Categories
গল্পগ্রাম |

ভূতুড়ে ঘন্টা

1281 |
Share
| ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০
রাজর্ষি চক্রবর্ত্তী

অলংকরণ: কমলাকান্ত পাকড়াশী

সালটা ২০০৫। অধ্যাপনার কাজ নিয়ে এলাম মুর্শিদাবাদ জেলার সদর শহর বহরমপুরে। এসেই বাড়ি ভাড়া পাওয়া সম্ভব নয়। তাহলে থাকব কোথায়? কলেজের অধ্যক্ষ বললেন যে, কলেজের একটা পুরনো বাড়ি আছে, সেখানে বাড়ি ভাড়া পাওয়া অবধি আমি থাকতে পারি। এই উত্তম প্রস্তাবে আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম এবং ওখানে যাবার জন্য তোড়জোড় করতে লাগলাম। কলেজের একজন অফিস-স্টাফ আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন যে, আমার ওখানে না যাওয়াই ভাল কারণ ওই জায়গাটা ভাল নয়। আমি জানতে চাইলাম ওখানে চোর, ছিনতাইবাজের উপদ্রব আছে নাকি! উত্তরে উনি বললেন, চোর নয় লোকে বলে, ভূত আছে। কথাটা শুনে আমার হাসি পেল। আমি কলকাতার ছেলে। কলকাতায় আমার পঁচিশ বছরের জীবনে তো কখনও ভূতের সাথে মোলাকাত হয়নি, এখন বহরমপুরে এসে যদি ভূতের দেখা পাই তাহলে মন্দ কী?

আমি আমার ব্যাগ-ব্যাগেজ নিয়ে উঠলাম ওই পুরনো বাড়িতে। বাড়ির দু-একটা ঘর ব্যবহার-উপযোগী আছে, বাকি সব ভগ্ন। তবে জায়গাটা খুব সুন্দর, একদম ভাগীরথীর পাড়ে। বাড়ির দেখাশোনা করে অভয়। সে-ই আমাকে বাড়ির দোতলায় একটা ঘর খুলে দিল। বাড়িটা ভাঙাচোরা হলেও আমাকে যে ঘরে থাকতে দেওয়া হল সেটার অবস্থান খুব সুন্দর। ঘরের পাশে যে ঝুল বারান্দা তার প্রায় নীচ দিয়েই ভাগীরথী নদী বয়ে যাচ্ছে। ঘরটা বেশ বড় ও ঘরের জানলা দরজাগুলিও বেশ বড় বড়। দেখেই বোঝা যায় এ বাড়ির বয়স অনেক। এই বাড়ির পাশেই আরেকটা ভাঙা বাড়ি। বাড়ি না বলে সেটিকে প্রাসাদ বলাই ভাল। অভয়কে জিজ্ঞাসা করে জানলাম এই বাড়িগুলি নির্মাণ করেছিলেন কাশিমবাজারের জমিদাররা। এখন জমিদারি প্রথা আর নেই, তাই এগুলি এখন ভগ্ন। তার মধ্যে এই বাড়িটা ওই জমিদারির উত্তরাধিকারিরা কলেজকে দান করে দিয়েছেন। কিন্তু এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ কলেজের হাতে নেই। এই বাড়ির যা অবস্থা, যা বিপুল খরচ হবে একে ঠিক মতো মেরামত করতে, তত পরিমাণ টাকা কলেজের হাতে নেই। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর অভয় চলে গেল; বলে গেল রাতের খাবার ও-ই দিয়ে যাবে।

অভয় চলে গেলে আমি গা ধুয়ে, টি-মেকারে চা করে ঝুল বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। ভাগীরথীর দিকে তাকিয়ে মন ভরে গেল। অন্যদিকে ভাঙা প্রাসাদটার দিকে চোখ পড়তেই মনে হল একদিন না জানি এখানে কত লোকের যাতায়াত ছিল। কত উৎসব অনুষ্ঠান হয়েছে এখানে, হয়েছে কত স্বপ্ন বোনা, আর আজ সবই ভগ্ন, শ্রীহীন।

অভয় ছেলেটি খুবই পাংচুয়াল। ঠিক রাত সাড়ে আটটায় আমার জন্য রাতের খাবার নিয়ে এল। খুব পরিশ্রান্ত ছিলাম তাই খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়লাম। সাড়ে ন’টা দশটার মধ্যে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। অনেক রাতে হঠাৎ একটি ঘড়ির ঢং ঢং ঘন্টায় ঘুম ভেঙে গেল। গির্জার ঘন্টাধ্বনির মত গম্ভীর সেই ঘন্টাধ্বনি। মোবাইলে দেখলাম রাত তখন তিনটে। ঠিক বুঝতে পারলাম না যে আমি স্বপ্নে ওই ঘন্টাধ্বনি শুনলাম নাকি এই বাড়ির কোথাও কোন বড় ঘড়ি আছে যার আওয়াজ আমি শুনলাম। তবে মনে হল আমি স্বপ্নই দেখেছি, কারণ এই বাড়িতে ঘড়ি থাকলেও সেটা তো শুধু আর একবার ঘন্টা দেবে না! আর আমি এখানে আসার পর তো একবারও কোনও ঘড়ির ঘন্টা শুনিনি। একটু জল খেয়ে আবার শুয়ে পড়লাম।

