Categories
ভাষাপুকুর |

বাংলা ভাষায় প্রথম বই

501 |
Share
| ২৩ জানুয়ারী, ২০২২
কালিদাস দত্ত

চিত্র: সৌভিক গুহসরকার, ঋণ: এশিয়াটিক সোসাইটি

গল্প পড়তে আমাদের সকলেরই খুব ভাল লাগে, তাই না? কিন্তু এমন অনেক জিনিস আছে যা গল্পের মতই মজার।

যেমন ধরো, কেউ যদি বলেন, বাংলা ভাষাটা কোথা থেকে এল, কেমন ছিল এ ভাষা, এ ভাষায় প্রথম লেখা কেমন, কত কাল আগেই বা সে সমস্ত লেখা হয়েছে, তা হলে তোমাদের একটা উত্তর দিতে হবে তো?

উত্তর দিতে হোক বা না হোক, সকলেরই উচিত নিজের মাতৃভাষার ও সাহিত্যের উৎপত্তি ও গঠনের মোটামুটি একটা ইতিহাস জেনে রাখা। তারপর যখন আরও বড়ো হবে, তখন নিজেই কত খোঁজাখুঁজি করে পুঁথি-পত্তর যোগাড় করে পড়বে। যতই পড়বে ততই জানার ইচ্ছে বাড়বে।

আগে ভাষার কথাটা বলি সংক্ষেপে।

পৃথিবীর মধ্যে যতগুলি শ্রুতিসুখকর মধুর ভাষা আছে তার মধ্যে সংস্কৃত অন্যতম। এ ভাষা তেমন করে আমরা এখন পড়তেই ভুলে গেছি। তা ছাড়া চর্চাও কমে গেছে নানান কারণে। সে যাই হোক, এই সংস্কৃতেরই আদি সহজ রূপ ছিল বৈদিক সংস্কৃত অর্থাৎ যে সংস্কৃতে প্রথম বেদ গ্রন্থ ঋগ্বেদ লেখা হয়েছিল। এই বৈদিক সংস্কৃতই বাংলা ভাষার আদি উৎস।

মানুষের অন্যতম গুণ বা দোষ যা-ই বলো, একটা বিশেষ স্বভাব আছে। সেটা হল সব কিছু কাজকে সহজ করে আনা। বোধ হয়, আমাদের শরীরের মধ্যে জিভই একাজে পটু সবচেয়ে বেশি। শুধু পটু নয়, মহারাজ জিভ একটু অলসও বটে। শক্ত কথা উচ্চারণ করে তিনি সময় নষ্ট করতে চান না। শব্দগুলিকে নিজের সুবিধে মত ভেঙে-চুরে নিয়ে তবে তিনি উচ্চারণ করেন। যেমন ধরো, সংস্কৃতে ছিল ‘মৎস্য’, কিন্তু এত শক্ত কথা কে উচ্চারণ করে? তাই ওটাকে পরবর্তীকালে জিভ মশাই উচ্চারণ করলেন ‘মচ্ছ’। ঠিক তেমনি চন্দ্র হল চন্দ, প্রস্তর হল পত্থর, কৃষ্ণ হল কহ্ন, মৃত্তিকা হল মট্টিআ। ভাষায় এই ‘মচ্ছে’র যুগটাকে বলে প্রাকৃতের যুগ। আর বৈদিক সংস্কৃতের যুগকে বলা হয় প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার যুগ।

যাঁরা ভাষা নিয়ে মাথা ঘামান তাঁদের বলা হয় ভাষাতাত্ত্বিক বা ভাষাবিদ। এই ভাষাবিদদের মতে, ভারতবর্ষের চার কোণে বৈদিক সংস্কৃত বা বৈদিক আর্যভাষা বিবর্তিত হয়ে চার রকমের প্রাকৃতের সৃষ্টি হয়। যেমন, পূর্বভারতে মাগধী প্রাকৃত, মধ্যভারতে শৌরসেনী, মহারাষ্ট্রে মহারাষ্ট্রী এবং পশ্চিম ভারতে পৈশাচী প্রাকৃত।

