Categories
খেলার মাঠ |

ভারত মহাসাগরে সন্তরণ অভিযান

238 |
Share
| ১৮ জানুয়ারী, ২০২৩
মিহির সেন

ভারত-বিখ্যাত সাঁতারু

চিত্রঋণ: ইন্টারনেট থেকে গৃহীত; সুপ্রিয়া সেন

সমুদ্র চিরদিনই আমায় আকর্ষণ করেছে৷ কী করব পয়সাকড়ি তেমন নেই, তাই নিজের কোনও কলে চালানো নৌকো বা জাহাজে চড়ে আমার সাগর ভ্রমণের ইচ্ছা পূরণ করবার সুযোগ কোনও দিন হয়নি৷ তাই সাঁতার কেটে সমুদ্র ভ্রমণের নেশা আমি মিটিয়েছি৷

ভারত মহাসাগরই আমায় চিরদিন বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছে৷ পুরীতে, বম্বেতে, গোপালপুরে আমি সাঁতার কেটেছি৷ সত্যি সত্যি এসব জায়গায় সাঁতার কেটে আমি যে শুধু খুব আনন্দই পেয়েছি তা নয়, কেমন যেন একটা অদ্ভুত উন্মাদনার ভাব আমার ভেতর এসেছে৷ ইংলিশ চ্যানেল পার হবার আগে পর্যন্ত পক-প্রণালীতে সাঁতার কাটার কথা আমার মনে আসেনি৷ ইংলিশ চ্যানেলে সাফল্য লাভ করার পর ভাবলাম, বাড়ির কাছে কোথাও এমনই কিছু একটা করলে হয় না কি?

ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যবর্তী এই অঞ্চলের সমুদ্রের এমন একটা ঐতিহ্য রয়েছে, যা মানুষকে সব সময় জানিয়েছে যুদ্ধের আহ্বান৷ এমন বিপদ-সঙ্কুল সমুদ্র পৃথিবীতে আর নেই বললেও চলে৷ বিপদের সাথে যুদ্ধ করার আমার বেশ একটা নেশা রয়েছে৷

প্রায় ছ’বছর আগে ভারতের ধনুষ্কোডি ও শ্রীলঙ্কার তালাইমান্নার আমার ভবিষ্যৎ লক্ষ্য বলে আমি স্থির করে রেখেছিলাম৷ মানচিত্রে এই দুই জায়গার মধ্যবর্তী স্থলে আমি চিহ্ণও দিয়ে রেখেছিলাম৷ এজন্য আমি নীরবে ১৯৬০ সাল থেকে কলকাতার ঢাকুরিয়া লেকে সাঁতারের অভ্যাসও করছিলাম৷ দূরপাল্লার সাঁতারের প্রস্তুতির পক্ষে ঢাকুরিয়া লেক বেশ ভাল জায়গা৷ শুধু তাই নয়, এই সমুদ্র সম্পর্কে আমি সবরকম সংবাদ সংগ্রহের জন্য চেষ্টাও করে চলেছিলাম৷ অবশ্য সবই চুপি চুপি, কাউকেই আমি আমার ভবিষ্যতের পরিকল্পনা জানতে দিইনি৷

দূরপাল্লার সাঁতারের প্রশিক্ষণ নেওয়া বা ওই সাগরের চরিত্র সম্পর্কে সংবাদ সংগ্রহ করা, কোনওটাই কিন্তু খুব সহজ ছিল না৷

বহু সংবাদ আমি নানা জায়গা থেকে পেলাম বটে, কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই বুঝলাম যে, এ সম্পর্কে খুব অল্পই আমি জানতে পেরেছি৷ বিশেষ করে এখানকার স্রোতের গতি ও জোয়ার-ভাঁটা সম্পর্কে৷

ইংলিশ চ্যানেলের সঙ্গে এই অবস্থায় পক-প্রণালীর তুলনা আসা স্বাভাবিক৷ পক-প্রণালীর তুলনায় ইংলিশ চ্যানেলকে অত্যন্ত নিরীহই মনে হবে৷ সেখানে সাঁতার কাটা খুবই সহজ৷ ইংলিশ চ্যানেলের গতি-প্রকৃতি সবারই জানা, সেখানে সাঁতারের ব্যাপারে সাহায্যের জন্য সমিতি রয়েছে, পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্য লোক আছে, আবহাওয়া, জোয়ার-ভাঁটা, সাগরের গতি-প্রকৃতির খবর সবকিছুই চাওয়া মাত্রই পাওয়া যেতে পারে৷

