Categories
অদ্ভুতপুর |

ভূতের জাদুঘর

255 |
Share
| ২৪ মে, ২০২৩
শ্রমণা বসু

ছবি: ইন্টারনেট থেকে গৃহীত

ভূত নিয়ে জমিয়ে আড্ডা দেয়নি, এমন মানুষ পৃথিবীতে খুব কমই আছে। তোমরাও নিশ্চয়ই কোনও না কোনও সময়ে ভূতের গল্প শুনেছ ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে, আবার কেউ কেউ বুক ফুলিয়ে বলেছ ‘ভূত আবার কী? ধুস! ওসব তো গল্প!’ কিন্তু ভূত আছে কি নেই সেই তর্কে না গিয়ে আমরা যদি একটু চোখ-কান খোলা রেখে চারিদিকে খোঁজ-খবর নিই তাহলে দেখব যে পৃথিবীর সবকটি মহাদেশের প্রায় প্রতিটা দেশের আনাচে-কানাচেই লুকিয়ে আছে নানারকম ভূতের গল্প। স্থান-কাল বিশেষে তাদের নানারকম বিশেষত্বও রয়েছে। বলা যায়, গোটা পৃথিবীটা একটা ভূতের জাদুঘর!

আয়াকাশি

প্রথমেই বলি এক জাপানি ভূতের গল্প। নাম আয়াকাশি। পশ্চিম জাপানে প্রচলিত আছে যে মাঝসমুদ্রে কোনওভাবে কারও মৃত্যু হলে সে হয় আয়াকাশি। এরা খুবই প্রতিহিংসাপরায়ণ। মাঝসমুদ্রের যাত্রীদের এরা ভয় দেখিয়ে মেরে ফেলতে চায়, যাতে নিজেদের দলভারী হয়। সুসিমা দ্বীপের বিভিন্ন বীচে আবার সন্ধের দিকে হঠাৎ দেখা যায় এই আয়াকাশিকে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন এক অগ্নিকুণ্ডের ওপর দিয়ে কোনও বাচ্চা ছেলে বা মেয়ে হেঁটে চলেছে। অদ্ভুত না?

ডিওজেন

পূর্ব এশিয়ার দ্বীপেঘেরা দেশ জাপান ছেড়ে এবার পাড়ি দেব সুদূর ইওরোপের পশ্চিমদিকে, বেলজিয়ামে। এই বেলজিয়ামের রাজধানী শহর ব্রুসেলসের দক্ষিণ-পূর্বদিকে আছে এক মায়াঘেরা জঙ্গল, যার নাম সোনিয়ান ফরেস্ট। এখানে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের মধ্যেও ঘুরে বেড়ায় এক ধরনের অশরীরী আত্মা যার নাম ডিওজেন। শব্দটা ভাঙলে হয় ‘ডি’ আর ‘ওজেন’ মানে ‘দ্য আইজ’ (The Eyes)। ঘন জঙ্গলের মধ্যে সবুজ, কমলা, সাদা বা ধূসর রঙের কুয়াশা দেখা যায় আর তারপর সেই কুয়াশা থেকে তৈরি হতে থাকে ছোট ছোট ছায়ামূর্তি, যাদের দুটো জ্বলন্ত চোখ বোঝা যায় দূর থেকে। কখনও কখনও বাচ্চার কান্নার আওয়াজও শোনা যায়। আবার গাড়ি নিয়ে এই জঙ্গলে ঢুকলে কখনও গাড়ির জানলায় রক্তমাখা হাতের ছাপও দেখতে পাওয়া যায় হঠাৎ! কেমন একটা গা ছমছমে অথচ মায়াময় ব্যাপার না?

কিচকন্যা

এবার আসি নেপালে। হিমালয়ের কোল ঘেঁষে বেড়ে ওঠা এই দেশের মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যের খাঁজে খাঁজে লুকিয়ে রয়েছে নানারকম অশরীরী আত্মার গল্প। এখানে এক ধরনের আত্মা আছে যার নাম কিচকন্যা বা কিচকান্ডি। কোনও অবিবাহিত মেয়ে মারা গেলে বা কোনও মহিলা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেলে তারা হয় কিচকন্যা। তাদের অতৃপ্ত আত্মা মনে দুঃখ নিয়ে ঘুরে বেড়ায় চারিদিকে। লম্বা কালো চুল, ফ্যাকাশে মুখ, হাড়-গিলগিলে চেহারা আর পরনে লাল বিয়ের পোশাক—লোকমুখে শোনা যায় এমনই নাকি দেখতে কিচকন্যাদের। কিন্তু এত সাজুগুজু করা আত্মাকে ‘আত্মা’ বলে চিনবে কী করে? সোজা তাকাতে হবে পায়ের দিকে। দেখা যাবে, পায়ের পাতাদুটো উল্টো। কী কাণ্ড!

