Categories
গল্পগ্রাম |

বেড়ালের গোয়েন্দাগিরি

904 |
Share
| ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০
সুব্রতা দাসগুপ্ত

গ্রাফিক্স: কমলাকান্ত পাকড়াশী

পর্ব-১

আমাদের পাড়ার বেড়ালদের এতদিনে নিশ্চয়ই আপনারা সবাই হাড়ে হাড়ে চিনে গেছেন! তারা ভৈরবী রাগিণীতে বিলাপ (বিড়ালের আলাপ) করে, ছানাদের উল-কাঁটা দিয়ে বুনতে শেখায়, বয়স্ক বেড়াল মারা গেলে তার শ্রাদ্ধ শান্তি করে, মানুষ কনের বিয়েতে নিতকনে সেজে ফেসিয়াল করে– এসব আপনাদের অজানা নয়। কিন্তু বেড়াল যে গোয়েন্দাগিরিও করে, সেই তথ্য হয়তো আপনাদের অজানা ছিল। সেই গল্পটাই আজ বলব।

আমাদের কমপ্লেক্সে অনেক প্রফেশনের বেড়াল আছে। শিক্ষক বেড়াল, ব্যবসায়ী বেড়াল, ইঞ্জিনিয়ার বেড়াল, ডাক্তার বেড়াল, সাংবাদিক বেড়াল, নিপাট সংসারি বেড়াল, হোটেল মালিক বেড়াল, আরও কতরকমের কাজ যে বেড়ালেরা করতে পারে সে আপনারা না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেন না। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে আমরা বুঝলাম কী করে? সব যে আমি প্রথমে বুঝেছি তা নয়। আমার রান্নার দিদি শীলা, আমার ছেলে ভানু— এদের সাহায্য ছাড়া আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না যে, রোজ ট্যাঙ্কের ওপর জনা দশেক ছানা নিয়ে যে হুলোটি আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে, ম্যাও ম্যাও করে, আর মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়ে— সে হল শিক্ষক বেড়াল। এরকম আরও অনেক শিক্ষক বেড়াল না কি এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে আছে— ক্লাস নিচ্ছে আর কী! ব্যবসায়ী বেড়ালের সংখ্যা এখানে কিছু বেশি। সকালে মার্কেট কমপ্লেক্সের প্রতিটি দোকানে একজন করে বেড়াল বসে থাকে। হিসেবের খাতাপত্র দেখে, আড়মোড়া ভাঙে, ঘুমোয়, বেলায় দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরে আসে। মাছের বাজারে একটু বেশি সংখ্যায় ব্যবসায়ী বেড়ালের আনাগোনা দেখা যায়, দুধের গুমটিতেও একই অবস্থা। ইঞ্জিনিয়ার বেড়ালদের ডিউটি আবার পাম্পহাউসে আর ইলেকট্রিসিটি বোর্ডের নিষিদ্ধ এলাকায়। সকাল থেকে রাত অবধি দফায় দফায় ডিউটি করতে হয়। রাত্রের ডিউটিও থাকে। ডাক্তার বেড়ালদের সহজেই চেনা যায়। যত অসুস্থ বেড়াল কাচ্চা বাচ্চা সমেত এঁর কাছে হাজির হয়। এখানে হট্টগোল লেগেই থাকে। সাংবাদিক বেড়ালরা আবার এক জায়গায় বসে থাকতে পারে না। পাড়া বেপাড়ায় ঘুরে ঘুরে খবর সংগ্রহ করে। সন্ধেবেলা ‘ঘন্টাখানেক সঙ্গে বেড়াল’-এর মতো লাইভ অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করে। তখন তাদের ঘিরে সব মাতব্বর বেড়ালেরা বসে থাকে! হইচই হয়, আবার কখনও কখনও মারপিট, খামচাখামচি, কামড়ানো এসবও হয়। হোটেল মালিক বেড়ালরা আবার খুব রাশভারি। পাশে নানা রকমের চোরাই খাবারের পাহাড় জমিয়ে রাখে। খদ্দেররা যে যার পছন্দ মতো খাবার নিয়ে যায়, বদলে যার যা সামর্থ্য দিয়ে যায়। কখনও গতরে খেটেও দাম শোধ করে। যেমন মাল শেষ হলে জায়গাটা চেটে পরিষ্কার করে দিল— এরকম আর কী! নিপাট ভালমানুষ সংসারি বেড়ালরা আবার কোথাও বেরয় না। এরা যে সবসময় নারী জাতি হয় তা কিন্তু না। হুলোরাও অনেকসময় বাড়িতে থাকতেই পছন্দ করে। মেনিরা বাইরে কাজে যায়। এ চত্বরে একজনই উকিল বেড়াল আছেন।  তিনি একটা উঁচু ঢিবিতে বসে ঝিমোন। ঝগড়াঝাঁটি বাদবিবাদ হলে সমাধান করেন। কিন্তু পুলিশ বেড়াল এ অঞ্চলে একটিও নেই। বেড়ালের থানাটা আবার পাশের পাড়ায়। তাদের খুব একটা আসতেও হয় না। কারণ এই এলাকায় চুরি-চামারি, খুন-খারাবি একেবারে হয় না বললেই চলে। যে অঞ্চলে অপরাধই কম, পুলিশদেরও আসতে হয় না, সেখানে যে গোয়েন্দা বেড়ালের অস্তিত্ব থাকবে সেটা আমরা কেউই জানতাম না। এটা দেখতাম যে, বেড়ালরা কার্নিশের কোণে বা জালনার ধারে বসে বসে যে সব টিভি প্রোগ্রাম দেখে, সিনেমা সিরিয়াল, বা ওয়েব সিরিজ দেখে— তার মধ্যে ক্রাইম থ্রিলার তাদের পছন্দের তালিকায় বেশ ওপরের দিকে আছে। এই লকডাউনের বাজারে ঘরবন্দি মানুষেরা যখন গোগ্রাসে সিনেমা সিরিয়াল গিলছে তখন তাদের পাড়ার বেড়ালরা কি এ ব্যাপারে পিছিয়ে থাকতে পারে?