কিন্তু পক-প্রণালীর ব্যাপার অন্যরকম৷ প্রথমেই খোঁজ করতে হবে, কোথা থেকে এসব খবর পাওয়া যেতে পারে৷ তারপর ওইসব জায়গা থেকে খবর নিয়ে ঠিক করতে হবে কোনটা ভুল, কোনটা ঠিক৷

এখানে মৌসুমী বায়ু বছরে দু’বার করে আসে— দক্ষিণ-পশ্চিম এবং উত্তর-পূর্ব এই দু’দিক থেকে৷ সুতরাং এখানে সাঁতার কাটতে হলে মার্চের প্রথম দিকটাই হচ্ছে নিরাপদ সময়৷ ঐ মাসের প্রথম দিক থেকে মাত্র ত্রিশ দিন সময় এখানে সাঁতার কাটা চলতে পারে৷

সমুদ্রের বিপদ-আপদও এখানে বেশ রয়েছে৷ সাঁতারুদের পক্ষে তাই এই জায়গাটা কিন্তু খুব একটা নিরাপদ নয়৷ এখানকার সমুদ্রে রয়েছে ভীষণ ভয়ঙ্কর সব জলচর প্রাণী৷ সব সাঁতারুই এদের রীতিমতো ভয় করে৷ এর মধ্যে রয়েছে এক শ্রেণির বাঘা হাঙর, তার একটি শ্রেণি হচ্ছে শক্ত মাথাওয়ালা৷ এই দুই জাতীয় হাঙরই নরখাদক৷ আর এক জাতীয় প্রাণী রয়েছে এখানে— নাম ব্যারাকুডা৷ এই দু’জাতীয় প্রাণীই ভয়ঙ্কর হিংস্র৷ সজীব কোনও কিছু দেখলেই অমনি তেড়ে আসে৷ এক রকম রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে হাঙরগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়, বন্দুকের আওয়াজ বা গুলি করে ব্যারাকুডাকেও ভয় দেখানো চলে৷ কিন্তু সবচেয়ে বেশি বিপদ হচ্ছে ভারত মহাসাগরের সাপ জাতীয় প্রাণীদের নিয়ে৷ এখানে ‘আদমের পুল’ নামে পরিচিত যে সব ডুবো পাহাড় আর চোরা বালি রয়েছে, সেগুলোই হচ্ছে সাপদের অত্যন্ত প্রিয় আড্ডা৷ তিন ফুট থেকে ত্রিশ ফুট লম্বা হয় এই সাপগুলো৷ এসব সাপ মারাত্মক রকমের বিষাক্ত৷ সাধারণ সাপের সঙ্গে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে এই সব সামুদ্রিক সাপের৷ এমনি ওরা কাউকে কিছু করে না৷ যদি কখনও আঘাত পায় বা ওদের গায়ে কারও হাত লাগে, তাহলে ওরা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে৷ সাঁতারুদের পক্ষে এই সব সাপ হল সত্যিকারের বিপদ৷ সাঁতার কাটবার সময় হঠাৎ সাঁতারুর অজ্ঞাতসারেই হয়তো সাপের গায়ে হাত লেগে গেল৷ তখন রক্ষা পাওয়াই কঠিন৷ আমার সাঁতারের সময় দিনের বেলায় কিছু কিছু সাপ আমার চোখে পড়েছে বটে, কিন্তু রাত্রিবেলায় এর সংখ্যা অগুণতি৷ এর প্রতিকারের তো কোনও উপায় নেই৷ ভগবানের ওপর ভরসা করেই এখানে চলতে হয়৷

এছাড়াও এখানে সাঁতার কাটতে হলে কতকগুলো বাস্তব এবং রাজনৈতিক সমস্যাও রয়েছে৷ এসবের সমাধান খুব সহজ নয় কিন্তু৷ ভারত ও শ্রীলঙ্কার ভেতর ভ্রমণ বেশ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়৷ ভিসা, এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়ার নিয়ম-কানুন, বিদেশি মুদ্রা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপার, স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো সবকিছুই এর ভেতর রয়েছে৷ এসব কড়াকড়ি থেকে আমি রক্ষা পেয়েছিলাম তৎকালীন ভারত সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং-এর সৌজন্যে৷