সকালে অভয় জলখাবার নিয়ে এল। আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম এই বাড়িতে বা পাশের ভাঙা জমিদার-প্রাসাদে কোনও বড় ঘড়ি আছে কিনা যা এখনও ঘন্টা দেয়। অভয় কথার কোনও উত্তর না দিয়ে যাবার সময় বলল, ‘স্যার আমার মনে হয় আপনার এখানে না থাকাই ভাল।’ মনে মনে অভয়ের ওপর খানিকটা বিরক্তই হলাম আমি। একটা সাধারণ প্রশ্ন করেছিলাম যার উত্তর ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’-তে দেওয়া যেত, তা না দিয়ে সে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল৷ তাছাড়া, আমি তো এখানে শখ করে থাকছি না, নেহাত এসেই বাড়ি ভাড়া পাওয়া যায় না, তাই এখানে মাথা গুঁজে আছি।

আমি তৈরি হয়ে কলেজে চলে গেলাম। নতুন চাকরি, কর্মব্যস্ততায় কেটে গেল সারাদিন। ঘরে ফিরে চা নিয়ে চলে এলাম ঝুলবারান্দায়। সামনে শান্তভাবে বয়ে চলেছে ভাগীরথী। মনে মনে ভাবলাম কলেজের অধ্যক্ষ আমাকে এখানে থাকতে দিলে আমি সারাজীবন এখানেই থেকে যাব।

রাত ঠিক সাড়ে আটটায় অভয় খাবার নিয়ে হাজির। বেশি কথা হল না। অভয় শুধু যাবার সময় বলে গেল রাতে ঘুমাতে যাবার আগে যেন আমি জমিদারবাড়ির দিকের জানলাটা বন্ধ করে ঘুমাই। উত্তরে আমি শুধু বললাম ‘হুঁ’। পড়াশোনা সেরে শুতে শুতে প্রায় রাত বারোটা হল। তারপর ঘুমের অতলে তলিয়ে গেলাম। রাত কত ঠিক মনে নেই, হঠাৎ ঘড়ির ঢং ঢং আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। বিছানার ওপর ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। মোবাইলে দেখলাম রাত তিনটে বাজে। আমি কি স্বপ্ন দেখলাম? পরপর দু’রাত কি একই স্বপ্ন দেখা সম্ভব? জল খেয়ে আবার শুলাম বটে কিন্তু আজ আর ঘুম এল না।

একটাই প্রশ্ন মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল: আমি এরকম ঘড়ির ঘন্টা পরপর দু’দিন ঘুমের মধ্যে শুনলাম কী করে? আমার মনে হয়েছিল যে, স্বপ্নের মধ্যেই শুনেছি কারণ কোনও ঘড়ি যদি সত্যি সত্যি থাকত তবে তো সেটা একবার মাত্র শেষ রাতে বাজবে না। ঘন্টাখানেক শুয়ে শুয়ে এসব ভাবার পর ভোরের আলো ফুটতেই ভাগীরথীর পাড়ে ঘুরতে চলে গেলাম। ভাগীরথীর ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লাগতেই মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। ঠিক করলাম আজ রাত তিনটে অবধি জেগে থাকব বা এলার্ম দিয়ে তিনটের আগে উঠে পড়ব। ব্যাপারটা কী আমাকে বুঝতেই হবে।