বৈদিক আর্যভাষা বা সংস্কৃতের যুগের শুরু হয় এখন থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর আগে। প্রাকৃতের যুগ বা যাকে বলে মধ্যভারতীয় আর্যভাষা তার শুরু হয় প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে থেকে। এই প্রাকৃত ভাষা আরো ক্ষয়ে ক্ষয়ে সংক্ষিপ্ত হতে থাকে এবং ভেঙে-চুরে যেতে থাকে। সেই যুগটাকে বলা যেতে পারে অপভ্রংশের যুগ।

আমাদের বাংলা ভাষা এসেছে মাগধী অপভ্রংশ থেকে। এই মাগধী অপভ্রংশ থেকেই বাংলা ছাড়াও আসামী, ওড়িয়া, বিহারী, মৈথিলী ভাষার সৃজন হয়েছে।

এবার কতগুলি উদাহরণ দেব। তা থেকে বেশ বোঝা যাবে কেমন করে বৈদিক আর্যভাষা থেকে প্রাকৃত এবং তার থেকে বাংলা শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। যেমন ধরো, মৎস্য থেকে হয়েছে মচ্ছ এবং তার থেকে বাংলায় মাছ।
তেমনি হয়েছে,
১। অদ্য> অজ্জ> আজ।
২। আদিত্য> আইচ্চ> আইচ।
৩। কণ্টক> কণ্টঅ> কাঁটা।
৪। কদল> কঅল> কলা।
৫। কেতক> কেঅঅ> কেয়া।
৬। খাদ্য> খজ্জ> খাজা।
৭। ঘৃত> ঘিঅ> ঘি।
৮। চিপিটক> চিবিডঅ> চিড়া।
৯। ছেদনিকা> ছেঅনিআ> ছেনি।
১০। দেবকুল> দেঅউল> দেউল।
১১। প্রস্তর> পত্থর> পাথর।
১২। বাসগৃহ> বাসহর> বাসর।
১৩। মোদক> মোঅঅ> মোয়া।
১৪। রাজা> রাআ> রায়।
১৫। সর্প> সপ্প> সাপ।
১৬। হৃদয়> হিঅঅ> হিয়া, প্রভৃতি।

একটু লক্ষ্য করলেই দেখবে, এই পরিবর্তনগুলির মধ্যে যেন একটা বিশেষ নিয়ম আছে। হ্যাঁ, তা আছে। প্রধান একটা নিয়ম হল শব্দের শেষের ব্যঞ্জন বর্ণের লোপ ও মাঝের ব্যঞ্জন বর্ণের লোপ বা পরিবর্তন। র-ফলা, রেফ প্রভৃতির উচ্চারণে অসুবিধা, তাই ওগুলিকেও নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল। নিজের মনের ভাব সহজ সরল করে অন্যের মনে সঞ্চার করে দেওয়ার জন্যই মানুষ তার ভাষাকে নিরন্তর ভেঙেছে আর গড়েছে। তাই ভাষা সৃষ্টির ইতিহাসে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অবদানের চেয়ে সমগ্র সমাজের সামষ্টিক আকাঙ্ক্ষাতেই এর উদ্ভব হয়েছে।

আচ্ছা, এইভাবে যে বাংলা ভাষার প্রথম গঠন হল, সেই ভাষায় প্রথম সাহিত্য কেমন ছিল ? এবং সেটা কবে হয়েছিল?

আগেই বলেছি প্রাকৃতের যুগকে বলা হয় মধ্যযুগীয় ভারতীয় আর্যভাষার যুগ। প্রাকৃত অর্থাৎ সাধারণ মানুষের মুখের কথা। নদী যেমন কূল ভেঙে এঁকেবেঁকে এগোয়, সব কিছুর মত ভাষাও তেমনি ক্রমশঃই ভেঙেচুরে বদলায়। এই যুগের শেষের দিকে মাগধী প্রাকৃত ক্ষয়ে ক্ষয়ে হল মাগধী অপভ্রংশ। সেটা এখন থেকে প্রায় হাজার বছর আগের কথা। সে-ও দেখতে প্রায় অপভ্রংশের মতই, সবে খোলস ছেড়েছে। যখন হাঁটি হাঁটি পা-পা করে এই বাংলা ভাষা এগোচ্ছে তখনকার নিদর্শন কিছু পাওয়া গেছে। সে কথা পরে বলছি।
তার আগের অপভ্রংশ ভাষায় লেখা একটি কবিতার অংশ শোনাই—