এরপর আরও ব্যাপার রয়েছে৷ মাদ্রাজ সরকারের সহযোগিতা ছাড়া তার সমাধান সম্ভব নয়৷ ধনুষ্কোডি সহ রামেশ্বরমের পূর্ব দিক থেকে সমুদ্রতীরের শেষ পর্যন্ত প্রায় চল্লিশ মাইল জায়গা হচ্ছে নিষিদ্ধ এলাকা৷ ১৯৬৩ সালের ভীষণ ঝড়ে ভারতের মানচিত্র থেকে ধনুষ্কোডি মুছে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল৷ বিষুব রেখার অন্তর্গত সাগরে হঠাৎ যে ঝড় ওঠে তা-ও এই অঞ্চলের এক বড় বিপদ৷ মাদ্রাজ সরকার তাঁদের কঠোর আইন-কানুন সঙ্গে সঙ্গেই শিথিল করে আমার কাজটা বেশ সহজ করে দিলেন!

এখানে একটা কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, সেটা হচ্ছে ভারত সরকারের নৌ-বিভাগের সাহায্য৷ এই সাহায্য না পেলে আমার সমস্ত চেষ্টাই কিন্তু বিফল হয়ে যেত৷ অ্যাডমিরাল চ্যাটার্জি ভারতীয় নৌ-বিভাগের কামানবাহী ‘সুকন্যা’ ও ‘সারদা’ এই দুটো জাহাজকে হুকুম করলেন আমার এই অভিযানে আমাকে সাহায্য করবার জন্য৷ আমি যাতে কোনওভাবে বিপন্ন না হয়ে পড়ি, সেদিকে তীক্ষ্ন দৃষ্টি রাখবার জন্যও তিনি এদের আদেশ দিয়েছিলেন৷

২৯ মার্চ আমরা মণ্ডপমে গিয়ে শিবির স্থাপন করলাম৷ প্রথমটায় মাত্র আমরা কয়েকজনই ছিলাম৷ অল্প দিনের ভেতরেই সেখানে যেন মানুষের মেলা বসে গেল৷ সারা দেশ থেকে এলেন সংবাদপত্রের রিপোর্টাররা আর এলেন আকাশবাণীর বিখ্যাত ভাষ্যকার মেলভিল ডি. মেলো তাঁর দলবল নিয়ে৷

এখানকার আদিম যুগের সেই যাতায়াত এবং সংবাদ আদান-প্রদানের ব্যবস্থা সংবাদ প্রতিনিধিদের খবর পাঠানোর ব্যাপারে বেশ ক্লেশকর বলে তাঁদের ওপর খুব চাপ পড়ল৷ কিন্তু এ ব্যাপারে সবচেয়ে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন আকাশবাণী৷

আমার সন্তরণ শেষে তীরে এসে পৌঁছবার দশ মিনিটের মধ্যেই এই সাফল্যের সংবাদ বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়েছিল৷ কী করে যে এটা সম্ভব হয়েছিল বুঝতে পারিনি, কারণ সেখানে আমি সংবাদ পাঠাবার মতো কোনও উপযুক্ত ব্যবস্থা দেখতে পাইনি৷

৩ এপ্রিল ভোর পাঁচটায় তালাইমান্নার থেকে সাঁতার শুরু হবে এই ঠিক ছিল৷ কথা ছিল আগের দিন সকাল সাতটায় আমরা শ্রীলঙ্কা যাত্রা করব এবং রাত্রিটা কাটাব তালাইমান্নার সার্কিট হাউসে৷ হঠাৎ ঠান্ডা লেগে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ায় সব ব্যবস্থাই হয়ে গেল ওলটপালট৷ বেশ কয়েকদিন ধরেই আমি মান্নার উপসাগরে প্রশিক্ষণ নিয়ে আমার কাজের জন্য তৈরিও হচ্ছিলাম৷ কিন্তু অসুস্থতার জন্য শেষ পর্যন্ত ঐ দিন আর আমার রওনা হওয়া হল না৷ আটচল্লিশ ঘণ্টার জন্য সাঁতার বন্ধ রাখতে হল৷ পেনিসিলিন চিকিৎসা শুরু হল, ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই আমি কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলাম, জ্বর-জ্বর ভাবও দূর হল৷