সেদিন রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম, ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে। রাত আড়াইটায় ঘুম থেকে উঠে এদিক ওদিক পায়চারি করছি, হঠাৎ ভাঙা বাড়িটার দিক থেকে একটা ক্ষীণ কিন্তু তীক্ষ্ণ আর্তনাদ ভেসে আসল। ক্ষীণ হলেও আমার ভেতর অবধি কেঁপে উঠল সেই আর্ত চিৎকারে। এটা যেন কোনও মৃত্যু পথযাত্রী মানুষের শেষ আর্তনাদ। বাইরে অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না। কোন মানুষকে কি তাহলে কোন গুন্ডারা এখানে এনে খুন করছে? আমার কি এখুনি বাইরে ছুটে যাওয়া উচিৎ? আবার মনে হল আমি এখানে নতুন, কিছুই চিনি না, অন্ধকারে ভাঙা জমিদার বাড়িতে গিয়ে কিছুই চিনতে পারব না। তাছাড়া, মনে হল এই ক্ষীণ চিৎকার যেন অনেক দূর অতীত থেকে ভেসে আসছে। এখানে যদি সত্যি সত্যি কোনও মানুষ খুন হত তাহলে তার চিৎকার আরও অনেক জোরে শোনা যেত, কারণ এখন অনেক রাত, চারিদিক নিস্তব্ধ আর এটা ভাগীরথীর পাড়ে একটা ফাঁকা জায়গা। জানলায় দাঁড়িয়েই আমি দরদর করে ঘামছিলাম। কিন্তু আমার ভয় বা বিস্ময়ের আরও বাকি ছিল। খানিকবাদে ক্ষীণ অশ্বক্ষুরধ্বনি ভেসে আসল। খুব ক্ষীণ অশ্বক্ষুরধ্বনি যেন এই ফাঁকা প্রান্তরের নিস্তব্ধতা খান খান করে দিকে দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ছে। এত রাতে এখানে ঘোড়া ছোটায় কে? মুর্শিদাবাদে, যা লালবাগ নামেও পরিচিত, সেখানে অনেক ঘোড়ার গাড়ি আছে, একবার বেড়াতে গিয়ে দেখেছি, কিন্তু এটা তো বহরমপুর শহরের উপকণ্ঠে একটা জায়গা। এখান থেকে লালবাগ তো বেশ খানিকটা দূরে। সত্যিই যদি কেউ ঘোড়া ছুটিয়ে যায় তবে আওয়াজ এত ক্ষীণ কেন? আমি কি তাহলে এত ভয় পেয়ে গিয়েছি যে কানে ঠিকঠাক শুনতেও পাচ্ছি না? এমন সময় একটা ঘড়ি খুব জোরে তিনবার ঢং ঢং করে বেজে উঠল। গির্জার ঘন্টাধ্বনির মতো গম্ভীর সেই ঘন্টাধ্বনি। এই ঘন্টাধ্বনি কিন্তু ক্ষীণ বা অস্পষ্ট নয়, বেশ স্পষ্ট। তার মানে আগের দু’রাত আমি স্বপ্নের মধ্যে ঘন্টার আওয়াজ শুনিনি, সত্যি কোনও ঘড়িতে ঢং ঢং করে ঘন্টা বেজেছিল। প্রচণ্ড আতঙ্কে আমি ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগলাম। একবার অভয়কে ফোন করলাম কিন্তু ফোন সুইচড্ অফ। কে আর সারা রাত ফোন খুলে রেখে আমার ফোনের অপেক্ষায় বসে থাকবে? একরাস ভয় আর উৎকণ্ঠা নিয়ে ভোরের আলো ফোটার অপেক্ষা করতে লাগলাম। সময় কিছুতেই কাটছিল না। এক-এক মিনিট যেন এক-এক ঘন্টা। বাইরের অন্ধকার যেন আমাকে গিলে খেতে আসছে। নিজের ওপরেই আমার খুব রাগ হতে লাগল। কী দরকার ছিল আমার এখানে আসার? একটা হোটেল ভাড়া করে থাকলেই হত! একই সঙ্গে রাগ হতে লাগল কলেজের অধ্যক্ষের উপর। তিনি নিশ্চয়ই এই সব ঘটনা জানেন তবু আমাকে এখানে পাঠালেন।

ভোরের আলো ফোটা মাত্র আমি ঘর থেকে বেরিয়ে ভাগীরথীর পাড়ে চলে গেলাম। খানিকক্ষণ পর দেখলাম দূরে দূরে কিছু গোয়ালা গরু নিয়ে যাচ্ছে। তাদের দেখে মনে অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করলাম। মনে হল, ভূতের জগৎ থেকে আবার মানুষের জগতে ফিরে আসতে পেরেছি।

সকাল হতেই কলকাতায় আমার খুব ক্লোজ এক বন্ধু, সঞ্জয়কে ফোন করলাম। ও কলকাতার একটা প্যারানরমাল সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত। ওর এই সব কাজ নিয়ে আমরা বন্ধুরা খুব হাসি-ঠাট্টা করতাম। কিন্তু ঠেলার নাম বাবাজি। ও ঘুম জড়ানো গলায় আমার ফোন ধরল। আমি আমার রাতের অভিজ্ঞতা ওকে সব বললাম। ও সব শুনে আমাকে বলল, ‘আজ তো বৃহস্পতিবার। আজ তুই ওখানে থাক, আর এই উইকএন্ডে তুই যদি কলকাতায় না ফিরিস তাহলে কাল শুক্রবার আমি অফিস করে আমার এক বন্ধুকে নিয়ে বহরমপুরে চলে যাব। উইকএন্ডটা তোর ওখানে থেকে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করব।’ আমি বললাম, ‘আমি উইকএন্ডে কলকাতায় যাওয়া ক্যানসেল করতে পারি, কিন্তু আর এক রাত ও বাড়িতে আমার একা থাকা সম্ভব নয়। ওখানে আর একরাত একা থাকলে আমি পাগল হয়ে যাব।’ শুনে সঞ্জয় বলল, ‘তুই ওখানে একা থাকতে না পারিস তো অন্য কোথাও থাক।’ সঞ্জয়ের সঙ্গে কথা বলে আমার আস্তানার দিকে পা বাড়ালাম। জিনিসপত্র সব গুছিয়ে নিতে হবে। আমি আর কলেজ থেকে এখানে ফিরব না।