যা হোক এবার আসল গল্পে আসা যাক। মাস দুয়েক আগেকার একটা রবিবারের সকাল। হঠাৎ খবর পেলাম আমাদের পাড়ার এক হোটেল মালিক বেড়াল শনিবার রাত্রে খুন হয়েছেন। খুন বোঝা গেছে কারণ কোনও সুইসাইড নোট পাওয়া যায়নি। বেড়ালদের সুইসাইড নোট কী রকম হয় জানতে চাইলে শীলা খুব অবজ্ঞার সঙ্গে জানাল যে, বেড়ালরা নাকি সচরাচর আত্মহত্যা করে না। আর করলেও মরার আগে পাশে একটা ইঁটের টুকরোয় ক্রস (X) চিহ্ন দিয়ে যায়। আর বেড়ালরা সাধারণত ইঁদুর মারার বিষ খেয়ে, জলে ডুবে বা খুব উঁচু বাড়ির ছাত থেকে লাফ মেরে আত্মহত্যা করে। এরকম ভাবে করে না। বিশদে জানতে চাইলে সে বলল— হোটেল মালিকের নাম নিধিরাম। মুশকো জোয়ান হুলো। চোরাই খাবারের সঙ্গে আবার চোরাই মদেরও ব্যবসা ছিল। রাতের দিকে তার নিজেরও একটু ওসব খাবার অভ্যেস ছিল। ফলে সে যে সময় সজাগ অবস্থায় ছিল না, সেই সময় কেউ বা কারা তাকে গলায় দড়ির ফাঁস লাগিয়ে মেরে দিয়েছে। দড়িটা আবার ঠিক দড়ি নয়। দশ নম্বরের একতলায় কার একটা ওড়না শুকোতে দেওয়া ছিল, সেটাই দড়ির কাজ করেছে। ভয়ানক ব্যাপার।

