Categories
আঁকানিকেতন |

ভার্জিন অফ দ্য রকস

1667 |
Share
| ১৮ অক্টোবর, ২০২০
বিভাস সাহা

অর্থনীতির অধ্যাপক, ডারাম ইউনিভার্সিটি, ইংল্যান্ড

প্রথম ‘ভার্জিন অফ দ্য রকস’, ১৪৮৩-৮৬, কাঠের উপর তেল রং, ৭৮.৩ ইঞ্চি x ৪৮ ইঞ্চি, চিত্র সৌজন্য: লুভের মিউজিয়াম, প্যারিস

মোনা লিসা-কে বাদ দিলে লিওনার্দোর বেশির ভাগ ছবিই কুমারী মাতা মেরিকে নিয়ে। তার একটি বড় কারণ ক্যাথলিক চার্চ বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের চাহিদা। এই সময়ে কুমারী মাতা মেরি এবং যীশুর জন্মকাহিনি জনপ্রিয় হয় এবং এটা লিওনার্দোর নিজেরও বেশ পছন্দের বিষয় ছিল বলে মনে হয়। ১৪৭২-৭৩ সালে মাত্র কুড়ি বছর বয়সের অ্যানান্সিয়েশন ছবিটি এই বিষয়বস্তুর উপর আঁকা তাঁর প্রথম ছবি। এটি তাঁর প্রথম স্বাধীনভাবে আঁকা বড় ছবি বলে ভাবা হয়। তার কারণ তিনি ১৪৭২ সালেই শিল্পী হিসাবে লাইসেন্স পেয়েছিলেন।

অ্যানান্সিয়েশন, ১৪৭২-৭৩, প্যানেলের ওপর টেম্পারা এবং অয়েল দিয়ে আঁকা, ৩৯ ইঞ্চি × ৮৫ ইঞ্চি, উফিজি, ফ্লোরেন্স, ইতালি

ছবিটির বিষয়বস্তু হল বাইবেলের একটি অংশ; দেবদূত বা পরি গ্যাব্রিয়েল এসে কুমারী মেরিকে বলছে যে তাঁকে বাছা হয়েছে ভগবান যীশুর মা হওয়ার জন্যে। ছবিটির বিভিন্ন দিক যেমন পার্সপেকটিভ, দূরবর্তী ল্যান্ডস্কেপ, পোশাক-আশাক ইত্যাদি ছিল অসম্ভব রকমের নিখুঁত ও বাস্তবসম্মত। বোঝাই যায় এক প্রতিভাবান শিল্পীর আঁকা। কিন্তু দুই চরিত্রের মুখ ও দেহভঙ্গি ছিল অত্যন্ত যান্ত্রিক ও অভিব্যক্তিহীন। অর্থাৎ তখনও তিনি লিওনার্দো দা ভিঞ্চি হয়ে ওঠেন নি। শুধু তাই নয়, সমালোচকরা মনে করেন মাতা মেরির ডান হাতটি আঁকায় বেশ ত্রুটি আছে— ভাবা যায়, এত বড় শিল্পীরও ভুল হতে পারে! অবশ্য ছবিটি খুব মন দিয়ে না দেখলে ভুলটি চোখে পড়ে না। এই ছবিটির পরে তাঁর বড় কাজের মধ্যে রয়েছে ১৪৭৮ থেকে ১৪৮২-র মধ্যে আঁকা ম্যাডোনা এবং শিশু নামে তিনটে ছবি। মূলত শিশু যীশুকে কোলে নিয়ে তরুণী মা মেরির ছবি। এই ছবিগুলিতে ভবিষ্যত লিওনার্দোর আভাস পাওয়া যায়; এই সময় থেকে তাঁর ছবিতে আবেগ ও অনুভূতির প্রকাশ বাড়তে থাকে।