৫ এপ্রিল, পূর্ণিমার রাত্রি৷ পূর্ণিমায় সাগর চন্দ্রাহত হয়ে যেন পাগল হয়ে ওঠে৷ এটা জেনেও দুটো কারণে আমাকে ঐ দিনই সাঁতার কাটতে নামতে হল৷

খেয়ার মাঝিমাল্লা, বন্দর কর্তৃপক্ষ, এইরকম অনেক মানুষ যাদের এখানকার সমুদ্র সম্পর্কে প্রায় বিশ-পঁচিশ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাঁরা সকলেই আমাকে বললেন, বছরের এই সময়টায় পূর্ণিমায় সমুদ্রের জোয়ার-ভাঁটায় খুব বেশি পার্থক্য হয় না৷ যা হয় তা তেমন কিছু উল্লেখযোগ্য নয়৷ সুতরাং তাঁদের কথা শুনে আমি স্থির করে ফেললাম যে এই দিনই আমি সাগরে নেমে পড়ব৷

সময় পরিবর্তন না করবার আরও একটি কারণ ছিল৷ আরও শুনলাম যে, দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর আসবার সময় এসে গেছে৷ যে কোনও দিন এসে যেতে পারে৷ একবার যদি এসে যায়, তা হলে আর রক্ষা নেই৷ আরও এগারো মাস অপেক্ষা করতে হবে৷ সুতরাং, খুবই তাড়াহুড়ো করতে হল আমাকে৷

আমি হিসেব করে দেখেছিলাম যে বারো থেকে পনেরো ঘণ্টায় আমার সাঁতার শেষ হবে৷ যে সব খবর আমি পেয়েছিলাম তার ওপরে নির্ভর করেই আমাকে ওই হিসেবটা করতে হয়েছিল৷ শেষ পর্যন্ত দেখা গেল সবই ভুল৷ আমার তখনও অনেক কাজ বাকি ছিল৷ ইংলিশ চ্যানেল ও পক্ প্রণালীতে এই হচ্ছে পার্থক্য৷ সঠিক খবর এখানে পাওয়া যায় না৷

আমার সাঁতারের প্রথম দিকটা বেশ ঘন অন্ধকারের ভেতর কাটল৷ তখন আমাকে স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটতে হচ্ছিল৷ অবশ্য তখন আমার বিশেষ অসুবিধা হয়নি৷ কারণ তখনও আমি বেশ সতেজ ছিলাম৷ শীগগিরই সূর্যদেব ধীরে ধীরে আকাশে উঠলেন৷ প্রথম দিকটা বেশ উত্তেজনার মধ্যে ভালভাবেই কাটল৷ কিন্তু ন’টার পর থেকেই সূর্যের তেজ বিশেষভাবে বেড়ে চলল৷ আমি সূর্যের প্রখর তেজে অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম৷ আমার পিপাসা পেতে লাগল৷ এরকম দীর্ঘ সাঁতারে সাঁতারুদের সাধারণ তরল খাদ্যের ওপরই নির্ভর করতে হয়৷ ডাবের জল, মধু, লেমোনেড ও খুব ঠান্ডা জল পান করেই আমি যতটা সম্ভব ক্ষুধা নিবৃত্তি করতে লাগলাম৷ ঠান্ডা পানীয় পান করেও এই দারুণ গরমে আমার অস্বস্তির ভাব যে বিশেষ দূর হল তা নয়৷ আমি ঘণ্টায় ১.৭৫ থেকে ১.৫০ নট (৬০৮০ ফুট) গতিতে সাঁতরে চলেছিলাম৷ আমি যে হিসেব পেয়েছিলাম তাতে দুপুর বারোটায় আমার অর্ধেক পথ এসে যাবার কথা৷ আড়াইটার সময় আমি শুনলাম যে, যেখানে এসে আমি পৌঁছেছি সেখান থেকে ভারতের তীর আট মাইলের মধ্যে৷ সারে চারটেয় ধনুষ্কোডি থেকে পাঁচ মাইল দূরে রয়েছি বলে আমাকে জানানো হল৷ আমি হিসেব করে দেখলাম বেশ ভালভাবে সাঁতার কেটে গেলে আরও তিন ঘণ্টায় আমি লক্ষ্যে পৌঁছে যাব৷ সুতরাং রাত আটটায় আমার সাঁতার শেষ হবে৷ আকাশবাণীর মেলভিল ডি. মেলো ও সাংবাদিকের দল পাঁচটার সময় আমার কাছ থেকে জানতে চাইলেন আমি কেমন বোধ করছি৷ লক্ষ্যস্থল আমার হাতের ভেতর এসে গেছে বুঝতে পেরে আমি উৎফুল্ল হয়ে তাদের কথার জবাব দিলাম যে, গড়ে সাতটায় আমি লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে যাব৷