মৃত্যুর সময় হলফ করে বলা যাচ্ছে না। কিন্তু রাত এগারোটার আগে নয়। কারণ এগারোটায় সব বিল্ডিং-এর দরজা বন্ধ করতে এসে বাহাদুর নিধিরামকে হোটেলে বসে থাকতে দেখেছে। তারপর এদিকটায় আর কেউ আসেনি। ভোরবেলা পাম্প চালাতে এসে মুজিব দেখে হোটেলের সামনে ঝোপের মধ্যে নিধিরাম মরে পড়ে আছে। লাল ওড়নাটাই আগে চোখে পড়েছিল। তারপর ওড়নার নিচে নিধিরামকে দেখা যায়। পরদিন ময়না তদন্তের রিপোর্ট থেকে জানা গেল মৃত্যুর সময় রাত বারোটা আর নিধিরামের পেটে একটু মদও ছিল। তার মানে নিধিরাম নেশা করে ঘুমোচ্ছিল আর সেই সুযোগে খুনি কাজ সেরেছে। কিন্তু কে খুন করল? বেড়াল না মানুষ? নাকি ভূত?

খুনের রহস্যের কিনারা করতে গেলে, যে খুন হয় তার ঠিকুজি-কুলুজি জানাটা জরুরি। নিধিরাম বিপত্নীক। ছেলেপুলে অনেক। তবে তারা সবাই এখানে থাকে না। যারা থাকে তারা নিজের নিজের সংসারে ব্যস্ত। নিধিরাম হোটেলে থাকত। তার দু-একজন হেল্পার ছিল। তারা রাত্রে বাড়ি চলে যেত। আবার সকালে চলে আসত। পাড়া প্রতিবেশীর সঙ্গে নিধিরামের খুব যে একটা ভাব ছিল বলা যায় না। কারণ আর কিছুই না। হোটেলে অনেক উঠতি বয়সের ছানা নেশা করতে আসত। নিধিরামও তাদের বাধা দিত না। তাই ছানাদের বাবা মায়েরা একটু অসন্তুষ্ট হত। কিন্তু তার জন্য তো আর খুন করা করা যায় না? যাই হোক, নিধিরামের এই মৃত্যুতে বেড়াল, মানুষ, কুকুর, পাখি সব সমাজেই বেশ আলোড়ন পড়ে গেল। বেড়ালের গলায় ওড়নার ফাঁস দিয়ে খুন? এরকম হত্যা রহস্য তো আর সচরাচর দেখা যায় না!

এর মধ্যে ভানু এসে খবর দিল নিধিরাম হত্যা রহস্যের তদন্ত করছে বেড়াল উকিলবাবুর একমাত্র পুত্র ভুলভুলাইয়া ওরফে ভুলু। সে নাকি ছোট থেকেই গোয়েন্দা কাহিনির ভক্ত। আমাদের জালনায় চড়ে ফেলুদা, ব্যোমকেশের মতো সিনেমা, সিরিয়াল, ওয়েব সিরিজ সব গুলে খেয়েছে। নিয়মিত খবরের কাগজ পড়ে, খবর শোনে, বাবার কাছ থেকে আইনি প্যাঁচ-ট্যাঁচও ভালই শিখে নিয়েছে। ফলে নিধিরামের বাড়ির তরফ থেকে ভুলুর ওপরেই তদন্তের ভার দেওয়া হয়েছে। ভুলুদার গোয়েন্দাগিরি শুরু হয়ে গেছে।

