Categories
লোকশ্রুতির ঘাট |

বাঙালি বীর আশানন্দ ঢেঁকি

1337 |
Share
| ২২ অক্টোবর, ২০২০
নিবারণচন্দ্র ভট্টাচার্য্য

অধ্যাপক

এঁকেছেন: রাজু প্রামাণিক; চিত্র সৌজন্য: www.facebook.com/অতীতের শান্তিপুর

আমরা ছেলেবেলায় আশানন্দ ঢেঁকির গল্প শুনতাম৷ জীবিত আশানন্দের নয়, বহুকাল পরলোকগত আশানন্দের৷ আশানন্দ খুব বলবান লোক ছিলেন৷ অবশ্য বীর বলতে সাধারণ লোকে যা বোঝে তা তিনি ছিলেন না— বড় বড় বীরের মত দেশ জয় করে নরশোণিতে তিনি পৃথিবী রঞ্জিত করেননি৷ মধ্যবিত্ত ব্রাহ্মণের ছেলে৷ বাড়ি শান্তিপুর৷ কিছু জমিজমা, বাগান ইত্যাদি ছিল, তাতেই কোনও রকমে চলে যেত৷ নিজের অবস্থার উন্নতি করার কোনও আশা বা দুরাশা তাঁর ছিল না৷ স্বল্পে সন্তুষ্ট, বিরাট, বলিষ্ঠ ব্রাহ্মণকে লোকে ভালবাসত, শ্রদ্ধা করত৷ তাঁর সম্বন্ধে দুটো গল্প আজ শোনাব৷

একবার আশানন্দ বিদেশ থেকে দেশে ফিরছিলেন৷ পথের মধ্যে সন্ধ্যা হওয়ায়, এক ধনী ব্যক্তির গৃহে আশ্রয় গ্রহণ করলেন তিনি৷ তাঁরা আশনন্দের নাম শুনেছিলেন, তাই খুব আদরে অভ্যর্থনা করে আহারাদির আয়োজন করে দিলেন৷ আহার শেষে আশানন্দ তাঁদের বাইরের ঘরের বারান্দায় বিছানা করে শুয়ে পড়লেন৷ তাঁর কাছে অর্থ ছিল না, কিন্তু অটুট স্বাস্থ্য ছিল৷ তাই অল্প সময়ের মধ্যেই গভীর নিদ্রায় ডুবে গেলেন৷

হঠাৎ সে বাড়িতে সে সময়কার এক নাম-করা ডাকাতের দল এসে আক্রমণ করল৷ দলের নাম শুনে বাড়ির লোকেদের আত্মরক্ষা করার কোনও প্রবৃত্তি হল না৷ তাই ডাকাতরা যখন বাড়ির সদর দরজা ভাঙছিল, বাড়ির মেয়েরা ও অন্যান্য লোকেরা তখন জানলা দিয়ে পালিয়ে গেলেন৷ কেবল বাড়ির কর্তা ছিলেন সেকেলে ধর্ম্মভীরু লোক, পাছে দস্যুদের আঘাতে বাড়ীতে ব্রহ্মহত্যা হয় এই ভয়ে তিনি ছুটে গিয়ে আশানন্দকে ঠেলাঠেলি করে জাগিয়ে দিয়ে, অবস্থা ব’লে তখনই তাঁকে অনুসরণ করতে পরামর্শ দিলেন৷ আশানন্দ সবশুনে বললেন, ‘সে কী, আপনি আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন আর আমি আপনাদের বিপদের সময় ফেলে পালাব!’ ইতিমধ্যে ডাকাতরা দরজা ভেঙে ফেলেছে৷ গৃহকর্তা শেষ সময় ভেবে ঠক্ ঠক্ করে কাঁপছেন৷ আশানন্দ কাপড় সামলে, অন্য হাতিয়ার না পেয়ে সামনে ঢেঁকীশাল থেকে ঢেঁকীটা তুলে নিয়ে ডাকাতদের সম্মুখীন হলেন৷ তারা তাঁর ভৈরব মূর্তি দেখে ভয় পেলেও পালিয়ে গেল না, দূর থেকে ইট ও বর্শা ছুঁড়তে লাগল৷ তখন আশানন্দ সেই ঢেঁকি ঘুরিয়ে প্রবল বেগে দস্যুদলের মধ্যে ছুঁড়ে মারলেন৷ কয়েক জন দস্যু ঢেঁকি চাপা পড়ে আহত হল৷ এই অদ্ভুত ব্যাপার দেখে অধিকাংশ দস্যুই ভয়ে পালিয়ে গেল৷ কেবল দলের নেতা ও তার প্রধান জন দুই চেলা আশানন্দকে খালি হাতে দেখে লাঠি নিয়ে তাঁকে আক্রমণ করল৷

