Categories
পুরাণপাড়া |

ভগীরথের কথা

3115 |
Share
| ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০
মনোমোহন রায়

লেখক কলিকাতা কমলা হাই স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক ছিলেন

চিত্র: ভগীরথ শঙ্খধ্বনি করে গঙ্গা আনয়ন করছেন। ঋণ: (বাঁদিক থেকে) প্রথম চিত্র: তুলসীদাসের রামায়ণ থেকে গৃহীত, Wikimedia Commons; দ্বিতীয় চিত্র: কাশীরামদাসের মহাভারত থেকে গৃহীত। দুটি ক্ষেত্রেই শিল্পীরা অজ্ঞাত।

গঙ্গা নদীর কথা আমরা সকলেই জানি। এও জানি গঙ্গা হিমালয় পর্বত থেকে সৃষ্টি হয়ে সাগরে গিয়ে মিশেছে। কিন্ত এই গঙ্গা কীভাবে স্বর্গ থেকে মর্ত্যে এলেন সেই গল্প আমাদের অনেকেরই অজানা।

পুরাণে কথিত আছে আজ থেকে অনেক যুগ আগে ভগীরথ নামে সূর্যবংশের এক রাজা গঙ্গা দেবীকে স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে নিয়ে আসেন। এইজন্য গঙ্গার আরেক নাম ভাগীরথী। কিন্তু কীভাবে তিনি গঙ্গাকে নিয়ে আসেন, আজ সেই গল্পই বলব।

হরিশচন্দ্রের বংশে সগর নামে একজন খুব বিখ্যাত রাজা ছিলেন। আর তাঁর ছিল ষাট হাজার একজন পুত্র। সেই সগর রাজা ঠিক করলেন তিনি অশ্বমেধ যজ্ঞ করবেন। সেই মতো একটি ঘোড়ার কপালে জয়-পতাকা লিখে তিনি ছেড়ে দিলেন বিশ্ব ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। অপেক্ষা করতে লাগলেন, ঘোড়াটি কবে দেশ-বিদেশ ঘুরে ফিরে আসবে এবং সেই ঘোড়ার মাংস দিয়ে তিনি যজ্ঞ করে ইন্দ্রত্ব লাভ করবেন।

এদিকে দেবরাজ ইন্দ্র এই যজ্ঞের আয়োজন দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি ভাবলেন, রাজা যদি রাজচক্রবর্তী হয়ে পুরো স্বর্গটাই চেয়ে বসেন, তখন কী হবে? তাই তিনি ফন্দি করে যজ্ঞের ঘোড়াটি পাতালে কপিল মুনির আশ্রমে বেঁধে রেখে এলেন। এদিকে ঘোড়াকে ধাওয়া করছিলেন রাজার ষাট হাজার পুত্র। তাঁরা হঠাৎ ঘোড়াটি নিরুদ্দেশ হয়ে যেতেই তাকে খুঁজতে শুরু করে দিলেন। আর খুঁজতে খুঁজতে তাঁরা পৌঁছে গেলেন কপিল মুনির আশ্রমে। ঘোড়াটিকে সেখানে দেখতে পেয়ে তাঁরা মুনির উপর খেপে গিয়ে তাঁকে মারতে লাগলেন। মুনি যত বলেন ‘আমি ধ্যান করছিলাম, আমি জানি না একে এখানে কে রেখে গেছে’— ততই আরও বেশি করে মারতে লাগলেন সবাই, শেষে মুনি রেগে গিয়ে ক্রোধের চোখে তাঁদের দিকে তাকাতেই, তাঁরা সবাই পুড়ে ছাই হয়ে গেলেন।

খবর পাওয়া মাত্র সগরের এক নাতি পাতালে গিয়ে মুনির পা ধরে কান্নাকাটি শুরু করলেন। তাঁর চোখের জল দেখে মুনির মায়া হল, তিনি তখন তাঁকে বললেন ‘তোমার ছেলের ছেলে গিয়ে যদি স্বর্গ থেকে গঙ্গাকে নিয়ে আসতে পারে তবে গঙ্গা দেবীর আশীর্বাদে এরা আবার দেহ ফিরে পাবে।’

তিনি ফিরে এসে সব কথা খুলে বলতে, তাঁর পুত্রের নাতি ভগীরথ তপস্যা করতে রাজি হয়ে গেলেন। হাজার বছর ধরে তিনি এমন তপস্যা করলেন যে বিষ্ণু খুশি হয়ে তাঁর হাতে একটি শঙ্খ দিয়ে বললেন ‘তুমি শঙ্খ বাজিয়ে আগে আগে যাও, গঙ্গা দেবী তোমার পিছনে পিছনে পৃথিবীতে যাবেন।’

কথামতো ভগীরথ চললেন আর পিছনে গঙ্গা। কিন্তু মুশকিল হল, স্বর্গ থেকে মর্ত্যে পরার সময় গঙ্গার গতি এতটাই বেড়ে গেল যে সেই গতিতে পৃথিবী ধ্বংস পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। তাই সেই গতি ধারণ করার জন্য ভগীরথ শিবের তপস্যা শুরু করলেন। শিব তপস্যায় তুষ্ট হয়ে জটা খুলে মাথা পেতে দাঁড়ালেন। গঙ্গাও তাঁর মাথায় পড়লেন। অমনি পৃথিবী কেঁপে উঠল।

আসলে গঙ্গা চেয়েছিলেন তাঁর স্রোতে মহাদেবকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবেন। গঙ্গার মনের কথা বুঝে তাঁর অহংকার চূর্ণ করতে শিব তাঁকে জটায় আবদ্ধ করলেন। সেই দেখে ভগীরথ পড়লেন বিপদে। তিনি আবার তপস্যা শুরু করলেন। মহাদেব তাতে খুশি হয়ে গঙ্গাকে দিলেন ছেড়ে। অমনি গঙ্গা কলকল রবে পৃথিবীতে বইতে শুরু করলেন।

কিছুদূর গিয়েই জহ্নুমুনির আশ্রম। সেখানে তিনি তপস্যায় মগ্ন ছিলেন। গঙ্গার স্রোতে তার আশ্রম, পূজার সামগ্রী গেল ভেসে। অমনি তিনি রেগে গিয়ে সমস্ত গঙ্গার জল পান করে ফেললেন। এই দেখে ভগীরথ আবার পড়লেন চিন্তায়। তিনি মুনিকে সাধ্যসাধনা করলেন, মুনিও তার কথায় খুশি হয়ে নিজের জানু চিরে গঙ্গাকে মুক্ত করে দিলেন। এইজন্যই গঙ্গার আরেক নাম জাহ্নবী।

এরপর গঙ্গার স্রোত পৃথিবী অতিক্রম করে গিয়ে পড়ল পাতালে সগর মুনির ছেলেদের ছাইয়ের উপর। অমনি তাঁরা কপিল মুনির কথামতো আবার জীবন ফিরে পেলেন। এইভাবে গঙ্গার জলে সগর-বংশ উদ্ধার হয়েছিল বলে হিন্দুরা গঙ্গাকে অতি পবিত্র মনে করেন।

ঋণ: ছোটদের ইতিকথা, মনোমোহন রায়। চলিত করেছেন জয়তী ভট্টাচার্য।