পর্ব-২

পরদিন সকালে শীলা ফোন করে জানাল ভুলু সবার বাড়ি গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। আমরা যেন যা জানি সব তাকে বলি। বেড়াল গোয়েন্দারা কীভাবে জিজ্ঞাসাবাদ চালায় তা জানতে চাওয়ার আগেই ফোন কেটে গেল। যা হোক বেলা এগারোটা নাগাদ ভুলুর আবির্ভাব হল।

আমি ফেলুদা, ব্যোমকেশ, শার্লক হোমস, হারকিউল পয়রো, মিস মার্পল তো বটেই এমনকি একেনবাবুর তদন্ত প্রণালী সম্পর্কেও কিঞ্চিৎ ওয়াকিবহাল। কিন্তু ভুলুবাবু ঠিক কোন পথে এগোবেন সে ব্যাপারে যথেষ্ট কৌতূহল ছিল। দেখলাম, এঁর তদন্তের ধরণধারণ সম্পূর্ণ আলাদা। ঘরে ঢুকেই তিনি চারদিকে ঘুরে ঘুরে কী সব শুঁকতে লাগলেন। ঘর, বারান্দা, বাথরুমের বিশেষ বিশেষ জায়গায় শোঁকার কাজ সেরে তিনি যেই ফস করে রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন তখন আমার একটু ভয় হল। সবে মাছের ঝোলটা নামিয়ে এসেছি। যতই গোয়েন্দা হোন বেড়ালই তো! এসব ভেবে যেই রান্নাঘরে উঁকি দিয়েছি, অমনি তিনি এমন ফ্যাঁস করে তেড়ে এলেন যে, আমি এক লাফে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হলাম। যা হোক সে যাত্রা মাছের ঝোল রক্ষা পেল। ভুলুবাবু ঝোলে মুখ দেননি ঠিকই কিন্তু রান্নাঘরের যে তাকে টিফিন বক্স রাখা থাকে সেই তাকটা লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছেন। আমি আবার ভদ্রতা করে ওঁকে একটা প্লেটে বাড়িতে বানানো ছানার সন্দেশ দেওয়াতে উনি বেজায় খুশি হয়ে গেলেন। একগাল হেসে, টেবিলে চড়ে গপগপ করে সন্দেশ খেয়ে, বেসিনে হাতমুখ ধুয়ে আমাকে হাত তুলে টা-টা করে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ভানু আর তার বাবা কিনা খুবই সাহসী, তাই এতক্ষণ তারা খাট থেকে নামতে পারেনি। এখন ভুলুদা বেরিয়ে যাওয়ায় নিশ্চিন্ত হয়ে বেড়াল কী কী তদন্ত করে গেল সেটা সরেজমিনে অনুসন্ধান করতে নেমে পড়লেন। কিন্তু আশ্চর্য রান্নাঘরের এত তাক থাকতে টিফিনবক্সের তাকটা তছনছ করল কেন কে জানে? অন্যান্য দু-একটা বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানলাম ওখানেও একই কাজ করেছে। বিকেলে শীলাকে ফোন করে এর কারণ জিগ্যেস করাতে সে বলল, “এও বুঝলেন না? আপনারা নিধিরামের দোকান থেকে খাবার আনতেন কি না সেটাই চেক করছিল।” শীলার উত্তর শুনে হাসব না কাঁদব কিছুই ভেবে পেলাম না।

এরপর নানান খবর কানে আসতে লাগল। যেমন ব্যানার্জি গিন্নির রাতে ঘুম আসে না। তিনি রাত বারোটার কিছু আগে জানলা দিয়ে একটা কাপড় গোছের জিনিসকে মাটির ওপর দিয়ে ভেসে ভেসে যেতে দেখেছেন। দশ নম্বরের সামনে থেকে সেটা এগারো নম্বরের দিকে যাচ্ছিল। এই এগারো নম্বর বিল্ডিং-এর গায়েই নিধিরামের হোটেল। রাত্রের অন্ধকারে কাপড়ের রঙটা ঠিক বোঝা যায়নি। উনি ভেবেছেন হাওয়ায় উড়ে উড়ে যাচ্ছে। কিন্তু আবার শুভঙ্করবাবু রাত্রে জানলার ধারে বসে অফিসের কাজ করছিলেন— তিনি জানান শনিবার রাতে গুমোট গরম ছিল। একটা গাছের পাতাও নড়ছিল না। তাই উনি এসি চালাতে বাধ্য হন। তা হলে কাপড় কীভাবে হাওয়ায় ভেসে যাবে?