আমার ঘরে পৌঁছে দেখি অভয় জলখাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখে মনে পড়ে গেল যে আজ আমার সকালে মুখ-ধোয়া, চা-খাওয়া কিছুই হয়নি। অভয় আমাকে দেখেই বলল, ‘স্যার আপনার কি কাল রাতে ঘুম হয়নি? আপনার চেহারা কেমন যেন একটা উসকো-খুসকো লাগছে।’ আমি কথাটার কোনও উত্তর দিলাম না। ঘরে ঢুকে বললাম, ‘অভয় তুমি কাল আমাকে এখানে থাকতে না করেছিলে কেন?’ অভয় বলল, ‘স্যার এখানে এক রাতের বেশি কেউ থাকতে পারেনি, এক রাত থেকেই হোটেলে গিয়ে ওঠে, তারপর ভাড়া বাড়ি দেখে নেয়।’ আমি শান্তভাবে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেন?’ উত্তরে সে বলল, ‘স্যার এখানে নাকি রাত্রে অদ্ভুত ঘড়ির আওয়াজ শোনা যায়।’ আমাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কিছু শোনেন নি?’ আমি বললাম, ‘হুঁ’। অভয়ের মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল। আমি ওকে আর বেশি কথা বলার সুযোগ দিলাম না। কাজ আছে বলে বেরিয়ে গেলাম। সেদিন কলেজ থেকে আমি আর সেই ঘরে ফিরলাম না। আমার এক কলিগ অরিজিতের মেসে সেই রাতটা থেকে গেলাম। পরদিন শুক্রবার কলেজ থেকে গেলাম সেই কলিগেরই মেসে। অনেকক্ষণ আড্ডা মারার পর রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ গেলাম বহরমপুর স্টেশনে। ভাগীরথী এক্সপ্রেসে আসছে আমার বন্ধু সঞ্জয় ও তার আরেক ভূতচর্চাকারী বন্ধু শান্তনু!

ট্রেন ঠিক সময়ে পৌঁছে গেল। ওদের দেখে বেশ আনন্দ হল। আমরা তিনজনেই রিক্সা ধরে ভাগীরথীর পাড়ে আমার আস্তানায় পৌঁছলাম। অভয়কে আগেই খাবারের কথা বলে রেখেছিলাম। তাছাড়া তিনজন যাতে রাতে শুতে পারি তার ব্যবস্থাও করে রেখেছিলাম। সঞ্জয় আর শান্তনু পৌঁছে বলল ওদের ঘুমাবার প্রয়োজন নেই, রাতেই ওরা খানিকটা রেইকি করবে। আমরা তিনজন গল্প করতে করতেই খাওয়া-দাওয়া সারলাম। সঞ্জয় আমাকে বলল, ‘আমার প্যারানরমাল সোসাইটির ইনভলমেন্ট নিয়ে অনেক হাসি-ঠাট্টা করতিস, এখন ছাই ফেলতে ভাঙা-কুলো আমাকেই তোর ডাকতে হল!’

আমি এই কথার কোনও উত্তর না দিয়ে বললাম, ‘চল, এবার একটু গড়িয়ে নেওয়া যাক।’ সঞ্জয় বলল, ‘তোর ইচ্ছা হলে গড়া, ঘুমা যা ইচ্ছা কর, আমরা EMF Reading নেওয়ার বিষয়গুলো সেট-আপ করি।’ আমি অবাক হয়ে বললাম ‘সে আবার কী?’ সঞ্জয় গম্ভীরভাবে বলল, ‘সে পরে বুঝিয়ে বলব, এখন যেদিক থেকে শব্দটা আসছিল বলে মনে হয় সেদিকে আমাদের নিয়ে চল।’ আমি বললাম, ‘শব্দটা তো ওই ভাঙা জমিদারবাড়িটার দিক থেকে আসছিল। সেদিকটা পুরোটাই ভাঙা আর আগাছায় ভর্তি। আমি নিজেই তো ওদিকে কখনও যাইনি, তোদের কী করে নিয়ে যাব? তাছাড়া ওখানে এত অন্ধকারে যাওয়া মোটেই সেফ নয়। সাপখোপ, বিষাক্ত পোকা-মাকড় থাকতেই পারে। কাল সকালে না হয় যাস; এখন ঘুমিয়ে নে।’ সঞ্জয় বলল, ‘তোকে যেতে হবে না। আমাদের দেখিয়ে দে আমরা দুজনে চলে যাচ্ছি, তুই ঘুমিয়ে নে।’ আমি বললাম, ‘মানে? আমি তোদের ডেকে আনলাম আর এখন ওই ভাঙা জমিদারবাড়িতে তোদের একা পাঠিয়ে আমি শান্তিতে ঘুমাব? ভূত যদি নাও থাকে সাপখোপ তো ওখানে নিশ্চয়ই আছে। আমি তোদের একা ছাড়তে পারব না।’ সঞ্জয় বলল, ‘তুই তো ভূতের ভয়ে মরছিলি, আজ আমাদের দেখে খুব সাহস বেড়েছে দেখছি। যা বলছি তাই কর। আমাদের ওদিকটায় নিয়ে চল।’