স্ট্রিগোই

দক্ষিণ এশিয়ার পাহাড়ি সৌন্দর্যে ঘেরা নেপাল ছেড়ে এবার ভূতের সন্ধানে দক্ষিণ-পূর্ব ইওরোপের পাহাড়ঘেরা দেশ রোমানিয়ায় যাওয়া যাক। রোমানিয়ার পুরাণে এক ধরনের আত্মার উল্লেখ আছে যার নাম স্ট্রিগোই। বলা হয়, স্ট্রিগোয় নাকি সমাধি থেকে উঠে আসে। এদের মধ্যে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ক্ষমতাও যেমন থাকে, তেমনই এরা ঘন ঘন রূপও বদলে ফেলতে পারে, যার ফলে এরা মাঝে মাঝেই কোনও পশুর রূপ ধারণ করে দেখা দেয়। সবথেকে ভয়ঙ্কর বিষয় হল স্ট্রিগোইয়ের কবলে যারা পড়ে, তাদের রক্ত থেকে এরা শক্তি পায়। যত রক্ত পাবে, তত বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠবে এই স্ট্রিগোই। ভাবা যায়!

ম্যাডাম কই কই

ইওরোপ থেকে এবার পা রাখব সোজা আফ্রিকার মাটিতে। এই আফ্রিকার বিভিন্ন শহরে এক ধরনের স্টাইলিশ অশরীরীর কথা শোনা যায়। অবাক লাগছে? ইনি কিন্তু সত্যিই স্টাইলিশ, কারণ এনার পায়ে নাকি থাকে হাই হিল। এই অশরীরীর নাম ম্যাডাম কই কই বা লেডি কই কই। শোনা যায়, আফ্রিকার বিভিন্ন শহরের বিভিন্ন বোর্ডিং স্কুলের ডর্মিটরি, হলওয়ে বা বাথরুমে মাঝরাতে একজোড়া হাই হিল পরে হেঁটে যান এই ম্যাডাম অশরীরী। আর ডে-স্কুলের বাথরুমে ইনি হানা দেন আর তাদেরকেই ভয় দেখান যারা খুব সকাল-সকাল স্কুলে পৌঁছে যায় বা খুব দেরি করে স্কুল থেকে বেরোয়। এনার কিন্তু একটা নাম নয়, বিভিন্ন শহরে ইনি বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন ঘানাতে এনার নাম ম্যাডাম হাই হিল বা ম্যাডাম মোক, আবার তাঞ্জানিয়াতে এনার নাম মিস কঙ্কোকো। সাউথ আফ্রিকায় আবার ইনি পিঙ্কি পিঙ্কি নামে পরিচিত। এক অশরীরীর এতগুলো নাম— কী আশ্চর্যের বিষয়!

টিয়ানাক

আফ্রিকা থেকে ভারত মহাসাগর পার করে প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিমদিকে অবস্থিত ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জের এক ভূত নিয়ে চর্চা করা যাক এবার। এখানকার এক বিখ্যাত ভূতের নাম হল টিয়ানাক। আসলে এদেরকে ভ্যাম্পায়াদের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ও বলা যেতে পারে। এরা সদ্যজাত শিশুর রূপ ধারণ করতে পারে। দূরে জঙ্গলের ভিতর থেকে শোনা যায় শিশুর কান্নার আওয়াজ, কোনও পথিক সেই কান্না শুনে জঙ্গলের ভিতর গিয়ে যখন শিশুটিকে কোলে তুলে নেন, তখন সেই শিশুর রূপ ছেড়ে আসল রূপে বেরিয়ে আসে টিয়ানাক এবং নিজের শিকারকে কখনও সে হাতছাড়া করে না। এরা পথিকদের পথভ্রষ্ট করে খুব মজা পায়। অদ্ভুত ব্যাপার, তাই না?

হেডলেস হর্সম্যান

এইবার যে ভূতের কথা বলব তাঁকে ভূতেদের জগতের কিংবদন্তি বলা যেতে পারে। মধ্যযুগ থেকে এনার আধিপত্য, নাম হেডলেস হর্সম্যান। ঘোড়ায় চড়া এক মানুষ যার মাথা নেই কিংবা মাথাটা নিজের হাতেই ধরে আছেন। ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড বা আমেরিকা – এই সব জায়গার লোককাহিনিতে গেঁথে রয়েছে হেডলেস হর্সম্যানের নাম ও কীর্তিকলাপ। বলা হয় যে কোনও যুদ্ধক্ষেত্রে ইনি নিহত হন, শরীর থেকে বাদ পড়ে যায় মাথা, পরে ভূত হয়ে নাকি তিনি নিজের মাথা খুঁজে বেরান। হেডলেস হর্সম্যানকে নিয়ে নানা সময় নানারকমের গল্প লেখা হয়েছে, সিনেমা বানানো হয়েছে, ছবিও আঁকা হয়েছে। বলতে পারো, হেডলেস হর্সম্যান ভূতেদের জগতের এমন এক সেলিব্রিটি যার জায়গা কখনও কেউ নিতে পারবে না।