আমরা সবাই জানি খুনের রহস্য সমাধান করতে হলে জানতে হয়, খুনির মোটিভ কী ছিল আর তার খুনের সুযোগ ছিল কি না? মোটিভ আর সুযোগ যার যত জোরালো, খুন করার সম্ভাবনা তার তত বেশি। কিন্তু নিধিরাম হত্যা রহস্যে এই দুটোও বড় দুর্বল। নিধিরামবাবুর হোটেলের ব্যবসা অনেকদিনের। চেনা লোকেদের সঙ্গেই এই কারবার। নতুন করে শত্রু তৈরি হবার কিছু নেই। ছেলেপুলেরাও প্রতিষ্ঠিত। সম্পত্তির লোভে খুন করবে এমন নয়। হোটেলের কর্মচারি দু’জনও পুরনো লোক। মালিকের ওপর খুশিই ছিল। নিধিরামবাবু হোটেল মালিক হিসেবে তো খারাপ ছিলেন না। তা হলে খুন করল কে?

পর্ব-৩

খুনের পর প্রায় সাত আট দিন কেটে গেছে। ভুলুবাবু এখনও কিছু কিনারা করতে পারেননি। শোনা যাচ্ছে তিনি মাঝে মাঝেই সন্ধেবেলা ট্যাঙ্কের ওপর বসে দেবদারু গাছের মাথার দিকটায় উদাস নয়নে তাকিয়ে থাকছেন। জটিল কিছু ভাবছেন হয়ত। যেমন গোয়েন্দারা ভাবেন আর কী! কিন্তু দেবদারু গাছের দিকে তাকিয়ে কেন? তবে কি উনি অন্যরকম কিছু ভাবছেন?

এখানে এই দেবদারু গাছেদের সম্পর্কে কিছু বলা দরকার। আমাদের কমপ্লেক্সে যে-কটা দেবদারু গাছ আছে, তার সবগুলোতেই ভূত আছে। ভূতেরা দেবদারু গাছ এত পছন্দ করে কেন বলতে পারব না। কিন্তু এটাই এখানকার রীতি। অন্য গাছগুলোতে ভূত মোটেই টিকতে পারে না। তা হলে কি ভুলুবাবু ভাবছেন এটা ভূতেদের কীর্তি?

কিন্তু ভূতেদের সঙ্গে নিধিরামের কীসের শত্রুতা? এ পাড়ার ভূতেরা, যতদূর জানি হিংস্র টাইপের নয়। মাঝে মধ্যে তারা জানলা দিয়ে উঁকি মারে, ছাতে বসে হাওয়া খায়। বাগানের দোলনায় বসে দোল-টোল খায় বটে, কিন্তু কাউকে কোনওভাবে বিরক্ত করতে দেখিনি। রাতের দিকে অবশ্য তারা মাঝেমধ্যে সদলবলে মাটিতে নেমে আসে, রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করে, আড্ডাটাড্ডা দেয়, হয়তো নিধিরামের হোটেলেও যায়, কিন্তু তাতে আমাদের কখনও ঘুমের ব্যাঘাত হয়েছে বলে তো মনে পড়ে না। আর নিধিরামের হোটেলটা তো তাদের আড্ডার জায়গাই ছিল। নিধিরামকে মেরে সেই আড্ডার জায়গা তারা নষ্ট করবে কেন।  কিন্তু ভুলুবাবুর চোখ নাকি দেবদারু গাছের মাথা থেকে মোটে নড়ছেই না। ব্যাপারটা কী?