অগত্যা ওই অন্ধকারে টর্চ জ্বেলে দুজনকে সঙ্গে নিয়ে ভাঙা জমিদারবাড়ির দিকে এগোলাম। আমার প্রচণ্ড ভয় করছিল, মনে মনে ভাবলাম সঞ্জয়কে ফোন করে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে এনেছি। এর থেকে হোটেলে চলে গেলেই তো পারতাম। কী দরকার ছিল এসব ঝামেলায় জড়ানোর?

জমিদারবাড়িটা পুরোটাই এখন একটা ভগ্নস্তূপ; তবে এককালে যে বেশ বড় ছিল সন্দেহ নেই। ভাঙা সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। টর্চের আলোয় সুন্দর পঙ্কের কাজ দেখে বোঝা গেল কত শৌখিনভাবে এই বাড়িটি তৈরি করা হয়েছিল। সেইদিন কি কেউ জানত যে একদিন এটা একটা ভগ্নপ্রায় ভূতের বাড়িতে পরিণত হবে? টর্চের আলো পড়তেই কয়েকটা বাদুড় ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে উড়ে গেল। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ক্রমাগত কানে আসছিল। মাকড়সার জাল সরিয়ে সরিয়ে আমার দুই সহযাত্রী একটি জায়গায় পৌঁছে বলল যে তারা সেখানে বসবে। চারিদিকে ঘন অন্ধকার। ঝিঁঝিঁর ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। চারিদিকে একটা উটকো গন্ধ। এখানে বসতে হবে শুনেই আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। আমি বললাম, ‘এখানে কী করে বসব?’ সঞ্জয় বলল, ‘আমাদের সঙ্গে খবরের কাগজ আছে তাই পেতে বসতে হবে।’ আমি বললাম, ‘এখানে ভূত আসার আগে তো সাপের কামড়ে মরে যাব।’ সঞ্জয় বলল, ‘সঙ্গে কার্বোলিক অ্যাসিড আছে, ছড়িয়ে দিচ্ছি।’ ওরা কার্বোলিক অ্যাসিড ছড়িয়ে খবরের কাগজ পেতে বসল আর ব্যাগ থেকে কীসব বের করতে লাগল। আমাকে বলল, ‘এসব সেট করা হয়ে গেলে টর্চ নিভিয়ে দিতে হবে।’ আমি পড়লাম মহাবিপদে। কেন যে সঞ্জয়কে ফোন করতে গেলাম। মনে মনে নিজের গালে নিজেই চড় মারতে লাগলাম।

আমি বসছি না দেখে সঞ্জয় বলল, ‘তোর অস্বস্তি হলে তুই ঘরে গিয়ে ঘুমাতে পারিস।’ কথাটায় এমন একটা বিদ্রুপের ছোঁয়া ছিল যে না বসে পারলাম না। এরপর সঞ্জয় বলল, ‘টর্চ নিভিয়ে দিচ্ছি, সবাইকে চুপ করে বসে থাকতে হবে।’ সঞ্জয় এমনভাবে কথাগুলো বলছিল যে মনে হল যেন ও আমার শিক্ষক আর আমি ওর ছাত্র। মনে মনে বললাম, ভূতের হাত থেকে যদি আজ কপাল জোরে বেঁচে যাই তাহলে পরে তোর মজা দেখাব।

ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমরা তিনমুর্তি বসে রইলাম। রাত আড়াইটের কিছু পরে হঠাৎ সেই ক্ষীণ আর্ত-চিৎকার ভেসে আসল। হাড়-হিম-করা সেই আর্তনাদের সঙ্গেই ওদের আনা যন্ত্রটা দপদপ করে উঠল। অন্ধকার ততক্ষণে অনেকটা চোখ-সওয়া হয়ে গেছে। দেখলাম আমার দুই ভূতচর্চাকারী বন্ধু যন্ত্রটির ওপর ঝুঁকে পড়েছে। এইসময় হঠাৎ দমকা হাওয়া শুরু হল ও তার সঙ্গে সঙ্গে বাজ পড়তে শুরু করল। বুঝতে পারলাম ঝড়বৃষ্টি আসতে চলেছে, কিন্তু কিছু বলতে পারলাম না, পাছে সঞ্জয়ের কাছে ধমক খেতে হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি এল। এবার আর চুপ করে বসে থাকতে পারলাম না। পাশের দুই ছায়ামূর্তিকে বললাম, ‘চল তাড়াতাড়ি ঘরে যাই।’ কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্রবল বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে গেল। আমার পিড়াপিড়িতে শেষ পর্যন্ত দুজন ঘরে ফিরতে সম্মত হল। ওদের নিয়ে কোনওমতে সেই ভাঙা বাড়ি থেকে বের হলাম। যখন ঘরে পৌঁছলাম তখন আমরা তিনজনেই কাকভেজা। এই সময় বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে কোন এক অদৃশ্য ঘড়ি ঢং ঢং করে তিনবার ঘন্টা বাজাল। যন্ত্রের দিকে তাকিয়ে সঞ্জয় ও শান্তনু একসঙ্গে বলে উঠল ওখানে কোনও অশরীরীর উপস্থিতি নিশ্চয়ই ছিল। আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল, সঞ্জয় ও শান্তনুর মুখও দেখলাম থমথমে। প্রবল ঝড়বৃষ্টি থামতে ভোর হয়ে গেল।