সবই বেশ ভালভাবে চলছিল৷ সন্ধে হওয়ার আগে পর্যন্ত আমি ভাবছিলাম যে সন্ধেতেই আমি তীরে পৌঁছে যাব৷ সাড়ে সাতটার সময় আমি ভারতীয় নৌ-বিভাগের লে. মার্টিসকে প্রশ্ন করে জানলাম যে তীর আর মাত্র দু’মাইল দূরে৷ এই সম্পর্কে তাঁর কোনও সন্দেহ নেই, এ-ও তাঁর কথাতেই বুঝলাম৷ লে. মার্টিস তাঁর দলবল নিয়ে জাহাজে করে আমার জীবন রক্ষা করার জন্য আমার সঙ্গে সঙ্গেই ছিলেন৷ কিন্তু তখন আমি বুঝিনি যে কী মারাত্মক ভুল ধারণার মধ্যে আমরা উভয়েই ছিলাম৷ মার্টিস তাঁর কথা ঠিকভাবে জেনে নেওয়ার জন্য নৌ-বিভাগের বড় জাহাজ ‘সারদা’য় গেলেন৷ সেখানে লে. শর্মার কাছ থেকে তিনি জানলেন, এখনও আমরা তীর থেকে ছ’মাইল দূরে৷ রাডারে পরীক্ষা করেও তাই জানা গেল৷ লে. শর্মা যা বললেন, তাই সত্য বলে প্রমাণিত হল৷ মার্টিস এসে যখন আমাকে এই খবর দিলেন, আমার তো প্রায় পাগল হওয়ার উপক্রম৷ ভাবলাম, এ কী করে হল! অনুকূল অবস্থার মধ্যে তিন ঘণ্টা সাঁতার কাটবার পর এমন কী করে হতে পারে৷ এখানে তো কোনও বাধাই ছিল না৷ ভুল, সবই ভুল হয়েছিল, আমরা ধনুষ্কোডির দিকে না গিয়ে বিশ মাইল দক্ষিণে রামেশ্বরমের দিকে চলে গিয়েছিলাম৷ শুনে আমার মনের অবস্থা যে কী হয়েছিল, ভাষায় তা বর্ণনা করা যায় না৷ এর আগে আমার এমন কোনও অভিজ্ঞতা হয়নি৷

তখন আকাছে চাঁদ উঠে গেছে৷ রাত্রি আটটায় শুরু হবে জোয়ারের বন্যা৷ অল্প সময়ের মধ্যেই জোয়ার এসে গেল৷ সমুদ্র যেন পাগল হয়ে উঠল৷ শান্ত সমুদ্রের কী রূপ পরিবর্তন! কী বড় বড় ঢেউ! ঐ সময় পর্যন্ত আমি একটানা পনেরো ঘণ্টা সাঁতার কেটেছি৷ বেশিরভাগ সময়ই কেটেছিল প্রখর সূর্যের তেজের মধ্যে৷ এরই মধ্যে আমাকে আক্রমণ করতে এল এক বিরাট আকারের সাপ৷ মার্টিস যদি শেষ পর্যন্ত গুলি করে ঐ সাপটাকে না মারতেন তবে হয়তো সেদিন সাপের মুখেই আমার প্রাণ যেত৷ তখন আমার অবস্থা বর্ণনার অতীত। বিরাট দশ ফুটের উঁচু ঢেউয়ের সঙ্গে শরীরের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে তখন আমাকে এগোতে হচ্ছিল৷ তখন থেকে শুধু মনের জোরের ওপর নির্ভর করেই আমাকে চলতে হচ্ছিল৷