এর দু’দিন পর শীলা এসে জানাল নিধিরামের মেয়ে নাকি তার মায়ের স্বপ্ন দেখেছে। মা তাকে স্বপ্নে এসে বলেছেন, নিধিরামবাবু স্বর্গে এসে ভালই আছেন, তাঁর জন্য যেন কেউ চিন্তা না করে। মেয়েও মায়ের উপদেশের কথা ভেবে নিধিরাম-হত্যা-রহস্যের কথা আর ভাবতে চাইছে না। মেয়ে মায়ের কথা শুনলেও, আমরা শুনব কেন? খুনি কে জানতে হবে না?

আরও কিছু তথ্য কানে এল যে, ভুলুবাবুর তদন্তের ব্যাপারে যাঁরা যাঁরা ওঁকে সাহায্য করছেন তাদের মধ্যে ওঁর স্বর্গগত দিদিমাও আছেন। অবাক কাণ্ড? ভূত এসে বেড়াল গোয়েন্দাকে তদন্তের ব্যাপারে সাহায্য করছে? কালে কালে আর কত দেখব? তবে এ তো আমাদের ব্যোমকেশের শৈল রহস্যেও আছে! তাই আর বেশি অবাক হলাম না।

ভুলুবাবুর দিদিমা ভুলুবাবুকে এই সংবাদ দিয়েছেন যে, আপাতত নিধিরাম আর তার বউ মহানন্দে গাছের ডালে বসে দোল খাচ্ছে। কাজেই যেই খুন করুক তাতে খারাপ কিছুই হয়নি। কিন্তু ভুলুবাবু জাত গোয়েন্দা, তিনি তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে সব এলাকার সব লোকেদের জবানবন্দি নেওয়া হয়ে গেছে। মানুষ, বেড়াল, কুকুর, পাখি, ভূত— কেউ বাদ যায়নি। এই সব জবানবন্দি থেকে এটাই বেরিয়ে আসছে যে, কোনও মানুষের কাজ এটা নয়। পাখিরা তো সন্ধে থেকেই ঘুমিয়ে পড়ে। পূর্ণিমার রাতে ডাকাডাকি করে বটে কিন্তু খুনের রাতটা পূর্ণিমার রাত ছিল না। তাই পাখিদের বাদ দেওয়া যেতে পারে। তা ছাড়া গলায় ফাঁস লাগান পাখির কর্ম নয়। বেশিরভাগ কুকুর রাত্তিরটা গেটের কাছেই থাকে। বেড়ালরাও অত রাতে কেউ জেগে ছিল না। জেগে থাকলেও নিজেদের বাড়িতে কাচ্চাবাচ্চাদের ঘুম পাড়াতে বা দাম্পত্য কলহে ব্যস্ত ছিল। তা হলে বাকি রইল ভূত। হাওয়ায় ওড়না ভেসে যাওয়া, বেড়ালের গলায় নিঃশব্দে ফাঁস লাগানো— এ সব ভূতের দিকেই সন্দেহের তির নিক্ষেপ করে। কিন্তু কেন? সুযোগ না হয় আছে। কিন্তু মোটিভ?

