ানো মারাদোনার মায়াজালের অভাব সারা বিশ্ব তীব্রভাবে অনুভব করছিল। ঠিক এইসবের পরেই মাত্র ৩৭ বছর বয়সে তাঁর নিজের জন্মদিনে ফুটবল থেকে অবসরের ঘোষণা করে দেন দিয়েগো আরমান্দ মারাদোনা।

আরও একটি দিক উল্লেখ না করলে এ লেখা সম্পূর্ণই হবে না— মারাদোনার সাথে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রর গভীর বন্ধুত্ব। সবে বিশ্বকাপ জিতে দেশে ফিরে কিউবা সফর করতে গেলেন মারাদোনা আর সেখানেই প্রথম সাক্ষাৎ তাঁর কাস্ত্রর সাথে। কাস্ত্রর বিপ্লবী জীবনের ঘটনা শুনে মারাদোনা মজে গেলেন। শুরু হল দুই প্রান্তের মানুষের এক রূপকথার বন্ধুত্ব। এই বন্ধুত্ব ৯০-এর দশকের মাঝামাঝি আরও পোক্ত হল যখন কাস্ত্র ফুটবল থেকে নির্বাসিত হওয়া মারাদোনাকে হাভানার ‘লা পেদ্রেরা’ ক্লিনিকে চিকিৎসার জন্য জায়গা করে দিলেন। সেই সময় মারাদোনা কাস্ত্রর উদ্দেশে বলেছিলেন ‘আজ আমি বেঁচে আছি আমার দ্বিতীয় পিতার জন্য’। সময় অনেক কিছু মিলিয়ে দেয়, যেভাবে মিলিয়ে দিল কাস্ত্র আর দিয়েগোর মৃত্যুদিন। দুজনেরই প্রয়াণ দিবস সেই ২৫শে নভেম্বর।

আর্জেন্টিনার হয়ে ৯১ টি ম্যাচে ৩৪ টি গোল করেছেন তিনি। তাঁর ফুটবল কেরিয়ারে ৪৯১ টি ম্যাচ খেলে মোট ২৫৯ গোল করেছিলেন তিনি। বারবার তাঁর তুলনা হয়েছে কিংবদন্তী পেলের সাথে। কে বড় ফুটবলার?— এই প্রশ্ন বারবার পৃথিবী জুড়ে ফুটবলপ্রেমীরা করে গিয়েছেন এবং একবার তার জবাবে আর্জেন্টিনার জনতা ভোট দিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে মারাদোনাই বড়, তবে ফিফা দুজনকেই সম্মানিত করেছিল। ব্রাজিলের কিংবদন্তী ‘পেলে’ তাই মারাদোনার মৃত্যুর শোকজ্ঞাপনের শেষ লাইনে লিখেছিলেন— ‘কোনও একদিন আকাশের বুকে আমরা ফুটবল খেলব’। এ তো এক কিংবদন্তীর হাহাকার অন্য কিংবদন্তীর জন্য! এই আকুল কান্না ফুটবল মাঠ ছেড়ে চলে যাওয়া এক বিস্ময়কর প্রতিভার জন্য।

চারটে বিশ্বকাপ খেলে, আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জিতিয়ে, গোল্ডেন বল পেয়ে, শতাব্দীর সেরা ফুটবলার হয়ে, শতাব্দীর সেরা গোলের অধিকারী হয়ে বহুবার নানা বিতর্কের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছেন মারাদোনা। শেষের দিকে নিজের স্বাস্থ্য এবং ব্যক্তিগত জীবনকে ঠিক জায়গায় বেঁধে রাখতে পারেননি তিনি, যার জন্য নানাভাবে তাঁকে ভুগতে হয়েছে। ২০০৮ আর ২০১৭ সালে তিনি কলকাতায় আসেন। তাঁকে ঘিরে যে উন্মাদনা আর আকর্ষণ তখনও বর্তমান, তা তিনি টের পেয়েছিলেন সল্টলেক স্টেডিয়ামে জনসমুদ্রের ভিড় এবং সমর্থকদের উল্লাস দেখে। এখনও শহরের ফুটপাথে নীল-সাদা ১০ নম্বর জার্সি বিক্রি হয়। এখনও শহরের দেওয়ালে মারাদোনার বিরাট ছবি আঁকা থাকে। এখনও পাড়ার ফুটবল ম্যাচে পরোপকারী ছেলেটা মারাদোনার মত করে গোল করতে চায়। কারণ একটাই, শিল্প আর প্রতিভার কোনও সীমানা থাকে না, সে জন্মায় শুধু হৃদয় জয় করার জন্য। লক্ষ লক্ষ হৃদয় জয় করে মারাদোনার ফুটবল মুনশিয়ানা আজও অমর এবং আগামীদিনেও অমর হয়েই থাকবে।

ঋণ: Wikipedia; fifamuseum.com; mercurynews.com; www.fundus.org