বৃষ্টি থামলেই আমরা তিনজন ভাগীরথীর পাড়ে হাওয়া খেতে গেলাম। সঞ্জয় বলল, ‘আজ তোকে বহরমপুরের সিধুজ্যাঠার কাছে নিয়ে যাব।’ প্রশ্ন করলাম, ‘তিনি আবার কে?’ সঞ্জয় বলল ‘ওঁর নাম অনাথনাথ ঝা’। এখানে একটা কলেজে অধ্যাপনা করতেন। এখন অবসর নিয়েছেন। আমাদের প্যারানরমাল সোসাইটির একজন সদস্য। একটা মিটিং-এ আলাপ হয়েছিল। এখানেই ভাগীরথীর পাড়ে একটা বাড়িতে থাকেন।

ওইদিন ফোনে যোগাযোগ করে বিকালের দিকে অধ্যাপক ঝা-এর বাড়ি উপস্থিত হলাম। ভদ্রলোক দীর্ঘদেহী, সত্তরের কাছাকাছি বয়স, মাথার চুল সব সাদা। তার বাড়িটি খুব সুন্দর জায়গায়। বারান্দায় বসলে ভাগীরথী দেখা যায়। বড় বাগান ঘেরা বাড়ি। চা-পানের পর আমাদের বললেন ওঁর ঠাকুরদার কাছে শোনা ঘড়ির ঘন্টার ইতিবৃত্ত।

উনি বলতে শুরু করলেন, ‘অষ্টাদশ শতাব্দীতে কাশিমবাজার অঞ্চল রেশম ব্যবসার জন্য প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে। বহু দেশি-বিদেশি বণিক এখানে আসেন ও নিজের নিজের কুঠি নির্মাণ করেন। আশেপাশের অঞ্চল থেকে বহু মানুষ ভাগ্যান্বেষণে এখানে এসে বসবাস করতে থাকেন। এইরকম একটি পরিবার বর্ধমান থেকে এসে কাশিমবাজারে বসবাস করতে আরম্ভ করে। এই পরিবারের একজন ব্যক্তি প্রাণকৃষ্ণ রায় ইংরেজ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানিকে রেশম সরবরাহ করে প্রভূত অর্থের মালিক হন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর তিনি নিলাম হওয়া বহু জমিদারি কিনে নেন ও জমিদার হয়ে বসেন। তিনিই বাড়িটা নির্মাণ শুরু করেন, যদিও এই বিশাল ভবনের নির্মাণকার্য শেষ হয় তার পুত্র কৃষ্ণচরণ রায়ের সময়। এই পরিবারের উত্তরপুরুষ রাধাকৃষ্ণ রায় তৎকালীন ইংরেজ সাহেবদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন। তার সাথে বেশ কিছু প্রভাবশালী ইংরেজ কর্তাদের যোগাযোগ ছিল ও তাদের কেউ কেউ ছুটি কাটাতে তার কাশিমবাজারের বাড়িতেও আসতেন। অনাথনাথ ঝা মহাশয়ের পিতামহ বীরেন্দ্রনাথ ঝা এর সঙ্গে রাধাকৃষ্ণ রায়ের বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। একবার এক ইংরেজ উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ক্যাপ্টেন নিয়েলসন রাধাকৃষ্ণ রায়ের অতিথি হয়ে তার বাড়িতে এসে উঠলেন। এই সাহেব ছিলেন যেমন প্রভাবশালী, তেমনি দাম্ভিক ও বদমেজাজি। তাকে নিয়ে রাধাকৃষ্ণ রায় বেশ তটস্থ ছিলেন। তিনি তার খাসভৃত্য রামরতনকে সাহেবের দেখভালের জন্য নিয়োগ করেন। রাধাকৃষ্ণ ও রামরতন একই সঙ্গে বড় হয়েছিলেন জমিদার বাড়িতেও। দুজনের সম্পর্ক ছিল অনেকটা বন্ধুর মতো। এই কারণেই রাধাকৃষ্ণ রায় রামরতনকে সাহেবের কাজে নিয়োগ করেন।