পরদিন সকালে শুনলাম ভুলুদার রহস্য সমাধান হয়ে গেছে। আজ বিকেলে ট্যাঙ্কের ওপর সভা বসবে। আমরা যেন অবশ্যই যাই। ওখানেই ভুলুবাবু রহস্য উদ্ঘাটন করবেন। উত্তম প্রস্তাব। তাড়াতাড়ি দুপুরের খাওয়া সেরে ছোট্ট একটু ভাত ঘুম দিয়ে রেডি হয়ে নিলাম। দেখা যাক ভুলুদার গোয়েন্দাগিরির দৌড় কতদূর। যথা সময়ে ট্যাঙ্কের ধারে গিয়ে দেখি লোকে লোকারণ্য। সবাই দূরে দূরে বসেছে ঠিকই। কিন্তু ভিড় ভালই। ভুলুবাবু আদর্শ গোয়েন্দার মতো চিন্তিত কিন্তু আনন্দিত মুখে একটু উঁচু একটা বেদির ওপর বসে আছেন। তিনি কী ভাষায় কথা বলবেন এই নিয়ে সবার মধ্যে একটা সংশয় ছিল। কিন্তু তিনি নিজেই সেই সংশয় দূর করে দিলেন। তিনি বলবেন বেড়ালের ভাষায়। আর ভানু দোভাষীর কাজ করে দেবে। বেড়ালের ভাষা ভানু জানল কী করে সেটা জিগ্যেস করায় ভানু আর শীলা ভয়ানক চটে গেল। সে নাকি ওরা অনেকদিন থেকেই জানে। শীলা তো নিশ্চয়ই জানে। কিন্তু ভানুও জানে দেখে আমি বিশেষ আশ্চর্য হলাম। ভুলুবাবু আকাশের দিকে একবার আর দেবদারু গাছের দিকে একবার তাকিয়ে তাঁর বক্তৃতা শুরু করলেন। ভানুও দোভাষীর ভূমিকায় প্রস্তুত হয়ে বসল।

ভুলুবাবু শুরু করলেন— ‘প্রথমে একটু পুরনো গল্প বলা যাক। নিধিরাম তো অনেকদিনই বিপত্নীক। কিন্তু তিনি একাই থাকতেন। আর বিয়েটিয়েও করেননি। এমনকী তাঁর যে কোনও বিশেষ বন্ধু-টন্ধু ছিল তাও শোনা যায় না। বরং এই গল্প শোনা যায় যে, নিধিরামের পরলোকগতা স্ত্রী সাবিত্রীদেবী তার সঙ্গে নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ করতে আসতেন। আমরা তাকে কোনওদিনও দেখিনি বটে কিন্তু বেড়াল সমাজে তিনি বেশ পরিচিত ছিলেন। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভাল যে, আমাদের পাড়ার দেবদারু গাছগুলোতে যে সব ভূতেরা থাকেন তাদের কিন্তু ইহলোকে বেড়াতে আসার লাইসেন্স আছে। বা এইভাবে বলা ভাল যে, যারা ইহলোকে আসার এই লাইসেন্স জোগাড় করতে পেরেছে তারাই এই গাছে থাকে। এরকম ভাগ্যবানদের মধ্যে মানুষের সংখ্যা হাতে-গোনা। তাদের লাইসেন্স আসার কিছুদিন পরপর তামাদিও হয়ে যায়। কিন্তু পশুপাখির দল একবার লাইসেন্স জোগাড় করতে পারলে বছরের পর বছর থাকতে পারে। সাবিত্রীদেবী সেই ভাগ্যবতীদের মধ্যে একজন।’ এই বলে তিনি কান চুলকোতে লাগলেন। আবার শুরু হল— ‘ভালই কাটছিল দিন। কিন্তু হঠাৎই শুরু হয়ে গেল লকডাউন। পরলোক থেকে ইহলোকে আসার লাইসেন্স পটাপট ক্যানসেল হয়ে যেতে লাগল। সাবিত্রী ওপরওলাদের বলে কয়ে অনেকদিন অবধি লাইসেন্স বাতিল করতে দেয়নি বটে, কিন্তু বেশ বুঝতে পারছিল আর বেশিদিন আটকে রাখা যাবে না। লাইসেন্স বাতিল মানে নিধিরামের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ।’ ট্যাঙ্কের ওপর সবাই বেশ নড়ে-চড়ে বসল। ছোকরা বলতে চাইছেটা কী?