ওগ্গর ভত্তা রম্ভঅ-পত্তা গাইক ঘিত্তা দুগ্ধ-সজুত্তা।
মোইনি-মচ্ছা নালিচ-গচ্ছা দিজ্জই কন্তা খায় পুনবন্তা।।

মানে কি? ঠিক কথার কথা মানে হল:
ওগ্গর= ওগ্গর মানে উগ্র মানে গরম, ভত্তা= ভাত, রম্ভঅ-পত্তা= কলাপাতা, গাইক ঘিত্তা= গাইয়ের ঘি, দুগ্ধ-সজুত্তা= সুযুক্ত দুধ (টাটকা দুধ), মোইনি-মচ্ছা= ময়না মাছ (সে সময়ে গ্রামে এই প্রকারের মাছ খাওয়া হত), নালিচ-গচ্ছা= নালচে শাক, দিজ্জই কন্তা= কান্তা অর্থাৎ বউ দিচ্ছে, খায় পুনবন্তা= পুণ্যবান খায়।

তাহলে কী হল পুরো ব্যাপারটা? গরম ভাত কলার পাতায় গাইয়ের ঘি দুধ ময়না মাছ নলচে শাক বধূ দিচ্ছে এবং পুণ্যবান খাচ্ছে।

মোটামুটি এ যে বাংলা ভাষার ঠিক আগের চেহারা এটা বুঝতে বিশেষ কষ্ট হয় না। এই শ্লোকটি চতুর্দশ শতকে সংকলিত অপভ্রংশ ছন্দের বিচার-পূর্ণ ‘প্রাকৃত-পৈঙ্গল’ নামের সংকলন গ্রন্থে আছে।

বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম গ্রন্থ কী? সে কথা কেউ বলতে পারেন নি আজও। কিন্তু প্রাচীনতম যে গ্রন্থটি পাওয়া গেছে, পণ্ডিতেরা বলেন সেটি লেখা হয়েছিল প্রায় হাজার বছর পূর্বে। গ্রন্থটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা’। ১৯১৬ খৃষ্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে গ্রন্থটি ছেপে প্রকাশ করা হয়।

এত যে বিখ্যাত এবং চিরস্মরণীয় এই গ্রন্থ—এটির আবিষ্কারের কাহিনি প্রায় রোমাঞ্চকর।

এখনকার মত আগে এমন সুন্দর কাগজও ছিল না, ছাপাখানাও ছিল না। পণ্ডিতেরা সব কিছুই পুঁথিতে লিখে রাখতেন। তালপাতার পুঁথি। প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর আগে মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবার থেকে বাংলা ভাষার প্রাচীনতম এই স্বাক্ষরটিকে আরও তিনটি দোহাগ্রন্থের সঙ্গে আবিষ্কার করেন।

কিন্তু বাংলা গ্রন্থ নেপালে গেল কেমন করে? প্রায় আটশো বছর আগে যখন বাংলাদেশে তুর্কী-আক্রমণ হয়, তখন পণ্ডিতেরা নিজেদের প্রাণের চেয়ে প্রিয় পুঁথি-পত্তর নিয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যান। কেউ তিব্বতের দিকে চলে যান, কেউ নেপালের দিকে। এমনই কোন পণ্ডিত হয়তো ওই পুঁথিখানি নেপালে নিয়ে গিয়ে থাকবেন।

