Categories
লোকশ্রুতির ঘাট |

বোপদেব

1935 |
Share
| ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০
নীতীন্দ্র রায়

১৮৯৬–১৯৬২। ভবানীপুর মিত্র ইনস্টিটিউশনের স্বনামধন্য শিক্ষক।

অলংকরণ: কমলাকান্ত পাকড়াশী

মুগ্ধবোধ নামে যে সংস্কৃত ব্যাকরণ বাংলাদেশের টোলের ছাত্ররা পড়ে থাকে, সেই মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ লিখেছেন একজন মারাঠি পণ্ডিত— বোপদেব। তোমরা শুনলে অবাক হবে যে, হাজার হাজার ছাত্রের উপকারের জন্য যিনি সহজভাবে ব্যাকরণ লিখেছিলেন, বাল্যকালে তাঁর নিজের বুদ্ধিই ছিল ভোঁতা।

বোপদেবের বুদ্ধি ভোঁতা হলেও তাঁর স্বভাবটা ছিল বড় অমায়িক। তিনি যে টোলে পড়তেন সেখানে তাঁর মতো শান্ত, ভদ্র, গুরুভক্ত ছাত্র আর একজনও ছিল না।

বহুদিন ধরে বোপদেব ব্যাকরণ পড়লেন, কিন্তু কিছুতেই তিনি কিছু বুঝতে পারলেন না। যে গুরু তাঁকে নিজের ছেলের মতো ভালবাসতেন, তিনিও একদিন রেগে গেলেন। তিনি বললেন, ‘বাপু, অনেক বোকা ছেলে দেখেছি, তোমার মতো বোকা কখনও দেখিনি।’

এই বকুনি খেয়ে বোপদেব খুব লজ্জা পেলেন। তাঁর একটু অভিমানও হল। তাঁর ধারণা হল যে তাঁর ভাগ্যে পড়াশোনা নেই। অত্যন্ত দুঃখে বোপদেব গুরুগৃহ ত্যাগ করে উদাসীনের মতো পথে পথে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন।

এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে তিনি একটি পুকুরের বাঁধাঘাটে গাছের তলায় বসে নিজের অদৃষ্টের কথা চিন্তা করতে লাগলেন। সেখানে বসে তিনি লক্ষ্য করলেন যে একে একে পল্লীবধূরা স্নান করতে আসছে—প্রত্যেকের কাঁধে একটি করে মাটির কলসি। তারা ঘাটের ওপর কলসি রেখে স্নান করছে। স্নান করা হয়ে গেলে আবার কলসিতে জল ভরে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। দেখে বোপদেবের খুব কৌতূহল হল। ঘাটের ওপর কলসি কীভাবে সোজা হয়ে থাকছে? তিনি তখনই উঠে গিয়ে দেখলেন যে অনবরত কলসি রাখার ফলে শাণের ওপর একটা গর্ত হয়ে গেছে। তাই সেখানে কলসি সোজা হয়ে থাকে। এই দেখে হঠাৎ তাঁর এই ব্যাপারে বোধোদয় হল।

বোপদেব এই ব্যাপারটা নিয়ে অনেকক্ষণ ভাবতে লাগলেন। ভাবতে ভাবতে শেষে গুরুগৃহে ফিরে গেলেন। গুরু তাঁর শিষ্যকে ফিরে পেয়ে আনন্দে বুকে টেনে নিলেন। বোপদেব বললেন—‘গুরুদেব, আমাকে ক্ষমা করুন। মাটির কলসির ঘর্ষণে যদি পাথর ক্ষয়ে যায়, তাহলে আমার মতো জড়বুদ্ধিরও গতি হবেই হবে। ঘষতে ঘষতে যদি এত কঠিন প্রস্তর ক্ষয়ে যেতে পারে, তাহলে আমার মোটা বুদ্ধি সরু হবে না? আপনি আমাকে মারুন, ধরুন, যা-ই করুন, আমি আর ধৈর্য হারাব না।’ পরে এই বোপদেব শুধুমাত্র অধ্যবসায়ের গুণে ভারতবর্ষের মধ্যে একজন অসাধারণ পণ্ডিত হয়ে উঠলেন।

ঋণ: পুরাকথিকা। চলিত করেছেন ঝিলমিল বসু।