‘নিধিরাম আর সাবিত্রীর মন খারাপ। তারা প্ল্যান করতে লাগল। সাবিত্রীকে আর ক’দিনের মধ্যে দেবদারু গাছ ছেড়ে চলে যেতে হতে পারে। তা হলে উপায়? উপায় একটা আছে। যদি নিধিরাম ইহলোক ছেড়ে পরলোকে যায় তা হলে আর কোনও গোল থাকে না। কিন্তু পরলোকে যাব বললেই তো আর যাওয়া যায় না। রীতিমতো মেহনত করতে হয়। বেড়ালের তো আর করোনা হচ্ছে না যে, পটাপট ওপরে যাবে! নিধিরামের মজবুত স্বাস্থ্য। অসুখে ভুগে মরা মুশকিল। আত্মহত্যাও মহাপাপ। তা হলে বাকি থাকে খুন। সাবিত্রী প্রথমে রাজি হননি। কিন্তু নিধিরামের পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত তাকে রাজি হতে হয়। যদিও এ ব্যাপারে তাকে সাহায্য করেছিলেন তার দেবদারু গাছের এক বেড়াল ব্রহ্মদত্যি। তিনি আবার একসময় নিধিরামের বন্ধু ছিলেন। তিনি না থাকলে একা বেড়াল পেত্নীর পক্ষে গলায় ফাঁস দিয়ে নিধিরামকে হত্যা করা সম্ভব ছিল না।’

আমরা এতক্ষণ হাঁ করে শুনছিলাম। কেউ কেউ প্রশ্ন করল, ভুলুদা এত নিশ্চিত হলেন কী করে যে, এটা ভূতেরই কাজ? এই কেউ কেউরা অবশ্যই মানুষ। তারা ঠিক বেড়াল গোয়েন্দার ওপরে বিশ্বাস করতে পারছিল না। কিন্তু ভুলুবাবু তাঁর সিদ্ধান্তে অনড়। তিনি বলতে লাগলেন— ‘আপনারা ভাবছেন আমার মনগড়া কাহিনি আপনাদের শোনাচ্ছি? এই তদন্তের কাজে আমাকে সাহায্য করেছেন আমার দিদিমা স্বর্গীয়া শ্রীমতী মেনীবালা দাসী। তিনি ভূতেদের গাছে গাছে গিয়ে আমারই মতো জবানবন্দি জোগাড় করেছেন, সুযোগ আর মোটিভের চুলচেরা বিচার করেছেন, তবে না আমরা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। আর শেষ অবধি স্বীকারোক্তিও আদায় করেছি সাবিত্রী দেবীর কাছ থেকে। শুনবেন আপনারা?’ আমরা বেজায় ঘাবড়ে গেলাম। ভূতের জবানবন্দি, সেটা আবার শোনাবে কীভাবে? তা দেখলাম বেড়ালদের পৃথিবীতে সবই হয়। খানিকক্ষণ বাদে দেবদারু গাছের মগডাল থেকে খোনা খোনা গলায় খানিক ম্যাও-ম্যাও শোনা গেল। তাই শুনে ট্যাঙ্কের ওপর চার-পাঁচজন হুলো ভুলুবাবুকে মাথায় চড়িয়ে নাচতে লাগল। বুঝলাম তদন্ত সফল হয়েছে। খুনিকেও শনাক্ত করা গেছে। ভানু আর শীলা ভুলুবাবুর কৃতিত্বে দারুণ খুশি। আমিও অখুশি বলা যাবে না। কোনো মানুষের ঘাড়ে যে দোষ চাপায়নি এই যথেষ্ট।

এই ঘটনার পর গোয়েন্দা হিসেবে ভুলুবাবুর বেশ নাম ডাক হয়েছে। কেস-টেসও আসছে। আপনাদের যদি কোনও রহস্য সমাধানের দরকার হয়, অবশ্যই ভুলুদার কাছে আসবেন। শুনেছি উনি কাউকে ফেরান না।