এই পুঁথিখানির আসল নাম ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’। অবশ্য এ নিয়ে মতভেদ আছে। পুরনো অক্ষর নানান পণ্ডিতে নানান রকম পড়েন। গ্রন্থটি কোন একজন লেখকের লেখা নয়। গ্রন্থটিতে মোট ২৪ জন কবির নাম পাওয়া যায়। তবে একই কবি দুই-তিন নামেও কবিতা লিখেছেন। মোট কবিতার সংখ্যা সাড়ে ছেচল্লিশটি, অর্থাৎ ছেচল্লিশটি গোটা এবং একটি অর্ধেক। বাকি অর্ধেকটি পোকায় নষ্ট করেছে। এই কবিতাগুলি সবই গান—ধর্মসঙ্গীত। এখনকার দিনের যেমন রামপ্রসাদী বা শাক্ত বা বৈষ্ণব পদাবলি, ওগুলিও ছিল ঠিক তেমনি বৌদ্ধ পদাবলি। ছোট ছোট গান। যন্ত্র বাজিয়ে সুর করে গাওয়া হত। বৌদ্ধদের একটি বিরাট সম্প্রদায় তখন বাংলাদেশে অনেক বিহার নির্মাণ করেছিলেন। এই সম্প্রদায়ের নাম ছিল বৌদ্ধ সহজিয়া সাধক সম্প্রদায়। নিজেদের সাধনার দার্শনিক তত্ত্বই এঁরা এই গানগুলির মধ্যে হেঁয়ালি ভাষায় ব্যক্ত করেছেন। সাধারণ মানুষ গানগুলির একরকম মানে বুঝবে, কিন্তু অন্তর্নিহিত মানে আরও সূক্ষ্ম।

এই গানগুলি যাঁরা লিখেছেন তাঁদের কয়েকজনের নাম হল—লুইপাদ, চাট্টিলপাদ, ভুসুকুপাদ, কম্বলাম্বরপাদ, কাহ্নুপাদ, ডোম্বীপাদ প্রভৃতি। এগুলি ধর্মাশ্রমের নাম। যেমন আধুনিক কালের স্বামীজী বিবেকানন্দ, অভেদানন্দ ইত্যাদি।

হাজার বছরের পুরনো এই বাংলা ভাষার চেহারাটি কেমন ছিল? ঠিকমত বলতে গেলে মাত্র দেড়শো বছর হল বাংলা গদ্য লেখা শুরু হয়েছে। অবশ্য তিন-চারশো বছর আগেও বাংলা গদ্য লেখা হত, তবে তা শুধু দু’একটি চিঠিপত্র ইত্যাদিতেই। সাহিত্য সৃষ্টি সমস্তই হত কবিতায়। কারণ সুর করে পড়ে তা মনে রাখা ছিল সহজ, এখনকার মত ছাপাখানা তো আর ছিল না। কাজেই এই বৌদ্ধ সাহিত্যও রচিত হয়েছিল কবিতায়। একটা উদাহরণ দিই:

কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল।
চঞ্চল চীএ পইঠা কাল।।

মানে কি ? মানে হল, দেহ যেন একটি বৃক্ষ। তার পাঁচটি ডাল। চঞ্চল চিত্তে মহাকাল প্রবেশ করেছে। এ হল গিয়ে ওপরের মানে। এর নিগূঢ় দার্শনিক অর্থ আছে। গানটিতে মোট দশটি চরণ আছে, দুটি চরণ মাত্র তুলে দিলুম। আরেকটি উদাহরণ:

টালত মোর ঘর নাহি পড়িবেষী।
হাঁড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী।।
বেঙ্গ সংসার বড্হিল জাঅ।
দুহিল দুধূ কি বেন্টে সামাঅ।।

অর্থাৎ? বাংলা ভাষাই তো! একটু চেষ্টা করলেই তোমরা অর্থ বলতে পারো। ঠিক কথার অর্থ হল: টিলার ওপর আমার ঘর, প্রতিবেশী নেই। হাঁড়িতে ভাত নেই, অথচ নিত্যই অতিথি আসছে। অঙ্গ নেই তবু সংসার বেড়ে যাচ্ছে এবং দোয়া দুধ বাঁটে ঢুকে যাচ্ছে।

এই হেঁয়ালী ভাষার মধ্যেও নিগূঢ় দার্শনিক অর্থ আছে। তা আমাদের এখন জেনে দরকার নেই। শুধু বাংলা ভাষার আদি রূপটি কেমন ছিল সেইটি জানাই আমাদের উদ্দেশ্য। হাজার বছর আগে আমাদের পিতৃপুরুষ যে কথা বলে গেছেন তা আমাদের জানতেও হবে, বুঝতেও হবে বৈকি! তাই না?

ঋণ: বার্ষিক শিশুসাথী, ১৯৫৮; বানান পরিবর্তিত