আশানন্দ তখন চণ্ডীমণ্ডপের ওপর লাফিয়ে উঠে চণ্ডীমণ্ডপের একটা শালের খুঁটি উপড়িয়ে নিয়ে দস্যুদের আক্রমণ করলেন৷ দু’জন দস্যু জখম হল৷ এরপর আশানন্দ দলপতিকে গিয়ে ধরে ফেললেন৷ তার সাধ্য কী আশানন্দের কবল থেকে আত্মরক্ষা করে? দস্যুপতি আশানন্দের পায়ে পড়ে প্রাণ ভিক্ষা চাইলেন৷ সে আর কখনও দস্যুবৃত্তি করবে না এই শপথ করলে আশানন্দ শেষে তাঁকে ছেড়ে দিলেন৷ বাড়ির লোক ও গ্রামের লোক ইতিমধ্যে ভরসা পেয়ে সেখানে এল এবং আশানন্দের অদ্ভুত বীরত্বের কথা শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল৷ এরপর গৃহকর্তা দুই-একদিন আশানন্দকে পরম সমাদরে রেখে, অবশেষে তাঁকে প্রচুর উপহার ও লোকজন দিয়ে বিদায় জানালেন৷ কয়েকদিনের মধ্যেই এই গল্প চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল এবং সেই থেকে আশানন্দের নাম হল ‘ঢেঁকি মহাশয়’৷

আর একটি গল্প৷ আশানন্দের কয়েক দিন জ্বর হয়েছিল৷ তারপর যখন একটু ভাল হলেন, কবিরাজকে বললেন, “বড় ক্ষিদে পেয়েছে, কিছু আহারের ব্যবস্থা করুন৷” কবিরাজ বললেন, “আজ লঘ্বাহার করুন, তার পর কাল দেখা যাবে৷”
“লঘ্বাহার কী?”
“যাকে বলে লঘুপথ্য৷ এই চারটি খই আর কিছু বেগুন পোড়া— শুধু লবণ দিয়ে মাখা৷” আশানন্দের এক মাসী সেখানে উপস্থিত ছিলেন৷ তিনি কবিরাজের ব্যবস্থানুসারে একটা বেগুন এবং এক কুনকী ধান নিয়ে তার খই প্রস্তুত করতে গেলেন৷ এমন সময় আশানন্দের মা এসে উপস্থিত৷ তিনি শুনে বললেন, “দিদি, ও কী করছ? আশানন্দকে তুমি জানো না; আমি ব্যবস্থা করছি৷” এই বলে তিনি একটি বিরাট ধামা ভর্তি ধান নিয়ে তার খই করতে নির্দেশ দিলেন৷ কাছের বেগুনের ক্ষেত থেকে গোটা পঁচিশ বেগুনও তুলে আনলেন৷

যথা সময়ে আশানন্দ এক ধামা খই এবং গোটা পঁচিশ বেগুন পোড়া খেয়ে লঘুপথ্য করে, বিকেলে খুব খিদে পাওয়ায় কবিরাজকে আবার ডেকে পাঠালেন৷ কবিরাজ এসে বাড়ির পাশে ঝুড়ি খানেক ধানের খোসা দেখে প্রথমটা একটু সন্দিহান হলেন, পরে কারণ শুনে অবাক হয়ে গেলেন৷ শেষে আশানন্দ রাত্রের পথ্যের ব্যবস্থা করতে বললে তিনি বললেন, ‘আপনার অসুখ সেরে গেছে৷ এখন যা খুশি খেতে পারেন৷’

কয়েক বছর হল শান্তিপুরে আশানন্দের একটি স্মৃতিস্তম্ভ বসানো হয়েছে (আগেই বলেছি আশানন্দের বাড়ী ছিল শান্তিপুর)৷ স্মৃতিস্তম্ভের গায়ে এই রকম একটা কবিতা খোদাই করা আছে—

দুষ্টের দমনে আর শিষ্টের পালনে
সুমহান ব্রত যাঁর ছিল এ জীবনে;
মুখোবংশ অবতীর্ণ আশানন্দ বীর,
‘ঢেঁকী’ নামে খ্যাত যিনি বক্ষে পৃথিবীর,
প্রবাদ হয়েছে এবে গরিমা যাঁহার
তাঁহারি এ স্মৃতিস্তম্ভে কর নমস্কার৷

তোমরা যদি কখনও শান্তিপুরে যাও তবে এই স্মৃতিস্তম্ভটি দেখে আসতে ভুলো না৷

ঋণ: রামধনু পত্রিকা, ১৯৪২; চলিত করেছেন জয়তী ভট্টাচার্য