রামরতন প্রাণপণ চেষ্টা করছিল সাহেবকে সন্তুষ্ট করার৷ তখন বৈশাখ মাস, প্রচণ্ড গরম, সাহেবের ঘুমের যাতে ব্যাঘাত না ঘটে তাই রামরতন নিজে রাতে টানাপাখা টানার দায়িত্ব নেয়। তার প্রভু রাধাকৃষ্ণ রায়ের যাতে কোন অসম্মান না হয় তার প্রতি সবসময় তার প্রখর দৃষ্টি ছিল। সারাদিন সাহেবের পরিচর্যা করা ও সারারাত জেগে পাখা টানার কাজ করছিল। তৃতীয় দিন রাতে পাখা টানতে টানতে রামরতনের চোখ লেগে যায়। পাখার হাওয়া বন্ধ হয়ে গেলে সাহেবের ঘুম ভেঙে যায় ও তিনি বেজায় ক্ষেপে যান। উনি তৎক্ষণাৎ বাইরে এসে দেখেন রামরতন ঘুমে ঢুলে পড়েছে। সাহেব হিংস্র সিংহের মত রামরতনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে ক্রমাগত লাথি, ঘুসি মারতে থাকেন। রামরতনের গায়েও জোর কম ছিল না, কিন্তু তার প্রভুর সম্মানের কথা মাথায় রেখে সে কোনও প্রত্যাঘাত করেনি। এদিকে সাহেবের লাথি তলপেটে বেকায়দায় লাগাতে রামরতন আর্ত-চিৎকার করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তার আর্ত-চিৎকার শুনে ওই মহলের দাসী মোতির মা ছুটে এসে দেখে রামরতন আর্তনাদ করতে করতে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। জমিদারবাড়ির বড় ঘড়িতে তখন ঢং ঢং করে তিনটে বাজছে।

পরের দিন সাহেব তো মৃত রামরতনের জন্য কিছু টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে কলকাতায় ফেরার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। এক সাধারণ নেটিভের মৃত্যুর জন্য আর কীই বা করার আছে তাঁর? ওই নেটিভকে বেয়াদপির শাস্তি দিতে গিয়ে একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে এই যা। তার জন্য পঞ্চাশ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়াই তো যথেষ্ট।

সাহেব চলে গেল, কিন্তু এই মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারল না রাধাকৃষ্ণ রায়। রামরতন তো শুধু তার ভৃত্য নয়, তার বন্ধুও বটে। তার মনে ভেসে উঠল রামরতনের বউ সীতামণির মুখ। সীতামণি যে তখন অন্তঃসত্ত্বা। আর এক মাস পরে রামরতন ও সীতামণির প্রথম সন্তানের ভূমিষ্ঠ হবার কথা।

সাহেব কলকাতায় রওনা হবার পরই রাধাকৃষ্ণ ছুটে গেলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। ম্যাজিস্ট্রেট সাফ জানিয়ে দিলেন ক্যাপ্টেন নিয়েলসনের মতো এত উচ্চপদস্থ ও প্রভাবশালী ইংরেজ অফিসারের বিরুদ্ধে তিনি কোনও ব্যবস্থা নিতে পারবেন না। তারপর রাধাকৃষ্ণ ছুটে গেলেন জেলার পুলিশ-সুপারের কাছে। পুলিশ-সুপার রাধাকৃষ্ণের বিশেষ পরিচিত ছিলেন। তিনি সব শুনে বললেন যে যা হবার তো হয়েই গিয়েছে। ক্যাপ্টেন নিয়েলসনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা জেলার কারোর পক্ষেই সম্ভবপর নয়। তাছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে গেলে রাধাকৃষ্ণ রায়েরও বিপদ হতে পারে। তিনি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে বলে রামরতনের পরিবারের জন্য ভাল ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করে দেবেন।

ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলেন রাধাকৃষ্ণ। এই হত্যাকাণ্ডের কোন বিচার হবে না তা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না। তিনি তার জমিদারীর আইনি পরামর্শদাতা উকিল রামতনু সেনকে ডেকে পাঠালেন। তিনিও সব শুনে বললেন ‘এই হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করা খুব সহজ হবে না। ইংরেজ উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করার বিপদও অনেক। জলে থেকে কুমিরের সাথে লড়াই করা যায় না।’