সাগর বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠার পর থেকেই বহু বিপদ দেখা দিল৷ নৌ-বিভাগের যে চারখানা জাহাজ আমার সাঁতারের তদারকিতে নিযুক্ত ছিল, তারাও সব সময় ঠিকভাবে আমার সঙ্গে সঙ্গে ঠিক পথ ধরে এগোতে পারছিল না৷ এই সময় মার্টিস নিজে জাহাজগুলো ঠিকভাবে পরিচালনা করবার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন৷ তিনিই পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন৷ এই সময় তিনি এক একবার ছুটে যেতেন সারদায়, লে. শর্মার সঙ্গে আলোচনা করে পথের নিশানা নিয়ে ফিরে আসতেন৷ এরপর থেকে তিনি তাঁর জাহাজগুলো নিয়ে কখনও আমার আগে, কখনও আমার পিছনে থেকে আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন৷ চন্দ্র ও তারকার সঠিক অবস্থান থেকেই তিনি দিক জেনে নিচ্ছিলেন৷

এখন জুটল আর এক বিপদ৷ সাপ যে কত দেখা দিতে লাগল, তার সীমা-সংখ্যা নেই! ছোট-বড় নানা আকারের সব সাপ৷ ক্রমাগত বন্দুকের আওয়াজ করে, সাপগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখবার ব্যবস্থা হল৷ রাত্রির ভয়ঙ্কর ভাবটা এই আওয়াজে কিছুটা দূর হতে লাগল৷ রাত্রিবেলা এক সময় শোনা গেল, ‘হোয়েলার’ জাহাজটার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না৷ নানারকম আশঙ্কাই সবার মনে এসে গেল৷ ভাগ্যক্রমে এই হারানো জাহাজের সন্ধান পাওয়া গেল৷ ‘সুকন্যা’র কমান্ডার লে. যোগীন্দার সিং-এর চেষ্টায় এই ব্যাপারটি সম্ভব হয়েছিল৷ সংবাদপত্রের সংবাদদাতারা ও আকাশবাণীর মেলভিল ডি. মেলো বিনিদ্র রজনী যাপন করেও আমার ওপর সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিলেন এবং আমাকে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছিলেন৷

শেষ পর্যন্ত রাত্রি একটায় জোয়ারের বান কতকটা কমে এল৷ আমার কাজ কিছুটা সহজ হয়ে এলেও, আমার সাঁতার কাটতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল৷ সারা রাত্রি ধরেই চলছিল সাগরের বিক্ষোভ আর বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ৷

রাত্রি তিনটেয় ধনুষ্কোডি তীরভূমি আমার দৃষ্টিগোচর হল৷ ভোর পাঁচটার দিকে চন্দ্র অস্ত গেল৷ ধনুষ্কোডির তীরের একটা রূপালি রেখা আমার চোখের সামনে প্রায় ভেসে উঠল৷ শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যস্থল আমার দৃষ্টিগোচর হল৷ কিন্তু তখনও আমার পরিশ্রমের সমাপ্তি হয়নি৷ আরও আড়াই ঘণ্টা আমায় সমুদ্রের সঙ্গে লড়াই করতে হবে৷ লক্ষ্যস্থল দৃষ্টিগোচর হওয়ার ফলে, আমার শ্রান্তি যেন ধীরে ধীরে লাঘব হতে লাগল৷ নতুন উৎসাহ, নতুন শক্তিতে আমি এগিয়ে চললাম৷ ক্রমে ক্রমে কিন্তু ধীরে ধীরে আমি লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চললাম৷ যদি আরও ত্রিশ ঘণ্টাও লাগে তা হলেও আমি পিছপা হব না, এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে আমি এগিয়ে চললাম৷