মাতা মেরির ওপর আঁকা তাঁর সর্বাধিক সফল সৃষ্টি বলা যেতে পারে পাহাড়ের কুমারী বা ভার্জিন অফ দ্য রকস ছবি দুটি। হ্যাঁ, একই নামে তিনি দুটি ছবি এঁকেছিলেন, প্রথমটি ১৪৮২-৮৩ সালে, দ্বিতীয়টি ১৫০৬-০৮ সালে। প্রথমেই ছবিটির প্রেক্ষাপট একটু বলা যাক। ১৪৮২ সালে লিওনার্দো ফ্লোরেন্স থেকে মিলানে চলে আসেন এবং ১৪৮৩ সালে সেখানের কনফ্রাটের্নিটি অফ দ্য ইম্যাকুলেট কনসেপশন (Confraternity of the Immaculate Conception) তাকে এই ছবিটি আঁকার অর্ডার দেয় এবং সেইমতো আগাম টাকা পয়সাও দেয়। লিওনার্দো ছবি সম্পূর্ণ হলেও তাঁদেরকে ছবিটি দিতে অস্বীকার করেন, এবং বাড়তি টাকা দাবী করেন। এই নিয়ে দীর্ঘ আইনি বিবাদ চলে। ইতিমধ্যে লিওনার্দো গোপনে ছবিটি বিক্রি করে দেন। এই ছবিটিই পরবর্তীকালে প্যারিসে আসে এবং লুভের মিউজিয়ামে স্থান পায়। বর্তমানে ছবিটি মোনা লিসার পাশের দেয়ালে একই ঘরে রাখা গেছে।

দ্বিতীয় ‘ভার্জিন অফ দ্য রকস’, ১৫০৬-০৮, কাঠের উপর তেল রং, ৭৪.৬ ইঞ্চি x ৪৭.২৫ ইঞ্চি, ন্যাশনাল গ্যালারি, লন্ডন

যাই হোক, আইনি বিবাদ শেষ হলে, ১৫০৮ সালে, নির্ধারিত সময়ের প্রায় কুড়ি বছর বাদে লিওনার্দো কনফ্রেটার্নিটিকে দ্বিতীয় ভার্জিন অফ দ্য রকস ছবিটি দেন। দুটি ছবি বহুলাংশেই হুবহু এক, যদিও কিছু বিশেষ তফাৎ আছে। এই ছবিটি পরবর্তী কালে এক স্কটিশ শিল্পী কনফ্রেটার্নিটির কাছ থেকে কিনে ব্রিটেনে আনেন। বর্তমানে ছবিটি রয়েছে লন্ডনের ন্যাশনাল গ্যালারীতে।

দুটি ছবিই কাঠের প্যানেলে তেল রঙে আঁকা। দুটোই বেশ বড় সাইজের, তার মধ্যে লন্ডনেরটি একটু ছোট। ছবিতে দেখা যাচ্ছে মাতা মেরি, শিশু যীশু, শিশু জন দ্য ব্যাপটিস্ট, এবং দেবদূত বা পরি গ্যাব্রিয়েল (অথবা উরিয়েল)। ধর্মীয় কিংবদন্তী অনুযায়ী রাজা হেরড যীশুকে মেরে ফেলতে পারেন এই আশঙ্কায় পিতা যোসেফ মেরি ও যীশুকে নিয়ে মিশরে চলে যান। সেই যাত্রাপথে যীশুর সম্পর্কে খুড়তুতো ভাই জন দ্য ব্যাপটিস্ট এসে তাঁদের সাথে মিলিত হোন এক গুহার মধ্যে। জন দ্য ব্যাপটিস্টকে বেথলেহেম থেকে নিয়ে আসেন পরি গ্যাব্রিয়েল। লিওনার্দো এই মিলন দৃশ্যটি এঁকেছেন। যীশু এখানে মাটিতে বসে সামনের দিকে। তাঁকে আলতো ভাবে ধরে আছেন গ্যাব্রিয়েল (তাঁর ডানা রয়েছে)। যীশুর বিপরীতে রয়েছে শিশু জন, হাঁটু গাড়া অবস্থায়। আর জনকে ধরে উঁচুতে বসে আছেন মাতা মেরি। এখানে বলা ভাল লিওনার্দোকে যে ছবিটি আঁকতে বলা হয়েছিল, তা হওয়ার কথা ছিল অন্যরকম— তাতে আরও বেশি চরিত্র থাকার কথা ছিল এবং যীশুকে সবার ওপরে রেখে আরও ঐশ্বরিক ও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু লিওনার্দো সেসব কিছুই মানেন নি। সরলতার মধ্যে সৌন্দর্য প্রকাশ করাই তাঁর উদ্দেশ্য। তিনি তাই করেছেন।