এদিকে রাধাকৃষ্ণ রামরতনের দেহ সৎকার করতে নিষেধ করেছেন। দেহ সৎকার করা হয়ে গেলে তো সব প্রমাণ নষ্ট হয়ে যাবে। এতে রামরতনের আত্মীয় পরিজন ও গৌড়সমাজে ক্ষোভের সৃষ্টি হবে। রামরতনকে তো আর বাঁচিয়ে তোলা যাবে না, বরং তার দেহ সৎকার না করে যদি রেখে দেওয়া হয় তাহলে তো আর রক্ষা নেই। কী করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না রাধাকৃষ্ণ রায়। কিছুতেই তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না রামরতনের মৃত্যু। একটা পর্যায়ে তাঁর মানসিক অস্থিরতা এমন জায়গায় পৌঁছাল যে তিনি গভীর রাতে একাই ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন। তিনি ভেবেছিলেন কলকাতায় খোদ ইংরেজ আইনজীবিদের সাহায্যে এর একটা হেস্তনেস্ত করবেন। কলকাতায় পৌঁছে রাধাকৃষ্ণ ইংরেজ আইনজীবিদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে আরম্ভ করলেন। সতর্ক হয়ে গেলেন ক্যাপ্টেন নিয়েলসন। তিনি মুর্শিদাবাদের জেলা ম্যাজিস্ট্রটেটকে দিয়ে রাধাকৃষ্ণের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলেন। তাতে বলা হল রাধাকৃষ্ণ তাঁর ভৃত্য রামরতনকে হত্যা করে কলকাতায় পালিয়ে গিয়েছেন। পুলিশকে বলা হল, তারা যেন রাধাকৃষ্ণ রায়কে গ্রেপ্তার করে অবিলম্বে বহরমপুরে নিয়ে আসে। গভীর রাতে ইংরেজ পুলিশ রাধাকৃষ্ণ রায়ের কলকাতার বাসভবন ঘিরে ফেলল। আত্মসমর্পণ করতে বলা হল তাকে। কিন্তু আত্মসমর্পণ না করে রাধাকৃষ্ণ পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালাতে লাগলেন। কিন্তু একা তিনি কতক্ষণ বিশাল পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়বেন? গুলি শেষ হয়ে আসছে দেখে শেষ গুলিটা রাধাকৃষ্ণ নিজের মাথা লক্ষ্য করেই চালিয়ে দিলেন। গুলির শব্দ শুনে বাড়ির চাকর-বাকররা তখন ওখানে ছুটে এসেছে। যখন রাধাকৃষ্ণ মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে তখন চাকর-বাকররা শুনল ঘড়িতে ঢং ঢং করে তিনটে বাজছে।’

আমরা ভাবলাম এখানেই হয়তো অনাথবাবু থামবেন, কিন্তু তিনি বলে চললেন—‘এর ঠিক একমাস পরের ঘটনা। ক্যাপ্টেন নিয়েলসন তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে বিশাল পালঙ্কে শুয়ে ঘুমাচ্ছেন। হঠাৎ তাঁর স্ত্রীর ঘুম ভেঙে গেল নিয়েলসন সাহেবের গোঙানির শব্দে। ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসে দেখলেন পাশে তাঁর স্বামী গোঙাচ্ছেন ও তার মুখে এক সাংঘাতিক ভয়ের ছাপ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিয়েলসন সাহেব নিস্তেজ হয়ে পড়লেন। তার মাথাটা একদিকে হেলে গেল। লেডি নিয়েলসন দৌড়ে জল আনতে গেলেন। সেই সময় তিনি শুনলেন ঘড়িতে ঘড়িতে ঢং ঢং করে তিনটে বাজছে। সাহেবের চোখে মুখে জল দিয়ে কোন ফল হল না। তিনি চিৎকার করে বাড়ির পরিচারক-পরিচারিকাদের ডাকতে লাগলেন। তারা এলে লেডি নিয়েলসন তাদের ডাক্তার ডাকতে বললেন। এতরাতে ডাক্তার পাওয়া সম্ভব নয়। ডাক্তার অবশেষে এল ভোর চারটেয়। ততক্ষণে লেডি নিয়েলসন বুঝে গিয়েছেন তার স্বামী আর বেঁচে নেই। ডাক্তার ডেথ সার্টিফিকেটে লিখল, Captain Neilson died of a massive cardiac arrest at about 3 A.M on 16th April 1896, though he did not have any previous history of heart problem.’

অনাথবাবু বললেন, ‘এরপর ভাগীরথী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে, কিন্তু এখনও কোনও কোনও সময়ে ওই ভাঙা জমিদার বাড়িতে কোনও অদৃশ্য ঘড়ি জানান দেয়, রাত তিনটে বাজল।’ আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত তার কথা শুনছিলাম। অনাথবাবু যখন থামলেন তখন আমরা আর কোনও কথা বলতে পারলাম না।

অনাথবাবুর বাড়ি থেকে ফিরে আমরা সেই রাতটা হোটেলেই কাটালাম। পরদিন যখন ওদের ট্রেনে তুলে দিতে এলাম সঞ্জয় বলল, ‘এরপর আশা করি আমার প্যারানরমাল সোসাইটির কাজকর্ম নিয়ে তোরা আর হাসি ঠাট্টা করবি না।’ আমি শুধু ম্লান হাসলাম। ওদের ট্রেন রওনা হল কলকাতার উদ্দেশে।