শেষ পর্যন্ত সকাল ৭:২৪ মিনিটে এক প্রবল উত্তেজনার মধ্যে আমি তীরে পৌঁছে গেলাম৷ চল্লিশ মাইল সাঁতারের পরিসমাপ্তি ঘটল এখানেই৷ সে কী আনন্দ আমার! সুদীর্ঘকাল প্রবাসে থাকার পর বাড়ি ফিরে আসার যে আনন্দ সেই আনন্দই তখন আমার মনে-প্রাণে! দিন-রাত্রির কঠোর পরিশ্রমে দেহের প্রতিটি পেশী ও অস্থিতে তীব্র বেদনা নিয়ে আমি এসে দাঁড়ালাম ভারতের তীরে৷ ধীরে ধীরে সমুদ্র থেকে উঠে এলাম ওপরে৷ সমুদ্র সে তো আন্তর্জাতিক ব্যাপার, কিন্তু এবার আমি পুরোপুরি স্বদেশের মাটিতে এসে দাঁড়িয়েছি৷ স্বদেশের মাটিতে দাঁড়াবার সে যে কী উন্মাদনা তা ভাষায় প্রকাশ করা আমার পক্ষে সহজ নয়৷ চারিদিকে হাসি-অশ্রু, ফটো ক্যামেরার আলোর ঝলকানি৷ সানাইয়ের সুমধুর রাগিনী আমাকে স্বদেশে স্বাগত জানাতে লাগল ছন্দে ছন্দে৷ কেউ লাফাচ্ছিল, কেউ নাচছিল, আর যাদের আনন্দের মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল তারা মাটিতেই গড়াগড়ি দিচ্ছিল৷ সেখানে ছিলেন আমার স্ত্রী বেলা, স্বস্তির একটা বিশেষ ভাব তাঁর মুখের ওপর ফুটে উঠেছিল, আর চোখে ছিল আনন্দাশ্রু৷ আর ছিল আমার পরম আদরের ছোট ভাই কল্যাণ, তার যে কী আনন্দ, পঁচিশ ঘণ্টা ছত্রিশ মিনিট ধরে সে আমায় সজাগ রাখবার জন্য শব্দ করে চলেছিল অক্লান্ত পরিশ্রমে৷ ভারতীয় নৌ-বিভাগের লে. শর্মা, যাঁর ওপর ছিল আমার এই অভিযানের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, তাঁর সঙ্গে লে. যোগীন্দর সিং ও লে. মার্টিস এঁরা তিনজনেই দাঁড়িয়েছিলেন এসে আমার পাশে৷ কী যে আনন্দ তাঁদের, সে আর কী বলব! আমার এই সাফল্য যেন তাঁদেরও সাফল্য৷

‘সুকন্যা’র রেডিও ঘর থেকে নৌ-বিভাগের প্রধান ঘাঁটিতে সংবাদ পাঠানো হল—‘সকাল ৭টা ২৪ মিনিটে সাফল্যের সাথে সাঁতার শেষ হয়েছে৷’ সারা পৃথিবীতে এখান থেকে এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল৷

যোগীন্দর সিং-এর জাহাজে ওঠবার সঙ্গে সঙ্গেই আমার হাতে দেওয়া হল একটি রেডিওর খবর৷ এ কী, আমার দৃষ্টি কি ঝাপসা হয়ে এল নাকি! সংবাদটা পড়ে উচ্ছ্বাসে আমি যেন ভেঙে পড়বার মতো হয়ে গেলাম৷ সেটা হচ্ছে আমার জীবনের সবথেকে শুভ মুহূর্ত, সে আনন্দ হয়তো জীবনে আর ফিরে আসবে না৷ আমার সাফল্যে অভিনন্দন জানিয়ে এক বাণী পাঠিয়েছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি৷

এই বিপজ্জনক অভিযানে আমি ব্রতী হয়েছিলাম কেন? সে প্রশ্নের জবাবে আমার একটাই মাত্র উত্তর আছে, সেটা হচ্ছে সারা দুনিয়ার মানুষকে এই কথাই ভালভাবে জানিয়ে দেওয়া যে, কোনও কাজকেই ভারতবাসী আজ আর ভয় করে না৷ এই একটি মাত্র উদ্দেশ্যই ছিল আমার এই বিপজ্জনক অভিযানের৷ শুধুমাত্র বিজয়ীর গৌরব লাভ করবার জন্য জীবনের দায়িত্ব নিয়ে এই কাজে আমি নামিনি৷

ভারতের যুবকদের কাছে আমার এই আবেদন রইল, সর্বপ্রকার বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে তাঁরা যেন জীবন-যুদ্ধে অবতীর্ণ হন৷ সে দেহচর্চার ক্ষেত্রেই হোক বা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে৷ সারা বিশ্বে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের এক গৌরবময় স্থান করে নিতে হবে৷ আমার ভারত মহাসাগরে এই অভিযানও তারই এক দীনতম প্রচেষ্টা মাত্র৷

এই লেখাটি ১৯৬৬ সালের বার্ষিক শিশুসাথী থেকে পুনর্মুদ্রিত