লক্ষ্য করা উচিত যে চার চরিত্রকে বসানো হয়েছে একটি ত্রিভুজাকার বা পিরামিড ক্ষেত্রের মধ্যে। ফলে মাতা মেরির মুখমণ্ডল মুখ্য ফোকাল পয়েন্ট। সেটি নীচ থেকে দেখলে দুই তৃতীয়াংশ দূরত্বে রয়েছে। আবার আড়াআড়ি দেখলে মেরির অবস্থান একেবারে ঠিক মাঝামাঝি। ফলে যীশুর থেকে অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছেন ভার্জিন মেরি। প্যারিসের ছবিটি দেখলেই বোঝা যায় লিওনার্দো ইতিমধ্যেই স্ফুমাটো পদ্ধতি আয়ত্ত করে ফেলেছেন। এক রং থেকে আরেক রঙে উত্তরণ এত সাবলীল ও নিঃশব্দ যে চারটি চরিত্র যেন মিশে আছেন পরিপার্শ্বের সঙ্গে। পিছনে পাহাড়, নদী ও লতাপাতা বোঝা গেলেও ডিটেলগুলি আলো আঁধারির মধ্যে লুকিয়ে আছে। একই সঙ্গে প্রত্যেকের অঙ্গভঙ্গি, আঙুলের অবস্থান, মুখের অভিব্যক্তি দর্শকের মনে অত্যন্ত কৌতূহল জাগায়। প্রকৃত অর্থেই এটি (অর্থাৎ দুটি ভার্সানই) একটি মাস্টারপিস।

তবুও কয়েকটি পার্থক্যের কথা বলা দরকার। দ্বিতীয় ছবিটিতে (যেটি লন্ডনে আছে) রঙের বৈপরীত্য একটু বেশি। পিছনের প্রেক্ষাপট আর একটু রহস্যময়। এবং শীতল নীল রঙের ব্যবহার লাল ও সবুজের উষ্ণতার বৈপরীত্যে একধরনের ভারসাম্য আনে। অন্যদিকে প্রথম ছবিটি অনেক বেশি উষ্ণ। দুটি ছবিকে তাই উষ্ণ ও শীতল এই দুই ট্রিটমেন্ট ভাবা যেতে পারে।

আরও লক্ষণীয়, দ্বিতীয় ছবিটিতে দেবদূত ছাড়া প্রত্যেকের মাথার পিছনে আলোর বলয় আঁকা হয়েছে, তৎকালীন ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী যীশুর পরিবারকে পবিত্র পরিবার বোঝানো হত এইভাবে। প্রথম ছবিটিতে এই বলয়গুলি নেই। সম্ভবত, লিওনার্দো বলয়গুলি আঁকতে ইচ্ছুক ছিলেন না, কিন্তু দ্বিতীয় ছবিটি কনফ্রাটের্নিটিতে যাবে বলেই অনিচ্ছাসত্বেও এঁকে দেন। প্রথম ছবিটিতে দেবদূত গ্যাব্রিয়েলের তর্জনী প্রক্ষেপণ আর একটি কৌতূহল জাগানোর বিষয়। অনেকে মনে করেন লিওনার্দোর ছবির মধ্যে কোন একটা অজ্ঞেয় রহস্যময়তা আছে। বোধহয় তিনি কোনও গোপন সংকেত বা মেসেজ তাঁর ভবিষ্যত অনুগামীদের জন্যে রেখে গেছেন। লেখক ড্যান ব্রাউন তাঁর ‘দা ভিঞ্চি কোড’ উপন্যাসে প্রথম ছবিটির (যেটি প্যারিসে রয়েছে) দেবদূতের তর্জনীভঙ্গি নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা করেছেন।